আমার আপা

  • Author: Aysha Zannat
  • Category: Short Story
  • Published on: Sunday, Sep 12, 2021

বড় আপা দৌড়ে এসে রান্নাঘরে মা’র কাছে বসে হাফাচ্ছে। মা তখন আমার পাতে আলুর তরকারীর উপর দু’চামচ ডাল দিয়ে ভাতের থালা এগিয়ে দিতে ব্যস্ত। বড় আপা মা’র গালে হাত দিয়ে মা’র ঘামে ভেজা মুখটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলছে,

-ও মা, খোরশেদ চাচা টেলিভিশন কিনে আনলেন! কি মজা!

মা কপালের ঘাম শাড়ীর আঁচলে মুছতে মুছতে বললেন,

-তাতে তোর এতো খুশী কেন?

-খুশী হবো না? এখন থেকে রোজ টেলিভিশন দেখতে যাবো! চাচা আমাকে নিজে বলেছেন রোজ টেলিভিশন দেখতে যেতে!

-মীরা, পড়াশোনা বাদ দিয়ে রোজ সন্ধ্যায় মানুষের বাড়িতে টেলিভিশন দেখতে যাবি?

-বিকেলে বেশী করে পড়ে নেবো, মা!

আমার বড় আপা!

হাসি, খুশী, চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে। দুটো লম্বা বেণী দুলিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে, একটু আনন্দেই হেসে গড়িয়ে পড়ে, চোখের কোল বেয়ে তখন পানি গড়ায়।এমনিতেও ছোটবেলা থেকেই নাকি আপার চোখ দিয়ে পানি পড়ে। মা খুব চিন্তা করেন আপার চোখের সমস্যা নিয়ে। আপা আজকাল রোদের দিকে তাকাতে পারে না, মাথা ব্যথা থাকে প্রায় দিন।পড়ালেখা আপার একদম পছন্দ না।

আমার ছোট আপা নীরা, খুব শান্ত আর ঠান্ডা স্বভাবের। ঠিক বড় আপার উল্টো। তার একটাই লক্ষ্য সব পরীক্ষায় তাকে প্রথম হতে হবে!

আমি দুইবোনের ছোট। একমাত্র ছেলে তাই মা-বাবার চেয়ে দাদী সেটা বারবার মনে করে আমাকে সবকিছুতে একটু বেশীই আগলে রাখেন। গোপনে ঘরে ডেকে নিয়ে মাঝেমাঝে দু’টাকার নোট একটা হাতে ধরিয়ে বলেন,

-নে ভাই, লজেন খাস!

বড় আপা তখন নবম শ্রেনী। আমি মাত্র পঞ্চম শ্রেনীতে। বৃত্তি পরীক্ষা দেবার চান্স পেয়েছি। ছোট আপাও বৃত্তি পরীক্ষা  দেবে অষ্টম শ্রেনী থেকে। আমাদের দু’ভাইবোনের তখন পড়ালেখায় ব্যস্ত সময়। বড় আপা তখন খোরশেদ চাচার বাড়ির সাদা কালো ন্যাশনাল টেলিভিশনে কবে বিটিভি, কবে ডিডি সেভেন সেই হিসাব কষতেই ব্যস্ত। বিকেল বেলা স্কুল থেকে ফিরে বড় আপা আমার কাছে ঘুরঘুর করে।

-খোকা শোন, আজ নাকি একটা ভালো বাংলা ছবি হবে! ডিডি সেভেনে, উত্তম-সুচিত্রা! ছবির নাম কী জানিস? পথে হলো দেরী। নাম শুনেই আমি বুঝতে পারছি ছবিটা কত ভালো হবে! যাবি আমার সাথে ভাই?

-আপা, আমার বৃত্তি পরীক্ষা!

-তুই তো এমনিই বৃত্তি পাবি! রাতে এসে একটু বেশী করে পড়ে নিস, আমি তোর পাশে বসে থাকবো খোকা!

