ব্রেকআপ
Winner of the week based on Popular Vote (07.10.21)
বেথ আর আমি একসাথে চায়নাতে কাজ করেছি! গত বছরের শেষের দিকে চায়নাতে হটাৎ এক দুর্ঘটনায় বেথ আহত হয় এবং জরুরি অবস্থায় সেখানে তার একটা জটিল সার্জারি করতে হয়! যেহেতু আমার মতো সেও লন্ডন থেকে চায়নাতে পোস্টিং এ গিয়েছিলো তাই তার পরিবার বা বন্ধু কেউ ছিল না সেখানে! তার প্রেমিকও ইংল্যান্ডে ছিল তখন! লন্ডনেই ভালো একটা ইংলিশ কোম্পানিতে কাজ করতো তার প্রেমিক! ওরা দুজনেই পয়সা জমাচ্ছিলোও, আগামী বছর ওদের বিয়ের জন্য! বিয়ে নিয়ে ওদের অনেক পরিকল্পনা ছিল! অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বেথ মাঝে মাঝে আমার সাথে গল্প করতো ওর বিয়ের পরিকল্পনা, ওর কল্পনার সংসারের কথা, কল্পনায় চাওয়া ওর বাচ্চাদের কথা! আমি পাশের চেয়ারে বসে বসে শুনতাম! তারপর আমরা দুজনেই একসাথে খুব হাসতাম তার কল্পনার সেইসব ঘর সংসার নিয়ে!
বিদেশের যেহেতু পরিবার, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুরা সাথে থাকে না তাই সুখে দুঃখে কলিগরাই একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়ায়! বেথের অসুস্থতার সময় আমি তার পাশে ছিলাম! চায়নাতে অনেক দিন হাসপাতালে থাকার পর হাসপাতাল থেকে সে যখন বিদায় নিচ্ছিলো সেদিন হাসপাতালের মানুষরা প্রথম জানতে পারে যে আমি বেথের আত্মীয়ও না, কলিগ! হাসপাতালের স্টাফদের সেই অবাক হওয়া দেখে আমি খুব হেসেছিলাম সেদিন!
চায়নাতে অপারেশন হবার পর বেথ ফিরে আসে ইংল্যান্ডে তার ছুটি কাটাতে! তারপর বেশ কিছুদিন ছুটিতে সে ইংল্যান্ডেই ছিল! কিছুদিন তার মায়ের সাথে, কিছুদিন তার বোনের সাথে, কিছুদিন তার খালার সাথে! বেথের সাথে হোয়াটস্যাপ এ আমার যোগাযোগ ছিল! টাইম ডিফারেন্স আর আমার ব্যস্ততার জন্য কথা হতো না তেমন একটা কিন্তু ছোট ছোট টেক্সট আদান প্রদান হতো নিয়মিত! একসময় তার ছুটি শেষ হলো, সে পুরোপুরি সুস্থ এখন! ফিরে যাবার সময় হয়েছে তার চায়নাতে!
এদিকে আমি চায়নার কাজ শেষে ফিয়ে এসেছি লন্ডনে!
কিছুদিন আগে বেথ আমাকে টেক্সট করে জানালো তার চায়না ফিরে যাবার তারিখ এবং সাথে এটাও বললো যে চায়না ফিরে যাবার আগে সে আমার সাথে একবার দেখা করতে চায়! আমি খুশি হয়ে বললাম, চলো একসাথে লাঞ্চ করি! তোমার কোনো পছন্দের রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে গল্প হবে! কথা মতো রবিবার দুপুরে সেন্ট্রাল লন্ডনে ওর পছন্দের এক লেবানিজ রেস্টুরেন্টে গেলাম ওর সাথে দেখা করতে!
ছুটির দিন দুপুর তারপর আবার সেদিন রোদ ছিল! রোদ দেখলে এমনিতেই লন্ডনের সব মানুষ ঘরের বাইরে বের হয়ে যায়! আর ছুটির দিন হলেতো কথাই নাই! সেদিনও শহরে সব জায়গায় ভিড়! বেথ অবশ্য আগেই রেস্টুরেন্ট এ টেবিল বুক করে রেখেছিলো! আমি আগে পৌঁছে, রেস্টুরেন্টের বাইরে রোদের মধ্যে সুন্দর একটা টেবিল বের করে সেখানে বসলাম! বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হয়নি, কিছুক্ষনের মধ্যেই সে এসে পৌঁছালো! অনেক দিন পর পুরোপুরি সুস্থ বেথকে দেখে খুব ভালো লাগলো!
