সম্পর্ক
আমার শ্বশুরবাড়িতে প্রাইভেসীর বিরাট সমস্যা। উপরতলার কথা নীচ তলা থেকে শোনা যায়।
রবি যখন আমাকে বিয়ে করে এ বাড়িতে নিয়ে এলো, সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমার শাশুড়ি রবিকে উপরে নিয়ে যা বললেন তার মর্ম হলো রবির জন্য খুব বড়লোকের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়ের বিয়ে কথা চলছিল। এর মাঝে রবি কেন একটা গরীবগুর্বা মরহুম সাংবাদিকের মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে? এই মেয়েকে নিয়ে কি আত্মীয়স্বজনদের সামনে মুখ দেখানো যাবে? রোটারী ক্লাবের মিটিঙ্গে যাওয়া যাবে?
রবি বোধহয় বাড়ি ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিলো, ওতে আপাতত কাজ হলো। শাশুড়ি আম্মা তিতা ঔষধের মত আমাকে কোন রকমে গিললেন।
রবি যখন আমাকে মায়া করে ওর মিঠাইমণ্ডা বলে আমি কপট রাগ দেখিয়ে উত্তর দেই, আমি তোমাদের বাড়িতে নিম ফুলের মধু।
আসলে শাশুড়ি আম্মার রাগ করাটাই স্বাভাবিক। গুলশানে ওনাদের এত বড় দোতালা বাড়ি। সামনে পেছনে বিরাট লন। শ্বশুর সাহেব আর্মি থেকে আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে এরশাদের আমলে বিরাট ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। সমাজের রাঘব বোয়ালদের সঙ্গে ওনার যাতায়াত। ছেলে রবি ছয় ফুট লম্বা, সুদর্শন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হকি দলের খেলোয়াড়। পড়ালেখায় ভালো বলে বিসিএস দিয়ে ইনকাম ট্যাক্সে ঢুকেছে। সেই ছেলে কিনা এমন একটা মেয়েকে ঘরে এনেছে যার বাবা তো নেইই, আদাবরে কোনরকম বাড়ি ভাড়া করে থাকে।
আমার শ্বশুর সাহেব মনে হলেন না এ নিয়ে বিশেষ ভাবিত। তিনি প্রথম দিন থেকেই একটা নিরপেক্ষ অবস্থান নিলেন। আমাকেও দুঃখ দিতে চাচ্ছেন না আবার শাশুড়ি আম্মাকেও ক্ষ্যাপাতে চাচ্ছেন না। হয়তো কখনো ডাইনিং রুমে আমার সঙ্গে একটু হেসে কথা বলছেন, শাশুড়ি আম্মা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আড়ষ্ট হয়ে খাবারে মন দিলেন।
রবি সকালে অফিস চলে যায়। বাবা চলে যান ব্যবসার কাজে। সংসারের নৌকায় অস্বস্তির ঝড়ে দুলতে থাকি আমি আর শাশুড়ি আম্মা।
প্রথম একমাস শাশুড়ি আম্মা আমার সঙ্গ একটুও কথা বলেননি। এমনভাবে দৃষ্টি হানতেন মনে হতো আমি কোন ডাকিনীযোগিনী, টাকার লোভে ওনার ছেলের মাথা খেয়েছি। এর মাঝে, আল্লাহর বিচার, শাশুড়ি আম্মা হঠাৎ মাথা ঘুরে বাথরুমে পড়ে গেলেন। আমি গিয়ে তাড়াতাড়ি ওনাকে মেঝে থেকে টেনে ওঠালাম। কাঁধে ভর দিয়ে ওনাকে বিছানায় নিয়ে শোয়ালাম। দেখলাম বেচারীর ডান হাত বেসিনের কোনায় লেগে রক্ত জমে কালচে হয়ে গেছে।
আমি একটা গামছায় বরফ ভরে ওখানে চেপে ধরলাম। শাশুড়ি আম্মা খান্দানি পরিবারের অভিজাত মহিলা। আমি স্পর্শ করামাত্রই কেমন শক্ত আর আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। মনে হলো আমি চলে গেলেই বাঁচেন। আমি বরফ দিয়ে ওনার হাত আরও জোরে চেপে সম্পর্কের বরফ গলানোর জন্য বললাম, 'আম্মা, খুব ব্যথা লাগছে বুঝি?'
শাশুড়ি আম্মা শুকনো গলায় বললেন, 'সুরাইয়াকে ডাকা হোক।'
সুরাইয়া আমাদের কাজের মেয়ে। আজ আসেনি। আমি বললাম, 'সুরাইয়া তো আজ আসেনি আম্মা, দারোয়ান ভাই আছে।'
'এক গ্লাস পানি আনা হোক।'
'আম্মা, এভাবে প্যাসিভ ভয়েজে না বলে আক্টিভ ভয়েজে কথা বললে ভালো লাগতো।'
শাশুড়ি আম্মা কটমট করে তাকিয়ে বললেন, 'পানি আনছো না কেন?'
