বই রিভিউ: কারাগারের রোজনামচা

  • Reviewer: Md. Rokonuzzaman Rony
  • Category: Book Review
  • Published on: Sunday, Sep 5, 2021

বই: কারাগারের রোজনামচা

 

লেখক: শেখ মুজিবুর রহমান

 

রিভিউকারী: মোঃ রোকনুজ্জামান রনি

 

ধরন: আত্মজীবনী, ব্যক্তিগত দিনলিপি

 

প্রকাশনী: বাংলা একাডেমি

 

প্রচ্ছদ ও গ্রন্থ নকশা: তারিক সুজাত

 

প্রথম প্রকাশ: মার্চ ২০১৭

 

মুদ্রণ: ৭ম, এপ্রিল ২০১৮

 

পৃষ্ঠা: ৩৩২

 

মুদ্রিত মূল্য: ৪০০ টাকা

 

ISBN: 984-07-5741-5

 

জেলখানা বা কারাজীবন সম্পর্কে আমাদের মতন সাধারণ মানুষের কৌতূহল সীমাহীন। কেননা এই কারাজীবন সম্পর্কে খুব বেশি একটা তথ্য আমাদের জানা হয়ে উঠে না, আবার যেটুকু জানা হয় সেটুকু ও অনেক সময় পুরোপুরি বাস্তবসম্মত হয় না এবং তাতে মনের কৌতুহলও সম্পূর্ণ মেটে না। জেলখানার কথা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে চৌদ্দ শিকের কুঠুরির ভেতর বন্দী কিছু মানুষ। এখানে যারা কারারুদ্ধ থাকে, এখানেই খায়, এখানেই ঘুমায়, এখানেই সাজা ভোগ করে ইত্যাদি।

 

আসলে জেল সম্পর্কে আমরা অধিকাংশ মানুষ যে  ধারণাটুকু রাখি সেগুলো আমাদের দেশের নাটক কিংবা সিনেমার পর্দায় দেখা। সাথে কিছু কিছু কথা অবশ্য লোকমুখে শুনা। তবে বাস্তবে কি জেলখানা এমনই কিছু একটা? নাকি অদ্ভুত রহস্যে ঘেরা ভিন্ন এক জগৎ? কেমন তবে সেখানকার অব্যক্ত দিনকাল?

 

এমন সব প্রশ্নের ই সুযোগ্য সমাধান মিলবে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা বই “কারাগারের রোজনামচা” থেকে। মানুষের জীবন এবং তার চারপাশে প্রতিদিন যা কিছু ঘটে, সে প্রতিদিন যা কিছু করে, যা কিছু শুনে, যা কিছু চিন্তা–ভাবনা করে সেগুলোর কিছু কিছু সেদিনের সন-তারিখ সহ খাতা বা ডায়েরির পাতায় লিখে রাখাকে রোজনামচা বলে। কারাগারের রোজনামচা বইটি মূলত এক প্রকার ডাইরি বা দিনলিপি যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলখানায় বসে বসে লিখে রেখেছিলেন।

 

পাকিস্তানিদের শাসন, শোষণ,বঞ্চনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে, বাংলার দুঃখী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করতে গিয়ে যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছে মহান এই নেতাকে। বইটিতে বঙ্গবন্ধুর জেল জীবনের নানান অভিজ্ঞতা,রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা নিংড়ে বের হয়ে এসেছে। সেই সাথে বইটি পড়লে তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দলের প্রতি ত্যাগ, সাধারণ মানুষের দাবী আদায়ের জন্য  সীমাহীন কষ্টভোগের দৃশ্যপটটি নিশ্চিতভাবে ভাবে পাঠক হৃদয়ে দাগ টেনে যাবে।

 

মুক্ত মুজিবের চেয়ে বন্ধী মুজিব যে আরো বেশি শক্তিশালী তা বইটি পড়ে সহজেই অনুমেয়। কিভাবে জেলের অন্ধকার সেলে একাকী দিনের পর দিন বন্ধী থেকেও সহধর্মিণীর মাধ্যমে দলকে সুসংগঠিত করেছেন, দলের নেতাকর্মীদেরকে উপযুক্ত দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন তা কেবল একজন সুযোগ্য নেতার পক্ষেই সম্ভব।

 

বইটিতে যেমন একদিকে নানান ধরনের মানুষের অপরাধের কথা, অপরাধ জীবনে জড়ানোর কথামালা ব্যক্ত হয়েছে তেমনি জেল পর্যায়ে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের কোথাও সজোরে বঙ্গবন্ধুর লেখনীতে উচ্চারিত হয়েছে বারবার।

 

