International

ইজরায়েলঃ মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সফল অর্থনীতির ইতিকথা

Written by: এস. এম. নাহিয়ান

30-11-2023

ইজরায়েলঃ মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সফল অর্থনীতির ইতিকথা

 

মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের নাম যদি কোনো বিশ্ববাসী সবচেয়ে বেশি শুনে থাকে, তাহলে সেটি ইজরায়েল। বিশেষত বর্তমানের ফিলিস্তিন-ইজরায়েল অসম যুদ্ধে ইজরায়েলের নামটি যেন আরও অনেক বেশি করে ফুটে আসছে। শুধু বর্তমান নয়, অতীতেও এমন পরিস্থিতির আবির্ভাব হয়েছে বারংবার। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে যুদ্ধও ইজরায়েলের জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু যতবারই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, ততবারই একটি প্রশ্ন উঠে এসেছে যে, ইজরায়েলের অর্থনৈতিক শক্তির ভিত্তি আসলে কি? ঠিক কিভাবে প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে এতটা সমস্যা থাকার পরেও ইজরায়েলের অর্থনীতি তাদের সবার থেকে ভাল। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে যেতে হবে অনেক গভীরে, বিশ্লেষণ করতে হবে তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি। আর ঠিক সেসব প্রশ্নের উত্তরই থাকছে আজকের লেখাটিতে। 

 

ইজরায়েলের অর্থনীতির পূর্বকথা

১৯৪৭ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের পর আর ১০টি নবনির্মিত রাষ্ট্রের মতই ইজরায়েলের অর্থনীতি ছিল এক প্রকার খাদের কিনারায়। প্রতিষ্ঠার পর পরই ১৯৪৮ সালে প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ ইজরায়েলকে অর্থনৈতিক ভাবে অনেকটাই পেছনে ফেলে। এছাড়াও ইউরোপীয়  ও আরব দেশ গুলো থেকে আসা শরণার্থীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিলো ইজরায়েলকে।  

ঘুরে দাঁড়ানোর প্রথম ধাপ 

ইজরায়েলী অর্থনীতির প্রথম মোড়টি সৃষ্টি হয় ১৯৫২ সালে। সে সময় পশ্চিম জার্মানির সাথে ইজরায়েলের একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ইহুদী পরিবারসমূহের ফেলে যাওয়া সকল অর্থ-সম্পদ ও হলোকাস্টের ক্ষতিপূরণ হিসেবে পশ্চিম-জার্মানি ইজরায়েলকে বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫২-১৯৬৬, এই ১৪ বছরে জার্মানি ৭১৪ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ক্ষতিপূরণ দেয়। বর্তমান হিসেবে তা ৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এছাড়াও ৫০ এর দশকের শুরুর দিকে ইজরায়েলের সরকারি বন্ডে আমেরিকা ও কানাডিয়ান নাগরিকদের বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। মাত্র এক বছরের মাথাতেই সেই বিনিয়োগের পরিমাণ হয়ে দাঁড়ায় ৫০ মিলিয়নের অধিক। এছাড়াও বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের অনুদান পেতে থাকে রাষ্ট্র ইজরায়েল। ১৯৫৬ সালের দিকে যার পরিমাণ ছিল বছরে ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও অধিক। এই বিশাল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ, বিনিয়োগ ও অনুদানের কারণে ইজরায়েলের অর্থনীতি স্থিতিশীল হতে খুব একটা সময় লাগে নি। যদিও বলা বাহুল্য এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের সহোযোগিতা ছিল ব্যাপক। সে সময়ে ইজরায়েল ডায়মন্ড পলিশিং শিল্পের বিকাশ ঘটতে শুরু করে। পাশাপাশি গড়ে ওঠে পোষাক শিল্প। 

