জীবনের গল্প
Winner of the week based on Popular Vote (30.09.21)
অদ্ভুত এক অস্বস্তি নিয়ে আমি মায়ের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। যতটা সম্ভব মনটাকে ফুরফুরা করে কৃত্রিম হাসি দিয়ে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর মায়ের মনঃ পুত হয়, এমনভাবেই অভিনয়টা করে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে আমি মায়ের এইসব উদ্ভুট কথাবার্তায় ভাবি মাকে, একটা ভালো সাইক্রিয়েটিস্ট এর কাছে নিয়ে যাবো। কারণ, বড় হওয়ার পর মায়ের আচার-আচারণ কখনই স্বাভাবিক মনে হয়নি আমার কাছে। এইতো সেদিন মায়ের বাসায় গেলাম, মায়ের সাথে আলাপের এক পর্যায়ে মা আমাকে বলল- কিরে তোর জামাই কি তোর সাথে ঠিকমত থাকে না সাদিয়া?
মাথার উপর বাজ পড়ার মত ধড়াক করে উঠি আমি, নিজেকে যতটা সংযত করা প্রয়োজন করে উত্তর দিই- এটা কি ধরণের প্রশ্ন মা।
- কি খারাপ কইছি? তোর জামাইরে বিয়ের পর থেকেই দেহি মুখ গোমড়া করে বসে থাকতে, কোন রোমান্টিক ভাব দেহিনা।
- রোমান্টিকতা কি সবার সামনে দেখাবে।
- তুই রাগ করিস কেন? শোন তোর বাপে আজও অব্দি এক বিছানায় এক বালিশ ছাড়া ঘুমায়নি। আমরা সব সময় একটা বালিশে দুইজন মাথা দিয়া ঘুমাই। এই বয়সেও
- এক বালিশে ঘুমালে রোমান্টিক হয় কোন কিতাবে লিখা আছে মা?
- ধুর তোর লগে কথা বলাটাই আমার ভুল হইছে।
এইধরণের উদ্ভুট কথা শুনতে শুনতে সাদিয়া এখন বিরক্ত। সে জানে তার মা অনেক সহজ -সরল, জীবনে সে প্রিয়জনদের কাছ থেকে যে অবজ্ঞা, অবহেলা, আঘাত পেয়েছেন তাতে যে উনি এখনও বেঁচে আছেন তাইই অনেক। কিন্তু এখন ত বয়স হচ্ছে মায়ের, মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিছেন, এখন তো নিজের পারসোনালিটি বজায় রাখতে হবে তাই না। ইচ্ছে করলেই বেফাস কথা বলতে পারবে না। কিন্তু বাবার কারনে মাকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে পারছিনা। বাবার ধারণা এতে উনার মনের উপর বিরুপ প্রভাব পড়বে। হয়তো সে ভাববে আমরা তাকে পাগল ভাবছি।
আমার মা, সফরা বেগম, হঠাৎ আমার শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে আসছেন। আমি মাকে আমার শ্বাশুড়ির রুমে বসিয়ে চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে রান্নাঘরে গেলাম। ওমা একটু পর মা রান্নাঘরে ঢুকলেন। মিটসেফ খুলে রান্না করা প্রতিটি তরকারি চেক করলেন। আমি আমার মায়ের পিছনে দাঁড়িয়ে মায়ের কমেন্টস শুনছিলাম আর প্রয়োজনে উত্তর দিচ্ছিলাম।
- "সাদিয়া, কি রান্না করছস, মাছ ভুনার মধ্যে জিরা দিবিনা, ছি মাছে কেমন আশঁটে গন্ধ লাগতাছে।"
- "মা, তোমার জামাইয়ের পরিবারের কেউ মাছে জিরা খায়না। আমার শ্বাশুড়ি তো খেতে পারেনা। ওদের কাছে মাছে আশঁটে আশঁটে গন্ধ না করলে মাছ মনে হয়না তাই।"
- "আচ্ছা বুঝছি। শুটকির তরকারিতে এক ফোঁটা তেল না দিলে মজা হইবনি হু।"
- "মা, ওরা শুটকির তরকারিতে তেল পেয়াজ ব্যবহার করে না। শুধু রসুন, কাঁচা মরিচ, হলুদ গুড়া দেয়।"
- "এডা দি পুইড়া লাইছস রে, সাদিয়া।"
- "মা আমারে এইভাবেই রান্না করা শিখাইছে শ্বাশুড়ি। শুটকিটারে পানি শুকাইয়া পোড়া পোড়া হবে।"
- "হ বুঝচ্চি, নিজের ঐতিহ্য ভুইলা গিয়া শ্বশুড়বাড়ির রান্না আয়ত্ব করছস। ভালা।"
- "মা তুমি তো জীবনে আমারে রান্নাঘরেই যেতে দাওনি, খালি পড়াশুনা করাইছ, এখন সেই বিদ্যা পুড়িয়ে রান্না করি। খারাপ কি!"