কিভাবে জেলখানার চিকিৎসা ক্ষেত্রে দুর্নীতি পরিচালিত হয়, কিভাবে বেছে বেছে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীদেরকে অত্যাচার করা হয়, বিনা বিচারে আটকে রেখে আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়, কিভাবে একজন নির্দোষ ব্যক্তি বছরের পর বছর বিনা দোষে জেল খেটে যায় তাই আবেগঘন হয়ে ফুটে উঠেছে রাজনীতির এই কবির কলমী শক্তিতে।

 

রাজনৈতিক লেখালেখি নিয়ে কিছু পাঠকদের মাঝে একটা অনীহা থাকে যে, এর ভাষা বোধহয় বেশ কাঠখোট্টা গোছের, জটিল চিন্তা বিশ্লেষণ, অলঙ্কার উপমা দিয়ে বর্ণিত। কিন্তু না, বইটি পড়ে কোনোভাবেই আমার দুর্বোধ্য কিংবা একঘেয়েমী লাগে নি। বরং বইটির ভাষা একদম সহজ,সরল,নিখুঁত জলের ন্যায় গড়িয়ে গড়িয়ে ধীরগতিতে ছন্দময়তার সাথে এগিয়ে চলেছে। আবার দিনলিপি বলেই যে শুধু সাদামাটা ভাবে লেখক নিজের প্রাত্যাহিক রুটিন বর্ণনা করে গেছেন তা নয় বরং কখনো গভীর চিন্তাশক্তি কখনো সরল রসবোধের মিশেলে বাস্তবতাকে নিজ হাতে অঙ্কন করে দেখিয়েছেন।

 

আসলে বইটির যতই পাতা উল্টাচ্ছিলাম ততই যেনো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছিলাম। পিতার প্রতি ছোট্ট শিশু রাসেলের আকুতি “আব্বা বালি চলো” এমন করে প্রিয় বাবাকে জেলখানা থেকে বাসায় নিতে চাওয়ার অবুঝ চেষ্টা দেখে অশ্রুসিক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি বইটিতে বড়ো করে ফুটে উঠে সেটি বঙ্গবন্ধুর একাকীত্ব।দিনের পর দিন একাকী একটি সেলে বন্ধী ছিলেন কারো সাথে কথা বলা, যোগাযোগ করার সুযোগ ছিলো না। পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কষ্ট, দুঃখ, এমনকি নিজের বৃদ্ধ বাবা, মাকে একটিবার দেখতে চাওয়া খোকার কাতরতা পাঠক হৃদয়কে ভারী করে তুলবে নিঃসন্দেহে।

 

যে বিষয়টি লুকাতে গিয়েও লুকাতে পারেন নি মহান এ নেতা সেটি হলো তার প্রতি মানসিক অত্যাচার। পাশের সেলের পাগলদের অত্যাচারে ঠিকমতো ঘুমাতে পারতেন না,কখনো ও বা দিন রাত মাথার উপর ২৪ ঘণ্টা উচ্চ ক্ষমতার লাইট জ্বলত। জেলের রান্না খেতেও হতো কষ্ট, কখনো নিজে নিজে রান্না করেই খেতেন। আর এভাবে যখন শরীর খারাপ করে অসুস্থ হয়ে পড়তেন তখন সেবা করার মতন ও কেও ছিল না, একাকী এক সেলে অসহায়ভাবে অসুস্থ দিনযাপন করার কাহিনী পড়তে গিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকদের প্রতি আমার শুধু ঘৃণা ও ধিক্কার ই বিচ্ছুরিত হয়েছে বারবার।

 

পাশাপাশি বইটির নামকরণ, বইয়ের ভূমিকা, উপযোগী টীকার ব্যবহার, কিছু সাদাকালো আলোকচিত্র বইটিকে সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে। চমৎকার প্রচ্ছদে মোড়ানো বইটিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখা দেখতে পাওয়া ও পড়ার সুযোগ যা বইটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বইটি একজন রাজনীতিবিদের কাছে পাথেয় স্বরূপ, ইতিহাসবিদ এর কাছে অমূল্য রত্ন, গবেষকের কাছে বিশ্বস্ত তথ্য, সাহিত্য রসিকের কাছে আনন্দের খোরাক আর একটি জাতির কাছে আলাদিনের চেরাগ। দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রয়েছে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এর সঠিক ইতিহাসকে জানার। তাই সবাইকে খুব আন্তরিকভাবে স্বাগতম বঙ্গবন্ধু রচিত কারাগারের রোজনামচায়।



বই রিভিউ: কারাগারের রোজনামচা || Md. Rokonuzzaman Rony


Md. Rokonuzzaman Rony is a student from Bangladesh Agriculture University. He's from Sripur, Gazipur.