পতন 

ইজরায়েলের অর্থনীতির কালো অধ্যায়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত এর ক্রমাগত যুদ্ধংদেহী ইতিহাসের সাথে। ১৯৬৭ সালে মাত্র ৬ দিনে যুদ্ধজয়ী ইজরায়েলের অতি-আত্নবিশ্বাসী মনোভাব আত্নঘাতী হয়ে দাঁড়ায় ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে। তবে ১৯৭৩ সালের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধে প্রথমে অপ্রস্তুত থাকলেও শেষ অবধি দুই ফ্রন্টেই সামাল দিতে সক্ষম হয় ইজরায়েল। কিন্তু এর পরেই ধ্বস নামতে শুরু করে ইজরায়েলের অর্থনীতিতে। যা চূড়ান্ত রুপ ধারন করে ‘৮০ এর দশকে। ১৯৮৪ সালের দিকে ইজরায়েলের মুদ্রাস্ফীতি হয়ে দাঁড়ায় ৪৫০%। এর অন্যতম কারণ ছিল নিজস্ব মুদ্রার প্রতি ইজরায়েলী নাগরিকদের অনাস্থা। খোদ ইজরায়েলের ভেতরেই মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো ডলার। ফলে একদিকে যেমন ইজরায়েলী শেকেল মান হারাচ্ছিল, তেমনি সরকার হারাচ্ছিলো অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। বস্তুত ৮০ এর দশকের প্রথমার্ধ ছিল ইজরায়েলের অর্থনীতির সবচেয়ে কালো অধ্যায়। 

পুনঃউথান 

চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটাতে ১৯৮৫ সাল থেকে ইজরায়েলের সরকার বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। তার ভেতর অন্যতম ছিল ইজরায়েলী মুদ্রা বাতিল করে দেওয়া। তবে মুদ্রা বাতিল করলেও নতুন মুদ্রার নাম রাখা হয় নিউ ইজরায়েলী শেকেল। বস্তুত নতুন মুদ্রা গুলো ছিল পুরাতন মুদ্রারই হ্রাসকৃত নতুন রুপ। এছাড়াও সরকারি খরচ কমানো, এক্সচেঞ্জ রেট ঠিক করা সহ আরও নানা ধরনের অর্থনৈতিক সিধান্ত নেওয়া হয়। ইজরায়েলী সরকারের ক্রমাগত চেষ্টার ফলে ইজরায়েলী জনগণ ডলারের পরিবর্তে নিউ শেকেলের উপর আস্থা রাখতে শুরু করে। 

 

 

এ সময় আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ঘটে। ১৯৯১ সালের শেষ অংশে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। ফলস্বরুপ রাশিয়ার ইহুদী জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ ইজরায়েলের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে। আপাতদৃষ্টিতে এটি সমস্যাদায়ক মনে হলেও ইজরায়েলের জন্য এটি ছিল সাপে বর। কারণ ইহুদী রাশিয়ান জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ ছিল উচ্চপদস্থ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। ফলস্বরুপ তাদের কল্যাণে ইজরায়েলের অর্থনীতিতে বিশাল ইতিবাচক প্রভাব পরে। পরবর্তীতে পুরো ৯০ এর দশক জুড়েই ইজরায়েলে গড়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তি খাত। ২০০০ সালের পরে সেই খাতে কিছুটা আঁচ লাগলেও তা সামলে ওঠে ইজরায়েল। এছাড়াও এই পুরো সময় জুড়েই ইজরায়েলের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ পায়। ফলস্বরুপ ইজরায়েলের অর্থনীতি এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে ২০০৯ সালের বৈশ্বিক মন্দার সময়েও ইজরায়েল অনেকটাই কম ক্ষতির স্বীকার হয়। 

 

ইজরায়েলী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান 

লেখার প্রথম অংশটিতে মূলত ইজরায়েলী রাষ্ট্র ও এর অর্থনৈতিক ভিত্তি সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারনা প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে। ইজরায়েলের আজকের অর্থনৈতিক সক্ষমতা সৃষ্টি আসলে কিভাবে, সে সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারনা আশা করি পেয়েছেন। তবে বর্তমানে এর অর্থনৈতিক সক্ষমতার কথা বিবেচনা করলে কিছু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তথা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। 

১। ব্যাংক লিউমি (Bank Leumi) 