আমি পানি এনে বললাম, 'আম্মার, আমার একটা নাম আছে, টুম্পা। আপনার ছেলে বলে টুম্পুমণি। আপনার তো কোন মেয়ে নেই, টুম্পা বলে ডাকবেন, দেখবেন মনটা ফুরফুরা লাগবে।'
মা কোন জবাব দিলেন না, ঢক ঢক করে পানি খেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন।
শাশুড়ি আম্মা প্রথম প্রথম আমার রান্না খেতেন না। বাথরুমে পড়ার পর থেকে খাওয়া আরম্ভ করেছেন। আমি রুই মাছের মাথা, ইলিশ মাছের পেটির টুকরো শাশুড়ি আম্মার দিকে এগিয়ে দিই। শাশুড়ি আম্মা প্রশংসা, অপ্রশংসা কিছুই করেন না। আমার শ্বশুরসাহেব কমবেশী শাশুড়ি আম্মাকে অনুসরণ করেন, সংসারে খামোখা ঝামেলা পাকাতে চান না। সেদিন চিংড়ির দোপেঁয়াজা রাঁধছি, শাশুড়ি আম্মা কী কাজে কিচেনে এসেছেন। আমি চামচে একটু দোপেঁয়াজা এগিয়ে দিয়ে বললাম, 'মা টেস্ট করে দেবেন কেমন হয়েছে।'
মা কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে চামচ থেকে দোপেঁয়াজা চাখলেন। তারপর বললেন, বাড়িতে নারকেলের পাউডার আছে, ওটা দিয়ে মালাইকারি রেঁধো, মজা হবে। যাওয়ার সময় একবার ঘুরে বললেন, এটাও খারাপ না, তোমার বাবা পছন্দ করবেন।
আমার নিজের মা খুব সংকোচে মাঝে মাঝে ফোন করেন। আমি যে এভাবে হুট করে বিয়ে করব সেটা মাও জানতেন না। অথচ আমি এ বাড়িতে আসার তৃতীয় দিন আমার শাশুড়ি আম্মা মাকে একচোট কথা শুনিয়ে দিয়েছেন। মা ফোন করলেই জানতে চান আমি কেমন আছি। আমি জানাই খুব ভালো আছি। মা কী বুঝেন কে জানে, মন খারাপ করে ফোন রাখেন।
এভাবে মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছিল, শাশুড়ির মনের তাপমাত্রা কিছুতেই শূন্য ডিগ্রী সেলসিয়াসে উপরে ওঠানো যাচ্ছিল না। সম্পর্কের বরফ গলতে সময় লাগছিল।
অবশেষে একদিন সন্ধ্যায় আমি শাশুড়ি আম্মার প্রাণ ভোমড়ার সন্ধান পেলাম। আমাদের বাড়িতে রাত আটটায় খাওয়ার নিয়ম। রাতের খাওয়া শেষ হলে একটু গুছিয়ে আমি সোজা বেডরুমে চলে যাই। তখন থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত সময়টা রবি আর আমার। এই সময়টা আমি অর্জন করি সারাদিন শাশুড়ি আম্মার অবহেলা সহ্য করে। পারতপক্ষে তখন আমি ঘর থেকে বের হই না। আমি আর রবি মনের সুখে মুভি দেখি।
সেদিন কী কারণে বেরিয়েছি। ওমা, দেখি ড্রইং রুমে শাশুড়ি আম্মা একা একা খিল খিল করে হাসছেন। ওনার এরকম হাসি আমি কখনো শুনিনি। দরজার কাছে গিয়ে দেখলাম শাশুড়ি আম্মা স্টার প্লাসে শ্রীমান শ্রীমতী নামের এটা সিরিজ দেখছেন। আমি আস্তে করে গিয়ে শাশুড়ি আম্মার পাশে বসলাম। আম্মা একবার কটমট করে আমার দিকে তাকালেন। তারপর আবার টিভিতে মনোনিবেশ করলেন। হাসির মুভি তো, চাইলেইও গম্ভীর থাকতে পারছিলেন না,একটু পর পর ফিক করে হাসছিলেন। আমি ও হাসিতে যোগ দিয়ে বললেন, আম্মা দেখেন মনীষা এইটা কী করলো। আমি হাসতে হাসতে শাশুড়ি আম্মার হাত ধরলাম। শাশুড়ি আম্মা হাত সরিয়ে নিলেন না। একটু পর দেখা গেলো আমি আর শাশুড়ি আম্মা দুজনই হাসতে হাসতে শেষ।