আমি কোনদিন আপাকে না করতে পারিনি। আমার আপার মুখে কী যে মায়া ছিলো! পৃথিবীর সব মায়া এসে যেখানে জমা ছিল, সেটা ছিল আমার আপার মুখ। সে মায়ায় আমি বাঁধা পড়ে থাকতাম। 

সে বছর আমি আর ছোট আপা দুজনই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলাম। আনন্দের বান তখন আমাদের ভাঙা ঘরে। বড় আপার ঘোলা হয়ে আসা চোখের দৃষ্টিতেও খুশীর ঝিলিক! মাটির ব্যাংক ভেঙ্গে দাদীর মিষ্টি কেনার টাকা!

মামুন ভাই খোরশেদ চাচার বড়ছেলে। এলাকার মেধাবী, অমায়িক ছেলে হিসাবে তাঁর নাম ছিল। বড় আপা যখন উনাদের বাড়ির টেলিভিশনের প্রথম সারির দর্শক, মামুনভাই তখন সবার চোখ ছাপিয়ে তাদের টেবিল ফ্যানটা আপার দিকে ঘুরিয়ে দিতেন। ঢাকা থেকে ফেরার সময় আপার জন্য গল্পের বই আনতেন। সেই বই লুকিয়ে আমাকে আপার হাতে পৌছে দিতে হতো। একবার হাত ফস্কে বই মাটিতে পড়ে গেল, তুলতে গিয়ে দেখলাম বইয়ের ভেতর একটা লাল গোলাপ আর হলুদ খাম। খামের উপর নীল কালিতে লেখা “অদিতি”! আমি তখন লাল গোলাপ, হলুদ খাম কিংবা অদিতির মানে খোঁজার যোগ্য নই। আমি কেবল আমার আপার ঘোলা হয়ে আসা চোখের মণিতে আনন্দের একটু ঝিলিক খুঁজতে চাইতাম।

আমাদের বাবার সবচেয়ে প্রিয় সন্তান ছিলো বোধহয় বড় আপা। বাবা বড় আপাকে শহরে নিয়ে কোন ভালো চোখের ডাক্তার দেখাতে পারেননি। তিনটা ভাইবোন আমরা লেখাপড়া করছি তার খরচ, সংসারের খরচ সব মিলিয়ে বাবার স্বল্প বেতনে বাবা-মা দুজনই যুদ্ধ করতে করতে খুব ক্লান্ত থাকতেন। পাড়ার ডাক্তার চাচার কাছেই বাবা বড় আপাকে নিয়ে যেতেন। ডাক্তার চাচা বাবাকে বলতেন, শহরে নিয়ে একজন ভালো চোখের ডাক্তার দেখাতে।

সেইবার সত্যিই বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন আপাকে চোখের ডাক্তার দেখাতে ঢাকায় নিয়ে যাবেন। মা’র কানের আট আনা সোনার দুলটা বিক্রি হলো। মামুনভাই ডাক্তারের কাছে নাম লেখালেন। আমাদের কোন আত্মীয় ঢাকাতে না থাকায় মামুনভাইয়ের মামার বাসায় বাবা আপাকে নিয়ে উঠবেন।

ঢাকাতে যাবার আগের দিন দুপুরে আপা আমার কাছে এসে বসলেন। আমি তখন সেভেনে পড়ি। আপা পড়া বাদ দিয়েছে চোখের সমস্যার কারনে। চিকিৎসা করে চোখ ভাল হলে আপা আবার পড়বে। আমার চুলে হাত বুলিয়ে আপা বললো,

-খোকা, আজ দুপুরে একটা ভালো ছবি আছে! আমজাদ হোসেনের। খোরশেদ চাচা আমাকে বলেছেন! জাতীয় পুরস্কার পাওয়া ছবি!

আমি বোকার মত আপার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম,

-আমজাদ হোসেন কে, আপা?

-পরিচালক, ভালো পরিচালক! অনেক ভালো ভালো ছবি উনার, পুরস্কার পাওয়া! আজকের ছবির নাম “ভাত দে”! শাবানা আছে। খোকা চল যাই!