ইজরায়েলের অর্থনীতির সবচেয়ে প্রভাবশালী খাত গুলোর একটি ব্যাংকিং খাত। আর এসব ব্যাংকের গোড়াপত্তন ইজরায়েল রাষ্ট্রের পরে হয়েছে ভাবলে খুব ভুল করবেন। মূলত এসব ব্যাংকই ইজরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির পেছনের অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। তেমনই একটি ব্যাংক হলো ব্যাংক লিউমি। যার যাত্রা শুরু ১২০ বছর আগে লন্ডনে। সারা বিশ্বের ব্যাংকিং ব্যবস্থাতেই প্রভাব রাখা এই ব্যাংকটির ইজরায়েলে ২৭০টি শাখা সহ ১৭টি দেশে ১৯টি শাখা রয়েছে। কর্পোরেট ব্যাংকিং, কমার্শিয়াল ব্যাংকিং, রিটেইল ব্যাংকিং, ফিন্যান্সিয়াল ব্যাংকিং সহ সব ধরনের সেবাই দিয়ে থাকি ব্যাংকটি। বর্তমানে এর মার্কেট ভ্যালু ১২.০৭ বিলিয়ন ডলার। ব্যাংকিং খাতে প্রায় কাছাকাছি এরকম আরও কিছু মহারথীর নাম হলো ‘ব্যাংক হাপোলিম (Bank Hapoliam) এবং ‘মিজরাহী তেফাহত ব্যাংক‘ (Mizrahi Tefahot Bank)। 

 

২। তেভা ফার্মাসিউটিক্যাল (Teva Pharmaceutical) 

ফার্মেসির জগতে জেনেরিক ঔষুধ তৈরিতে সর্ববৃহৎ নাম তেভা ফার্মাসিউটিক্যাল। ইজরায়েলের এই প্রতিষ্ঠানটির ৩৬,০০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী ৬০টি দেশে সেবা দিয়ে থাকে। ব্যাংকিং লেউমির মতো এটির প্রতিষ্ঠাকালও ইজরায়েল জন্মের অনেক পূর্বে প্রতিষ্ঠিত। ১৯০১ সালে সৃষ্টি হওয়া প্রতিষ্ঠানটির ১৯টি দেশে ৪০টি উৎপাদন কারখানা, ২৮টি গবেষণাগার এবং ২১টি এপিআই ম্যানুফাকচারিং সাইট রয়েছে। সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ঔষুধ নিয়ে গবেষণা, উৎপাদন ও নিখুঁত বিপণন সক্ষমতা এদেরকে নিয়ে গিয়েছে আজকের অবস্থানে। প্রতিষ্ঠানটির মার্কেট ভ্যালু ৯.৭৪ বিলিয়ন ডলার। 

 

৩। চেক পয়েন্ট সফটওয়্যার টেকনোলজিস (Check Point Software Technologies) 

‘৯০ এর দশকে ইজরায়েলের প্রযুক্তি নির্ভর শিল্প গড়ে ওঠার অন্যতম উদাহরণ এই চেক পয়েন্ট টেকনোলজিস। ১৯৯৩ সালে সৃষ্ট ফার্মটির প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকের সংখ্যা ১ লক্ষেরও অধিক। যার ভেতর রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠান। আধুনিক ফায়ারওয়ালের জনক হিসেবে স্বীকৃত এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত সাইবার সিকিউরিটি টুল বিপণন করে থাকে। প্রযুক্তি খাত হওয়ায় এদের ব্যবসা ক্ষেত্র বিশ্বজোড়া। ৬,০০০ এর অধিক কর্মচারী সম্পন্ন এই প্রতিষ্ঠানটির মার্কেট ভ্যালু এখন ১৪.৬১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। 

 

৪। মোবাইল আই গ্লোবাল (Mobileeye Global) 

ইজরায়েলের আরেকটি প্রযুক্তি কোম্পানি এই মোবাইল এই গ্লোবাল। বর্তমানে ৩০.১৬ বিলিয়ন ডলার মার্কেট ভ্যালুর এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম ১৯৯৯ সালে। তবে পুরোপুরি সফটওয়্যার নির্ভর নয় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ভবিষ্যতের স্বয়ংক্রিয় গাড়ির প্রযুক্তির অন্যতম পথিকৃত বলা যায় এই প্রতিষ্ঠানটি। বিএমডব্লিউ, নিসান, হন্ডা, ভকসওয়াগন সহ আরও বিশাল সব গাড়ির কোম্পানির এই প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার যেটি, প্রতিষ্ঠানটি ইজরায়েলী হলেও আমেরিকার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ আইপিও (ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং) এর মালিক এই প্রতিষ্ঠানটি। এর মাধ্যমে ২০১৪ সালে আমেরিকার শেয়ার মার্কেট থেকে ৮৯০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করে মোবাইল আই গ্লোবাল। ২০১৭ সালে অবশ্য একে প্রায় ১৫ বিলিয়নের বিনিময়ে কিনে নেয় ইন্টেল। সব মিলিয়ে প্রযুক্তি খাতে এটি অন্যতম প্রভাবশালী একটি প্রতিষ্ঠান। 