- "হ, তাও ঠিক, মেয়ে মানুষ বিয়ে তো দিতেই হবে, এত কষ্ট করে লালন পালন করে অন্যের ঘরে দিয়ে দিতে হয়।" কথাগুলো কিছুটা আবেগে বলে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে সফুরা বেগম। "তা ডালের মধ্যে গরম মশলা তেজ পাতা দিছুস যে, ডালে জিরা, পিয়াজ, রসুন, দিয়া ফোঁড়ন না দিবি। এইডি খাস।"
আমি প্রায় হয়রান জবাবদিহি করতে করতে। তারপরেও মা বলে কথা। মায়ের অবদান তো আমরা ভাই-বোন ভুলতে পারবনা। বাবার স্বল্প আয়ের সংসার ছিলো, মা ছিলেন কোটিপতির ঘরের একমাত্র আদুরে মেয়ে, বলতে গেলে অনেকটা সাত ভাই চম্পা টাইপ। প্রেম করে ক্লাস নাইনেই শিক্ষকের সাথে পালিয়ে যায়, আর ফিরেনি নিজের পরিবার-পরিজনের কাছে। উনারাও নিজের মেয়েকে সমাজে চুনকালি মাখানোর জন্য ত্যাজ্য কন্যা করে দিয়েছিলেন। কোন খোঁজ -খবর রাখেননি। অনেক বছর পর হঠাৎ মার সাথে উনার বড় ভাইয়ের দেখা হয় আমাদের বাসার নিচে। সরু গলির ভিতর দুই রুমের বাসা। ঘনবসতি এলাকা বলে বাসা ভাড়া কম। কোন একটা কাজে উনি এদিকে এসেছিলেন। সফুরা বেগম ভাইকে দেখে আবেগে দৌড়ে উনার কাছে এসে কান্না করে মাফ চাইলো তার অপরাধের জন্য। আমরা তখন তিন ভাই-বোন। দুই ছেলের পর মেয়ে সাদিয়া আমি। অনেক কষ্টের সংসার মা-বাবার। ক্লান্ত শ্রান্ত যুদ্ধরত এক নারী, চেহারার সেই আভিজাত্য, লাবন্য আর নেই উনার। এত বছর পর দেখা ভাইয়ের সাথে মা কই সুখ দুখ ভাগ করে নিয়ে সব ভুলে যাবে - তা নয়- তার ভাই কিছু না বলেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়, মা চা নাস্তা এনে ভাইকে না দেখে চোখ দিয়ে পানি ফেলতে থাকেন। হঠাৎ কিছু বুঝে উঠার আগেই উনার ভাই এক চাপাতি নিয়ে এসে রুমে ঢুকে মায়ের অপরাধের জন্য তার ডান হাতের চারটি আঙুল চাপাতির এক কোপে কেটে দিছিলো। মা একটুও টু শব্দ করেনি। সে এটা তার অপরাধের শাস্তি হিসেবে মেনে নেয়। শুধু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলো ভাইয়ের সামনেই। তখন আমি কোলের শিশু। সন্তানদের চোখের সামনে সফুরার আঙুল কেটে চলে যান তার ভাই। আমাদের তিন-ভাইবোনের চিৎকারে সেদিন আকাশের নীল বর্ন কালো মেঘে আছন্ন হয়ে গিয়েছিলো। চারিদিকের পরিবেশ থম থমে ছিলো কিছুক্ষণের জন্য। আশেপাশের মানুষজন দৌড়ে মাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আরমান সাহেব মায়ের এই অবস্থা দেখে হতভম্ব। মায়ের এই কষ্টের জন্য বাবা ক্রমান্বয়ে নিজেকে দোষারোপ দিতে থাকে। সেদিন মায়ের জ্ঞ্যান ঠিকই ফিরে আসে, কিন্তু উনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলেও উনার আচার-আচারণ শিশু বাচ্চাদের মত হয়ে গেছিলো। তার কথাবার্তায় যথেষ্ট অস্বাভাবিকতা দেখা দিলেও আরমান সাহেব তা কখনই সফুরা বেগমকে বুঝতে দেয়নি, বরং আরমান সাহেব তার পরিবারকে একটু গুটিয়ে নিয়েছিলো সবার থেকে। কিন্তু বাকি জীবন এই আঙুল ছাড়াই সংসার যুদ্ধে লড়ে গেছেন সফুরা বেগম। এখন আমার বড় ভাই চাকরি করে আর ছোট ভাইটা বিবিএ কমপ্লিট করেছে। করোনার প্রকোপের জন্য পড়াশুনা বন্ধ। আমাকে বিয়ে দিয়ে দিছেন। এখন ছেলের বিয়ের জন্য বউ খুছঁছেন মা। বলতে গেলে উনি এখন তার স্বামীর এক খন্ড জমিতে একতলা দালানে সুখের নীড় রচনা করেছেন।
