চোখের বালি
বইয়ের নাম: চোখের বালি
লেখক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ধরণ: মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস
"প্রকৃত আপনাকে মানুষ আপনিও জানিতে পারে না,অন্তর্যামীই জানেন,অবস্থা বিপাকে যেটা বাহিরে গড়িয়া উঠে সংসারের কাছে সেইটাই সত্য।"
'চোখের বালি' কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি জনপ্রিয় মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক উপন্যাস যা বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সৃষ্টি। কালজয়ী এই উপন্যাসটি যুগ যুগ ধরে পাঠকদের মন জয় করে আসছে।উপন্যাসে কবিগুরু প্রেম,বন্ধুত্ব,বিশ্বাসঘাতকতার পাশাপাশি তৎকালীন সমাজে নারীর অবস্থান এবং নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।একটি নবদম্পতির জীবনে একজন বিধবা কেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল এবং নিজে কি প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হলো এটাই উপন্যাসটির মূল বিষয়বস্তু।উপন্যাসে নারীর স্বাধীনতা,সম্পর্কের জটিলতা এবং সেই সময়ের যুবতী বিধবাদের পরিণতি উঠে এসেছে।
কাহিনি সংক্ষেপ: উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিনোদিনী।এই রূপবতী, তরণী এবং শিক্ষিত বিধবা এবং তার সাথে অন্যদের সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গল্প আবর্তিত হয়।গল্প শুরু হয় মহেন্দ্র এবং তার মা রাজলক্ষ্মীর মধ্যে কথোপকথনের মাধ্যমে।মহেন্দ্র রাজলক্ষ্মীর অত্যন্ত আদরের ছেলে।সে তার বান্ধবীর মেয়ে বিনোদিনীর সাথে মহেন্দ্রের বিয়ে দিতে চায়।কিন্তু মহেন্দ্রের বিয়েতে কোন আগ্রহ না থাকায় বিনোদিনীর অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায় এবং বিয়ের পর পরই সে বিধবা হয়।তিন বছর পর মহেন্দ্র তার পরম বন্ধু বিহারীর বিয়ের জন্য কাকি অন্নপূর্ণার বোনের মেয়ে আশালতাকে দেখতে যায়।কিন্তু আশালতাকে তার এতই ভালো লাগে যে সে নিজেই বিয়ে করতে চায়।রাজলক্ষ্মীর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও মহেন্দ্র আশাকে বিয়ে করে এবং বিহারীও মেনে নেয়।কিন্তু বিয়ের পর মহেন্দ্র সবসময় আশাকে কাছে পেতে চাইতো।তার ডাক্তারি পড়া প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে থাকে।রাজলক্ষ্মী নতুন বউকে ঘরকন্নার কাজ শেখাতে চাইলে মহেন্দ্র তাতে বাঁধা দেয়।রাজলক্ষ্মী প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে গ্রামে চলে যায়।সেই সাথে অন্নপূর্ণা কাশীতে চলে যায়। গ্রামে বিনোদিনীর সেবা,ভক্তি এবং আচার-ব্যবহার রাজলক্ষ্মীকে এতটাই মুগ্ধ করে যে সে আসার সময় বিনোদিনীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে।রাজলক্ষ্মীর সংসারে আসার পর বিনোদিনী সবকিছুকে আপন করে নেয়।আশালতার সাথে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।বিনোদিনীর সৌন্দর্য, রুচি এবং সকল কাজে পারদর্শিতা মহেন্দ্রকে আকৃষ্ট করে।সে বিনোদিনীর প্রেমে পড়ে যায়।সরল আশালতার প্রতি তার আগ্রহ কমে যায়।তাদের সম্পর্কের মধ্যে টানপোড়ন শুরু হয়।কিন্তু বিহারী এটা রোধ করে।বিনোদিনী তার ভুল বুঝতে পারে এবং তাদের সংসার ছেড়ে দূরে চলে যায়।আশা এবং মহেন্দ্রের দাম্পত্য মিলন ঘটেছে।
ব্যক্তিগত মতামত: বিনোদিনী চরিত্রটি বরাবরই আমাকে আকৃষ্ট করেছে।তার মধ্যে অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বিধবা হওয়ার কারণে সবকিছু থেমে যায়।মহেন্দ্র এবং বিহারীর মানসিকতা সম্পূর্ণ বিপরীত।মহেন্দ্র কখনো তার আবেগ এবং আত্মসম্মানকে ধরে রাখতে পারেনি।সে সবকিছু জোর করে হলেও পেতে চেয়েছে।অপর দিকে বিহারী সবসময় তার আবেগ এবং আত্মসম্মানকে ধরে রাখতে পেরেছে।সবার জন্য নিজের বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি।সে মহেন্দ্র এবং আশার সংসারকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে।বিনোদিনীকেও সে সুন্দর জীবন দিতে চেয়েছিল।আশালতা চরিত্রের মধ্যে সরলতা এবং স্বামীর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার এক অনন্য নিদর্শন দেখতে পাই।রাজলক্ষ্মীর মধ্যে একজন আদর্শ বাঙালি মায়ের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।উপন্যাসের কিছু কিছু জায়গায় আমার কাল্পনিক এবং ধীর গতির মনে হলেও লেখকের ভাষার সৌন্দর্য ও গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।শুধুমাত্র প্রেম নয় বরং সমাজে নারী শিক্ষার গুরুত্ব, নারীর মানসিকতা ও স্বাধীনতা, বাল্যবিয়ে,কুসংস্কার এ সবকিছুই উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে।
রেটিং:৯/১০।
চোখের বালি || লিসানি আফরিন
লিসানি আফরিন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।পড়াশোনার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার আগ্রহ রয়েছে।সময় পেলেই সে বাংলা গল্প, উপন্যাস পড়ে।শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং সমারেশ মজুমদার তার পছন্দের লেখক।বই পড়ার পর রিভিউ দিতে সে খুব ভালোবাসে।পড়া শেষে বইটা কোন সম্পর্কে লেখা,লেখক কি বোঝাতে চেয়েছেন, কেন এবং কাদের পড়া উচিত এই সব দিক তুলে ধরতে সে পছন্দ করে।