এখন প্রতিদিন আমি আর শাশুড়ি আম্মা রাতে টিভির সামনে বসি। আমি দুজনের জন্য আদা লেবুর চা নিয়ে আসি। সারাভাই ভারসেস সারাভাই দেখে হাসতে হাসতে আমাদের দুজনের অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। শাশুড়ি আম্মা এখন আমার সঙ্গে অ্যাক্টিভ ভয়েজে কথা বলেন। টুম্পা বলে ডাকেন। মাঝে মাঝে রোটারি ক্লাবের মিটিঙ্গে নিয়ে যান,এমনকী আত্মীয়স্বজনের সামনে আমাকে প্রেজেন্ট করতে লজ্জা পান না।
আমি প্রেগ্ন্যান্ট হবার পর পাশার দান আরও উলটে গেলো। ঘরে নাতি আসবে থেকে আম্মা আনন্দে আত্মহারা। টুম্পা মেয়ে নাকি ছেলে? বলে জ্বালিয়ে মারেন। আমি বিরক্ত হয়ে বলি, আগে আলট্রাসোনো হোক মা, এইটিন উইক্সের আগে করে লাভ নেই।
দশ মাস পর আমাদের ঘর আলো করে একটা মেয়ে এলো। শাশুড়ি আম্মা মেয়ের নাম দিলেন নিশাত। ওনার নিজের মায়ের নামে নাম। শাশুড়ি আম্মা এখন দিনরাত নিশাতকে নিয়ে পড়ে থাকেন। এমনকি আমার সঙ্গে স্টার প্লাসে সিরিয়াল দেখার সময় পান না।
এভাবে আমার আর শাশুড়ি আম্মার সম্পর্কের বরফ গলে গাঙ্গের পানি হয়ে গেলো। কিন্তু ওই যে বলে সংসার দুঃখ সুখের তরঙ্গ। আমার হিংসুটে বান্দবী লিজা আছে না? ওর বর ইঙ্কাম ট্যাক্সে কাজ করে। লিজা একদিন ফোনে একটা মেয়ের ছবি পাঠিয়ে বললো,আমাদের হকি প্লেয়ার তো এখন অন্য জালে গোল করে বেড়াচ্ছেন।
মেয়েটার ফেইসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখলাম কাটা কাটা শার্প চেহারা, পশ গার্ল। মেয়েটা গভমেন্ট স্কলারশিপে হার্ভার্ড থেকে একজেকিউটিভ এমবিএ ডিগ্রী নিয়ে এসেছে। ওই ইনকাম ট্যাক্সেই কাজ করে।
এ নিয়ে রবির সঙ্গে প্রতিদিন আমার লেগে যেত। রবি অস্বীকার করত না, বলত এটা জাস্ট একটা শর্ট ফ্লিং। হি উইল গেট অভার ইট সুন। কিন্তু লিজা বললো, ওরা নাকি বিয়ে করবে। আমাকে ডিভোর্সের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
শেষমেশ আমি কাঁদতে কাঁদতে শাশুড়ি আম্মাকে সব খুলে জানালাম। আমি আগেই বলছিলাম না আমাদের বাড়িতে প্রাইভেসীর সমস্যা আছে? উপরতলার কথা নীচ তলা থেকে শোনা যায়? শুনলাম রবি আম্মাকে বলছে, 'এ রকম হার্ভার্ডে পরা মেয়েই তো তুমি চেয়েছিলে। অ্যারিস্টোক্রেট ফ্যামিলি। আগে না হয় একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। শোধরানোর সময় তো এখনো আছে।'
শাশুড়ি আম্মা এই প্রথম ওনার ভয়ালো মূর্তি ধারণ করলেন। চিৎকার বললেন, 'চড় মেরে তোর সবগুলি দাঁত আমি ফেল দেবো, লোফার কোথাকার।'
সেদিনের পর রবি আর বাড়ি ফেরেনি। ওই পশ মেয়েটাকে বিয়ে করে তার সঙ্গেই আছে। আমার শাশুড়ি আম্মা ওকে ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করেছেন। সব সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত করেছেন। আমি আর আমার মেয়ে নিশাত শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে খুব ভালো আছি। শাশুড়ি আম্মা আমার জন্য ছেলে দেখছেন। ঘর জামাই আনবেন। আমার কোন কথায় কান দিচ্ছেন না। কিছু বললেই শুনিয়ে দেন, আগেরবার নিজে পছন্দ করে দেখেছ তো কী অবস্থা হয়?
[সত্য ঘটনা অবলম্বনে কিন্তু গল্পের আবহ নিজের মত করে বানানো]
সম্পর্ক || Fahad Zakir
Fahad Zakir is doing his bachelor in Economics in University of Khulna. He's a student of final year and a book lover.