আমার বাবা আরমান সাহেব খুব ভদ্র ও মার্জিত টাইপ লোক, সেই ঘটনার পর থেকে মায়ের কোন বিষয়েই উনি কখনই উচ্চবাচ্যই করেনি। কারন একটাই, যে মানুষটা ভালোবাসার মানুষের জন্য সব সুখ বিসর্জন দিয়ে অপরাধের শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছিল তার কোন পাগলামিই তার কাছে পাগলামি নয়। আমি ছোটবেলা থেকেই বাবার মায়ের প্রতি এই কৃতজ্ঞতাটুকু দেখে আসছি। তাই আমিও কখনই মায়ের আচমকা অপ্রাসঙ্গিক কথায় বিরক্ত ভাব দেখাই না। কারন আমি জানি আমার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা, যেকিনা জীবনে নিজের প্রানপ্রিয়দের কাছ থেকে এত বড় নিষ্ঠুরতা পরিচয় পেয়েও কখনই তাদের দোষারোপ করেননি। আমার ধারণা ভাইয়ের বোনের প্রতি এই নিষ্ঠুরতা মাকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে দিছে বেশ। তাই মা কোন পরিস্থিতিতে কি বলছেন কিছুই বুঝিতে পারেনা এখন।
আজ হাসপাতালে সফুরা বেগমের তৃতীয় দিন। উনার করোনা পজেটিভ। করোনার পর পর দুইবার স্ট্রোক করলো। ব্রেন হেমারাইজ হওয়াতে আইসিউতে নেয়া হয়েছিলো। একটু ভালো হওয়ার পর ডাক্তার তাকে বেডে নিয়ে যেতে বলেন। সকালের দিকে বেশ ভালোই ছিলেন মা। তার করোনা পজেটিভ থেকে নেগেটিভও হয়ে গেছেন। কিন্তু কখন যে করোনার কারনে তার নিউমোনিয়া হয়ে ফুসফুসে পানি জমে গেছে তা কেউ বুঝতে পারেনি। বাবার বয়স হয়ে গিয়েছে, উনি একা কি করতে পারেন! হঠাৎ বিকালের পর থেকে মা কাউকে চিনতে পারছেন না। আমি মায়ের হাত ধরে বসে আছি। মাও যেন তার আঙুলবিহীন হাতটা খুব শক্ত করে আমার হাত মুঠো করে ধরে রাখছেন টানা চারঘন্টা। আমি সফুরা বেগমের সাথে তার মজার স্মৃতিগুলো রোমন্থন করছিলাম। কিন্তু সেই মুহুর্তে কোন রেসপন্স পাচ্ছিলাম না উনার কাছ থেকে। শুধু দুই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে উনার। আমি আপ্রান চেষ্টা করছি নিজেকে কন্ট্রোল করার। মায়ের অবস্থা অবনতির ফলে আমার দুই ভাই, আমার বর ডাক্তার নার্স ডাকতে ছটাছুটি করছে। এদিকে বাবা মায়ের বিছানার আরেক পাশে বসে কোরআন শরীফ পড়ে ফুঁ দিচ্ছে সারা শরীরে। বাবার অনুভুতিটা এমন যেন মা বাবাকে একা ছেড়ে কখনই যাবেন না। আমার ভেতরের কান্নাটা যেন বুক ফেঁটে বের হয়ে আসছে, "মা, তুই কথা বল, যা মন চায় তুই বল, যত পাগলামি কর, তারপরেও তুই কথা বল মা আমি একছিটেও বিরক্ত হবো নারে, মা।"
জীবনের গল্প || Aysha Zannat
Aysha Zannat is a 3rd year honours student of Mirsarai Degree College, Mirsarai, Chattogram. Her hobby is writing.