 

৫। ইজরায়েল ডায়মন্ড এক্সচেঞ্জ লিমিটেড (Israel Diamong Exchange limited) 

ইজরায়েলের এবং সারা বিশ্বের সর্ববৃহৎ ডায়মন্ড পলিশিং কোম্পানির নাম ইজরায়েল ডায়মনড এক্সচেঞ্জ লিমিটেড। ইজরায়েলে হিরকের কোনো খনি না থাকলেও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডায়মন্ড পলিশিং শিল্প গড়ে উঠেছে ইজরায়েলে। ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের পূর্বেই এই কোম্পানির স্থাপন হয়। পরবর্তীতে ১৯৬০ এর দশক থেকে হয় এর উথান। বর্তমানে ইজরায়েলের সর্ববৃহৎ রপ্তানি পণ্য হলো পলিশ করা হিরা। পলিশিং এর জন্য হিরা যোগাড় করা হয় ইউরোপ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে। উচ্চ প্রযুক্তির সাহায্যে তা পলিশ করে আবার বিক্রি করা হয় আমেরিকা এবং ইউরোপেই। কোনো ধরনের খনিজ ভান্ডার ছাড়াই ইজরায়েল হয়ে উঠেছে এই ব্যাবসার সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়। 

 

 

ইজরায়েলের বহুজাতিক কোম্পানির তালিকা এই লেখায় যুক্ত করলে স্থান সংকুলান সম্ভব নয়। কিন্তু উপরের পাঁচটি কোম্পানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে বিশেষ কিছু কারণে। মূলত এই পাঁচটি কোম্পানি ইজরায়েলের অর্থনীতির কয়েকটি বিশেষ দিককে প্রতিনিধিত্ব করে। যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাকছে লেখার শেষ অংশে। 

 

ইজরায়েলী অর্থনীতিঃ শক্তি ও স্থায়ীত্বের কারণ

শত প্রতিকূলতার ভীড়েও ইজরায়েলের অর্থনীতি এতটা শক্তিশালী হওয়ার কারণ লুকিয়ে আছে তার প্রকৃতির ভেতরে। নিচে ইজরায়েলের অর্থনীতির কিছু নিজস্ব প্রকৃতি তুলে ধরা হলোঃ- 

১। সেবা ভিত্তিক অর্থনীতি 

জন্মলগ্ন থেকেই ইজরায়েল খনিজ সম্পদের দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো খনিজ সম্পদ না থাকায় পণ্য তৈরির কাঁচামাল তাদের আমদানি করতে হয়। আর ঠিক সেজন্যই ইজরায়েলের অর্থনীতি গড়ে তোলা হয়েছে মূলত সেবা খাতের উপর ভিত্তি করে। ব্যাংকিং থেকে শুরু করে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট, সব কিছুতেই ইহুদীদের প্রভাব শতবর্ষী। আর ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে সেই প্রভাবটাও পৌছে গেছে ইজরায়েলের নাগরিকদের হাতে। এছাড়াও ইজরায়েলের অন্যান্য খাত গুলোও যতটা না পণ্য কেন্দ্রিক, তার চেয়ে অনেক বেশি সেবা কেন্দ্রিক। 