কি যে মায়া সেই মুখে! অংকের খাতার পাতা বন্ধ করে আপার হাত ধরলাম। মা তখন হাতের কাজ সেরে একটু শুয়েছেন।

সিনেমা শুরু হবার আধা ঘন্টার মধ্যে ছোট আপা হাজির।

-মা ডাকছে তোদের। এক্ষুনি চল!

বড় আপার চুলের বেণী ধরে মা খুব করে টানলেন। আমার গালেও দিলেন কষে! বড় আপা চোখ ভরা পানি নিয়ে ঘরে গেল। আমি পুকুর পাড়ে সুপারী গাছের নীচে বসে থাকলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। মনে মনে ভাবলাম, অনেক বড় হবো আমি! একদিন বড় আপার ঘরে একটা বড়, রঙিন টেলিভিশন কিনে দেবো!

***

যে বিকেলে বাবা বড় আপাকে নিয়ে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরলেন, সে বিকেলের পর থেকে আমাদের বাড়িটা ঝড় শেষে ক্লান্ত প্রকৃতির মত নিশ্চুপ হয়ে গেল। বাবার মুখ ছাই বর্ণ, চোখের দৃষ্টিতে একজন পরাজিত পিতার শূন্য হাহাকার! শুধু মা’র ঘর থেকে বুক ফাটা কান্নার শব্দ! সন্তানের মৃত্যু শোকে একজন মা যেভাবে প্রলাপ করে কাঁদতে থাকেন, বড় আপাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মা সেভাবে প্রলাপ করে কাঁদছেন! ঘরের বারান্দায় দাদী অসহায়ের মত তাকিয়ে আছেন উঠোনের বকুল গাছটার দিকে।

গ্লুকোমা! জন্মগত ভাবে বড় আপা চোখের এই কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত। বাড়ন্ত বয়সে তা বেড়ে গেছে। আমরা তখন কেউ এই অসুখটা সম্পর্কে জানতাম না। কেন আপার চোখে পানি পড়তো, মাথা ব্যথা করতো, আলোর দিকে তাকাতে পারতো না, চোখের মনির অস্বচ্ছতা এই সবকিছুকেই আমরা খুব সাধারণ কোন অসুখ মনে করেছিলাম। হাতে টাকা পয়সা জমলে ডাক্তার দেখালে আপা ভালো হয়ে উঠবে এমনটাই সবাই ভেবেছিলাম!

কয়েক বছর যেতেই আপার চোখের আলো পুরোপুরি নিভে এলো। আমার বড় আপা অন্ধ হয়ে গেল! পৃথিবীর সব আলো, সব রং বড় আপার চোখে একটা মাত্র রঙে হারিয়ে গেল। সে রঙের নাম কালো, সে রঙের নাম অন্ধকার!

***

বড় হতে হতে একদিন আমি সত্যিই বড় হয়ে গেলাম। আমার স্বপ্নের চেয়েও বড়! দাদী, বাবা-মা তার অনেকটাই দেখে যেতে পারলেন না। বড় আপা নিজের আলো দিয়ে নিজেই চলতে শিখে গেল, কোনটা ঘর আর কোনটা বকুলতলা এটা বুঝতে আপার আর কারো সাহায্য লাগে না। প্রকৃতি বোধহয় এমনই, যখন কারো কাছ থেকে কিছু কেড়ে নেয় তখন অন্য কোন দিক থেকে তা পুষিয়ে নিতে অপার কোন ক্ষমতা দান করে অজানা দূর থেকে। তাই তো মানুষ নিশ্চিত অপ্রাপ্তির সাথে নিজেকে নিজের মত করে মানিয়ে নিতে শিখে যায়। দূর সম্পর্কের এক বিধবা ফুপু বাড়িতে থাকে বড় আপার সাথে। আমি আর ছোট আপা ঢাকাতে। ক্যারিয়ার, সংসার, সন্তান সব নিয়ে আমরা দু’ভাইবোন। শূন্য বাড়িতে বড় আপা একবুক শূন্যতা নিয়ে। সেখানে আর কোন গল্পের বইয়ের ভাজে লাল গোলাপ, হলুদ খাম কিংবা নীল কালিতে লেখা “অদিতি” কাব্য বড় আপার নিভে যাওয়া চোখের আলোয় ঝিলিক তোলে না। সময়ে কেউ কেউ হারিয়ে যায় সময়ের প্রয়োজনে, কিংবা হেরে যায় জীবনের তাগিদে!