লেবানিজ ওয়েটার মেনু নিয়ে এসে জানতে চাইলো আমরা কি খাবো! আমরা মেনু দেখলাম না! মেনু না দেখেই বেথ আর আমি বললাম, তোমাদের মেনুর সবচেয়ে মজার দুইটা ডিশ নিয়ে এসো আমাদের জন্য সাথে মেনুর সবচেয়ে মজার দুইটা ড্রিঙ্কস! ওয়েটার অবাক হয়ে আমাদের কথা শুনে হেসে 'ওকে' বলে চলে গেলো!
আমি ছোট দুইটা গিফট নিয়ে গিয়েছিলাম সাথে! একটা বেথের জন্য আরেকটা তার প্রেমিকের জন্য! আমি ব্যাগ থেকে গিফটের প্যাকেট দুইটা বের করে ওকে দিলাম! বললাম, এটা তোমার আর এটা তোমার হবু বরের জন্য! সে হেসে ধন্যবাদ দিয়ে শুধু তার গিফটের প্যাকেটটা হাতে নিলো! তারপর হাসি মুখেই বললো, তার হুবু বরের সাথে তার বিয়েটা হচ্ছে না! তাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে! ছেলেটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে!
ছোট টেবিল এ বেথ আর আমি মুখোমুখি বসা! সে তার গিফটটা হাতে নিয়ে গিফটের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে! তার চোখে পানি! আমি ঠিক কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না!
কিছুক্ষন পর সে নিজেই জানালো তাদের সম্পর্ক ভেঙে যাবার কারণ! ছেলেটা চেয়েছিলো বেথ তার পোস্টিং ছেড়ে, তার এই চাকরি ছেড়ে লন্ডনে ফিরে আসুক! এখানে এসে অন্য কিছু করুক! বেথ রাজি হয়নি! এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয় কিন্তু কেউ কাউকেই বুঝাতে পারেনি এবং শেষ পর্যন্ত দুজনে মিলে সম্পর্কটা শেষ কৰার সিদ্ধান্ত নেয়!
কিছুক্ষন আমরা দুজন চুপ করে মুখোমুখি বসেছিলাম!
তারপর আমি বেথকে বললাম, আমাদের জীবনে সবকিছু আছে, সবাই আছে তারপরও পৃথিবীতে আমরা সবাই আসলে একা! আমাদের হাসি বা কান্নায় অন্য কারো জীবন থেমে যায় না! আমাদের মনে কি আছে, আমাদের মাথায় কি চিন্তা চলে, আমাদের জীবনে কি হচ্ছে তাতে অন্য কারো জীবনে কিছু আসে যায় না! মানুষ হয়তো আমাদের সুখে হাসে, দুঃখে দুঃখিত হয়, আমাদের সহানুভূতি জানায় অথবা আমাদের জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে গল্প করে! এইতো! কেউ এসে কিন্তু তোমার জীবনটা যাপন করে দিবে না! তোমার জীবন তোমাকেই যাপন করতে হবে! ফেলে আসা জীবন, চলে যাওয়া দিনের কথা মনে রাখবে, মনে হলে অবশ্যেই ফিরে তাকাবে পিছনের জীবনে! একসময় দেখবে তোমার ঠিকই মনে হবে যে এই বিচ্ছেদটা তোমাকে আগের চেয়ে শক্তিশালী বানিয়েছে! হয়তো এই বিচ্ছেদটা তোমার জীবনে দরকার ছিল! প্রকৃতি কারণ ছাড়া কিছু করে না! আমরা প্রকৃতির কারণগুলো বেশিরভাগ সময় ঠিক বুঝতে পারি না! তাই জীবন এতো এলোমেলো লাগে! You should not have to rip yourself into pieces to keep others whole! চেষ্টা করো নিজের জন্য বাঁচতে!
বেথ চোখ মুছতে মুছতে ব্যর্থ হাসির চেষ্টা করে বললো, এইজন্যেই তোমার সাথে এই দেখে হওয়াটা খুব প্রয়োজন ছিল আমার!
(জীবন থেকে নেয়া সত্যি ঘটনা)
ব্রেকআপ || Saikat
Saikat is an undergraduate student of final year and a reader by hobby.