টিউশন
Winner of the week based on Popular Vote (23rd September 2021)
আন্টিকে ফোন করে জানালাম, রাব্বিকে আর পড়াতে যেতে পারব না। রাব্বিকে আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই পড়াচ্ছি।আমি এখন ৪র্থ বর্ষে, রাব্বি ক্লাশ টেনে।
রাব্বি একমাত্র সন্তান তাদের। বিত্তশালী পরিবার। রাব্বির বাবা একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আমার বাবা একজন কৃষক। আমি বড় হয়েছি মোটা চালের ভাত খেয়ে। আমার পরিবার এখন চিকন চালের ভাত খায় তবে তা আর বোধয় সামনে থেকে হচ্ছে না।
যাই হোক আন্টি আমার পড়াতে না পারার কথা শুনে যেনো, আকাশ থেকে পড়লেন।
উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন:
—বলো কি রাসেল! সামনেই ওর পরীক্ষা আর তুমি ওর পুরোনো টিচার, তুমি যদি এতদিন উধাও থেকেও এখন এসব বলো তাহলে কিভাবে হয় বলো?
আমার চোখে ততোক্ষণ এ জল জমেছে। খবর টা কিভাবে দেই তাকে! নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে।
নিজেকে সামলে, বললাম কারণটা:
—আন্টি আসলে বিষয়টা হচ্ছে আমি অনেক টিউশন ই হেটে করাতাম। রাব্বিকে পড়াতেও হেটে যেতাম। সেই হাটার ক্ষমতাটুকু এখন আর নেই আমার। আমার ডান পা টা কেটে ফেলতে হয়েছে। আর আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত, এতদিন টিউশনে না আসার ব্যপারটা একটু দেরি হয়ে গেলো জানাতে।
আন্টি বেশ উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করলেন:
—বলো কি বাবা? কিভাবে হলো এমনটা?
আমি ঘটনাদি বলতে থাকলাম:
—সেদিন আংকেল এর থেকে বেতন টা পেয়েই, আমি সোজা চলে যাই নীলক্ষেত। ইচ্ছে ছিলো চাকরির পরীক্ষার জন্য এক সেট বই কিনবো। প্রায় দুইহাজার টাকার বই আর নিউমার্কেট হতে আব্বা আর আম্মার জন্য জামাকাপড় কিনে এক বন্ধুর মেসের দিকে ফিরছিলাম। সে আমার এলাকার বন্ধু, পরেরদিন ওর এলাকায় যাওয়ার কথা। বাবা মায়ের জামাকাপড় ওকে দিয়ে পাঠাতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু রাস্তায় এক্সিডেন্ট এর শিকার হলাম। এতগুলা বই আর জামাকাপড় নিয়ে লোকভর্তি লোকাল বাসে ঠেলাঠেলি করে উঠতে গিয়েই, বাস ছেড়ে দেয়, আমি ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাই। চাকাটা চলে যায় ডান পায়ের উপর দিয়ে, বাম পাটা বেচেঁ যায় কোনরকম।
আমি আর কথা বাড়াতে পারিনা, কন্ঠ ধরে আসে।
আন্টি দরদমাখা কন্ঠে বলেন:
—অন্য ২টি টিউশন, তাদের জানিয়েছ বাবা? আর তুমি, আগে জানাবে না? এই বিপদে আমরা তোমার পাশে থাকতে পারলাম না। কোন হাসপাতালে আছো?
আমি জানি, শুনলেই তারা সবাই চলে আসবে দেখতে আমাকে তাই আমি একটা মিথ্যা বললাম:
—গ্রামের বাড়ি চলে আসছি আন্টি (যদিও তখনো আমি ঢাকা মেডিকেল এ আছি।) একটু সুস্থ হলেই হলে ফিরব।
আন্টি একটু ধমকের সুরেই বললেন:
—ঢাকা আসলে অবশ্যই জানাবে কিন্তু। আর কোন কিছুর, সমস্যা হলে মুখ ফুটে জানাবে। রাব্বিকে এতদিন পড়িয়েছ তুমি, তোমার ভাইয়ের মতই। তুমি তাই আমার সন্তানেরই মত বাবা।
কথা গুলো আমার মনে প্রশান্তি এনে দিলো। কতশত সম্পর্ক ইদানীং নাকি ভেংগে যায় আর আমি কিনা শুধু ছাত্র পড়িয়ে এত সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে ফেলেছি যা যেন এই পংগু জীবনেও প্রাপ্তি আর আশির্বাদ।
আমি আন্টিকে বললাম:
—আন্টি আমার খুব খারাপ লাগছে। রাব্বি কে বলবেন পড়াশোনায় কোন সমস্যা হলে যেনো আমাকে ফোন দেয়!
এভাবে কথোপকথন টি শেষ হয়.....
এরপর প্রায় ১ মাস পরের কোন এক রবিবার বিকাল ৫টা। যে সময়ে রাব্বিকে পড়ানোর জন্য বের হতাম।
আমি তখন হলে, ভাগ্যগুণে আমার রুমমেট তিনজন বেশ সুহৃদ তারা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করছে। আমি এখন ক্রাচে ভর করে চলাফেরা করতে পারি।
যাইহোক ফোন নাম্বার টা অচেনা, ফোন টা ধরলাম।
—আসসালামু ওয়ালাইকুম, হ্যালো, আপনি কি রাসেল ভাই বলছেন।
—ওয়ালাইকুম আসসালাম, হ্যা রাসেল বলছি। আপনি কে?
—আমি ড্রাইভার বশির, বিথী আপা আমারে পাঠাইছে, আপনারে নিয়ে যাইতে।
—আমারে কোথায় নিয়ে যাবে?
—রাব্বি ভাইকে পড়াতে যাবেন চলেন
আন্টির ফোন আসে তখন...
—হ্যালো, রাসেল। বাবা এখন হতে প্রতি সপ্তাহে তিনদিন গাড়ি চলে যাবে তোমার হলে। তুমি সোজা চলে আসবে রাব্বিকে পড়াতে। তোমার এই মা তোমাকে মিস করছে। আজ কাচ্চি রান্না করেছি। দ্রুত চলে আসো।
খুশিতে মনটা ভরে উঠলো আমার। পা হারানোর পর তিনটা টিউশন ই চলে গেলো, থেমে গিয়েছিল আবশ্যিক কিছু চাহিদার স্বপ্ন যাক তার একটু হলেও ফিরে এলো। আমি গাড়িতে চড়ে বসলাম। আজ পেট ভরে কাচ্চি খাবো...
টিউশন || Aysha Zannat
Aysha Zannat is a 3rd year honours student of Mirsarai Degree College, Mirsarai, Chattogram. Her hobby is writing.