২। প্রযুক্তি নির্ভর অর্থনীতি 

পণ্যে তৈরির জন্য যেমনটা কাঁচামালের প্রয়োজন, ঠিক তেমনি পণ্য পরিবহনের জন্য প্রয়োজন নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা। কিন্তু ইজরায়েলের আশে পাশের একটি দেশের সাথেও এর বন্ধুভাবাপন্ন সম্পর্ক নেই। ফলস্বরুপ তাদের অর্থনীতি এমন ভাবেই গড়ে উঠেছে যাতে প্রতিবেশীর সীমান্তের উপর নির্ভরশীল হতে না হয়। আর তাই বর্তমানে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় খুব কম দেশই ইজরায়েলের সমকক্ষ। উপরে উল্লিখিত চেক পয়েন্ট টেকনোলজিস এর মতো একাধিক প্রতিষ্ঠান সারা বিশ্বজোড়া সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আর পুরো প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে অনলাইনে। এমনকি জনপ্রিয় ফ্রিল্যান্সিং প্রতিষ্ঠান ফিভারও একটি ইজরায়েলী প্রতিষ্ঠান। 

৩। রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট 

ইজরায়েলী অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্ভবত এই অংশটি। পৃথিবীর এমন কোনো বৃহৎ কোম্পানি নেই যেটি কোনো না কোনো ভাবে রিসার্চ অথবা প্রডাক্ট ডেভলপমেন্টের জন্য ইজরায়েলের উপর নির্ভরশীল নয়। ইন্টেল, অ্যাপল, ব্ল্যাকবেরি, অটোডেস্ক, তোশিবা, বার্ক্লে, ইউনিলিভার, সিসকো, ডেল, ড্রপবক্স, ইবে, মেটা, গুগল, জেনারেল মটরস, এইচপি, হুয়াওয়ে, আইবিএম, আলিবাবা, আমাজন, ফুজিতসু, এলজি, মারভেল, মাইক্রোসফট, মটোরোলা, নেসলে, নোকিয়া, পেপ্যাল, এনভিডিয়া, পেপসিকো, ফিলিপ্স, কোয়ালকম, স্যামসং, সিগেট, সিমেন্স, শাওমি, ইয়াহু, জেরক্স, ফাইজার, মাস্টারকার্ড, ক্যাসপারেস্কি, থেলস, হন্ডা থেকে শুরু করে ৪০০ এরও বেশি বিশ্বখ্যাত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠনের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট সেন্টার ইজরায়েলে। ইজরায়েলি জনগোষ্ঠী এতটাই দক্ষ যে, প্রায় সকল বড় বড় বহুজাতিক ব্র্যান্ডই প্রডাক্ট / সার্ভিস ডেভেলপমেন্ট এর জন্য তাদের কাজে লাগিয়ে থাকে। 

 

৪। বিদেশী বিনিয়োগ 

ইজরায়েল রাষ্ট্রের শুরু থেকেই প্রচুর পরিমাণে বিদেশী বিনিয়োগ পেয়ে আসছে। এর জন্ম লগ্নের পর পরই জার্মানি থেকে পাওয়া ক্ষতিপূরণ তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত করে। এছাড়াও ইজরায়েলী সরকারের ব্যবসাবান্ধব নানা নীতির কারণে পুরো ৯০ এর দশক এবং ২০০০ এর দশক জুড়ে প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছে ইজরায়েলে। এছাড়াও এক দেশের সরকারি বন্ড অন্য দেশের নাগরিকদের ক্রয় করার খুব বেশি উদাহরণ নেই। কিন্তু এই কাজটিই সফল ভাবে করতে পেরেছিলো ইজরায়েল। ফলে আমেরিকা ও কানাডার বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ পায়। এছাড়াও সকল ধরনের রিসার্চ সেন্টার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানে বিদেশী বিনিয়োগ এখনো চলমান।

৫। ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস (Value Added service) 