***

মৌলি খুব ভালো মনের একটা মেয়ে। সে স্ত্রী হলেও আমার বন্ধুর মত, যে বন্ধুর কাছে নিজেকে মেলে ধরা যায় সবটুকু। মৌলি প্রায়ই আমাকে বলে বড় আপাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসতে। আমি তা আপাকে বলি, আপা এড়িয়ে যায়। আমারও খুব ইচ্ছে করে বাসার বারান্দায় মেলে দেয়া কাপড়গুলোর সাথে বড় আপার সবুজ শাড়ীর আঁচল দেখতে। যে আঁচলে আমি লুকিয়ে চোখের পানি মুছবো, কেউ জানবে না, শুধু বড় আপা শাড়ীর আঁচলে অব্যক্ত অশ্রুর গন্ধ পাবে। তাঁর খোকার অশ্রু! খোকারা ইচ্ছে করলেও তো কাঁদতে পারে না। লুকিয়ে কাঁদতে হয় তাদের!

***

একদিন আমি আর ছোট আপা বাসার সবাইকে নিয়ে চলে গেলাম বড় আপাকে নিয়ে আসতে। বাচ্চাদের আবদার বড় আপা ফেলতে পারলো না। ফুপুর কাছে বাড়ির সব বুঝিয়ে বড় আপার সবকিছু আমরা গুছিয়ে নিলাম। বাচ্চারা কে কোন ব্যাগটা ধরবে এই নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করলো। কে গাড়ীতে তাদের ফুপুর পাশে বসবে, কে রাতে ফুপুর পাশে ঘুমাবে এই চললো তাদের মধ্যে। আমি আর ছোট আপা এক বুক প্রাপ্তির আনন্দে চোখ মুছলাম।

সারা বাড়ি আপা টুকটুক করে হাঁটে। মৌলির চুল আঁচড়ে বেণী বাঁধে, বাচ্চাদের গল্প করে ঘুম পাড়ায়। আমি মাঝে মাঝে বারান্দায় মেলে রাখা আপার শাড়ীর আঁচল খুঁজি।

আমি আর মৌলি মিলে বের হই। সবচেয়ে ভালো ব্র্যান্ডের একটা বড় টেলিভিশন কিনবো, আপার ঘরের জন্য।

টেলিভিশন কিনে যখন আপার ঘরে সেট করলাম, আপা কেমন যেন লজ্জা পেয়ে বললো,

-খোকা, বাসায় তো টেলিভিশন আছে রে! আমার ঘরে আবার আলাদা কেন?

-বাংলা মুভি হবে! প্রতিদিন একটা করে। আচ্ছা বড় আপা, আমজাদ হোসেন যেন কে ছিলেন?

আপা আমার কথা শুনে শিশুর মত হেসে দিলেন। তারপর বিষাদ মাখা মুখে বললেন,

-আমি কি আর চোখে দেখি, খোকা!

-মানুষ কি শুধু চোখ দিয়েই দেখে আপা? মন দিয়ে যা দেখা যায়, চোখ দিয়ে তার অনেকটাই আমরা দেখি না। মনের চোখের শক্তি এতোটাই বেশী যে তা মানুষের মনের ভেতরটা পড়তে পারে! এই শক্তি সবার থাকে না। আমার আপার আছে!

বড় আপা ছোটবেলার মত আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি তাঁর পায়ের কাছে বসে। আমার চোখের পাতায় হাত রেখে বড় আপা ফুঁপিয়ে ওঠে।

-কাঁদিস না খোকা!


আমার আপা || Aysha Zannat


Aysha Zannat is a
3rd year honours student of Mirsarai Degree College, Mirsarai, Chattogram. Her hobby is writing.