আধুনিক অর্থনীতিতে একটি দেশ বা একজন উৎপাদক কতটুকু সফল তার নির্ভর করে সে একটি পণ্যে কতটুকু ভ্যালু যুক্ত করছে। সহজ ভাষায়, সে একটি পণ্যের ব্যবহারযোগ্যতা বা উপযোগিতা কতটুকু বাড়িয়ে তুলছে। তার কাঁচামাল হিসেবে প্রাপ্ত পণ্য এবং তার প্রস্তুতকৃত পণ্য, এই দুইটির মধ্যকার উপযোগিতার যে পার্থক্য তাকেই মূলত বলে অ্যাডেড ভ্যালু তথা সংযুক্ত উপযোগ। ইজরায়েলের অর্থনীতির অন্যতম দিক হলো এই ভ্যালু আডেড সার্ভিস। যদি তাদের ডায়মন্ড পলিশিং ইন্ডাস্ট্রিকেই উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়, তাহলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ডায়মন্ডের আসল মূল্যটা আসলে তখনই পাওয়া যায় যখন সেটি বাজারে একটি সুন্দর রুপে বিক্রী করা যায়। খনি থেকে তোলা আকাটা হিরার থেকে পলিশকৃত হিরার মূল্য অনেক বেশি। আর ঠিক এই বিষয়টিই কাজে লাগিয়ে ইজরায়েল আজ প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিশ্ব বাজার থেকে আয় করছে। একই রকম ভাবে ইজরায়েলের অর্থনীতির বেশির ভাগ খাতই অনেক বেশি উপযোগিতা যুক্ত করতে সক্ষম। 

৬। বিদেশী সাহায্য ও অনুদান

ইজরায়েল রাষ্ট্রের সফলতার পেছনের সবচেয়ে বড় অবদান এর নাগরিকদের থাকলেও, বিদেশী সাহায্যের অবদান অবহেলা করার সুযোগ নেই। বস্তুত সারা বিশ্বের প্রভাবশালী ইহুদীরা এক হয়ে বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করেই ইজরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছিলো। আর সেই প্রভাবের ধারা এখনো অব্যাহত আছে। ইজরায়েলের মতো সহায়তা কোনো দেশই আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে পায় নি। শুধু এক আমেরিকা থেকেই ইজরায়েল আজ অবধি ৩১৭.৯ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য পেয়েছে। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে থাকা প্রভাবশালী দ্বৈত-নাগরিকত্ব সমৃদ্ধ ইহুদী ব্যক্তিবর্গেরও রয়েছে ইজরায়েল রাষ্ট্রে বিশাল বিনিয়োগ ও অনুদান। সব মিলিয়ে ইজরায়েলের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো এবং স্থিতিশীল থাকার পেছনে ভিনদেশের যে বিশাল অবদান রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। 

শেষকথা

ইজরায়েলের অর্থনীতি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি গুলোর একটি। বিশেষত তাদের নিকট প্রতিবেশীদের তুলনায় প্রায় প্রতিটি অর্থনৈতিক সুচকেই তাদের অবস্থান অনেক আগানো। এরকম প্রতিকূল পরিবেশে এমন অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং রক্ষা করা দুটিই কঠিন কাজ। দুঃখজনক ভাবে তাদের বৃদ্ধির সাথে জড়িয়ে আছে লক্ষ মানুষের দীর্ঘশ্বাস। তবে অর্থনৈতিক দিক থেকে ইজরায়েলের উন্নতি যে ঈর্ষণীয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

Previous Post

Next Post

Related Posts

ট্রাম্পের জয়ঃ বাংলাদেশের জন্য স্বস্তি নাকি আশংকা?

24-11-2024

International

ট্রাম্পের জয়ঃ বাংলাদেশের জন্য স্বস্তি নাকি আশংকা?

আধুনিক পৃথিবীতে যে নির্বাচনটি বিশ্বের উপর সবচেয়ে বেশি...

Read More
বাংলাদেশ-আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) সম্পর্কঃ অর্থনীতি...

21-11-2024

International

বাংলাদেশ-আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) সম্পর্কঃ অর্থনীতি...

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) বিশ্বের অন্যতম প্রধান...

Read More
মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলার নেতৃত্ব এবং তার...

14-11-2024

International

মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলার নেতৃত্ব এবং তার...

সত্য নাদেলা মাইক্রোসফটের সিইও হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের...

Read More

Trending

About MAWblog

MAWblog strives to provide a platform for authors, reporters, business owners, academics, people who do writing as a hobby and concerned citizens to let their voices be heard by a wider community. Our goal is to publish contents that are in line with our core goals of promoting sustainable business practices, improving community harmony and facilitating knowledge sharing and ethical labour market practices.

We invite you to write and publish under any of our nine chosen categories and make an impact towards building a better and more sustainable future.

Sign Up for Our Weekly Fresh Newsletter