অ্যাটাক
সাংবাদিক সাদেক সকাল-সকাল বেরিয়েছে ক্যামেরা নিয়ে।আজকে আন্দোলন করবে ছাত্র-জনতা। ডাক পরেছে,রাজুতে একত্র হবে সবাই ।সেখানেই ডিউটি তার,ভালোমতো নিউজটা রিপোর্ট করতে হবে।
ক্যামেরা হাতে বের হতেই জনতার বড় ভিড় চোখে পড়লো।ভোর বেলাতেই বের হয়েছে তারা।তাদের গন্তব্য রাজু।ক্যামেরা উচিয়ে জনস্রোতের সামনে ভিডিও করতে-করতে এগিয়ে যেতে লাগলো।
রাজুতে যেন কেউ জড়ো হতে না পারে,সেজন্য রাজুতে যাওয়ার সকল পথে বড়-সাহেবদের আদেশে পুলিশি-পাহারা রাখা হয়েছে।
আন্দোলন?কিসের আন্দোলন?কোন আন্দোলন-ফান্দলন হবে না।যা করা লাগে করো।
বড়-অফিসারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।সে আবার তার ছোট-অফিসার আর পুলিশ-কনস্টেবলদের বলে দিয়েছে।
সবাই রাত থেকে পাহারা দিচ্ছে।তাদের এদিকে পরিবেশ ঠাণ্ডা,লোকজন নেই।আসতেই বা আর কতক্ষণ?এই কথা চিন্তা করতে-করতেই দূর থেকে হালকা স্লোগানের শব্দ,ক্ষণে-ক্ষণে বাড়ছে।
পুলিশি-পাহারার অপর পাশটা থম্থমে।কিন্তু দূর থেকে একটা হালকা শোরগোলের আওয়াজ আসছে। পাহারা দেওয়ার জায়গা হতে রাজু ১কিলো।রাজু ভাস্কর্যের মাথার ওপর চড়ুই পাখির ঝাঁক।পাশেই একটা গাছে এক দল কাক,দেখে আছে পাখিগুলোর দিকে।আকাশে উড়ছে একটা বিশাল শকুন।কে কার জন্য অপেক্ষা করছে কে জানে!হয়তো কাকগুলো শকুনের-ডাকের অপেক্ষায় বা পাখিগুলো কাকের-ডাকের অপেক্ষায়।একটা শব্দেই মনে হয় শুরু হবে তাদের উড়ে বেড়ানো।কে আগে কাকে ধরতে পারে,কে আগে নিরাপদে পালাতে পারে!
হঠাৎ গুলির শব্দ।তারপরেই শোরগোলের শব্দ যেন বাজ পড়ার শব্দে পরিনত হলো।তারপর আবার গুলির শব্দ।অনেকগুলো গুলির শব্দ,পরপর।চিৎকারের শব্দ যেন বাড়ছে গুলির শব্দের সাথে সাথে।রাজুর ওপর আর কোন চড়ুই নেই।গাছের ডালগুলোতে কোন কাক নেই।পাখিগুলো আকাশে ওরা শুরু করেছে।চিৎকারের শব্দ পাখির-কিচিরমিচির আর কাকের-ডাকে যেন হারিয়ে গেছে।
জোবায়ের,জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।দিনাজপুরের ছেলে।বজ্রকণ্ঠ,নেতা হওয়ার ইচ্ছা তার।তার সাথে এসেছে তার সহপাঠীরা,ভীরের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে সে।
২দিন আগে আন্দোলন চলাকালে তাদের সহপাঠী,সিনিয়ররা শহিদ-আহত হয়।তারই প্রতিবাদী-আন্দোলন আজকে।সঙ্গে বর্তমান ক্ষমতায় থাকা বড়-বাবুদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হবে আজকে।তাদেরকে ক্ষমতা থেকে হটানোর আন্দোলন।
কবির সাহেব।চট্টগ্রামের লোক।ক্যারিয়ার গড়তে ঢাকায় বেসরকারি একটা কম্পানিতে চাকরি করেন।বের হয়েছেন ৩বছরের ছোট-ছেলেকে নিয়ে।তার স্ত্রী নিষেধ করলেও,প্রতিবাদী কবির সাহেব ছোট-ছেলের আবদার পূরণ করতে বেড়িয়েছেন আন্দোলন দেখতে।সেটা তারও মনের ইচ্ছা।
ক্যামেরা দেখতেই ছেলের বায়নায় জনস্রোত উপেক্ষা করে চলে গেলেন মিছিলের সামনে। কবির সাহেবের মনের খোরাকও পূর্ণ হলো।এরকম জনতার-ভিড়ের মধ্যে নিজেকে সামনে দেখতে পেরে তার প্রতিবাদী-সত্ত্বা যেন আরও জেগে উঠলো।ছাত্র-জনতার সাথে তিনিও স্লোগান দিতে থাকলেন।
মজাফফর চৌধুরী।২দিন থেকে তার কলেজ পড়ুয়া ছেলের খবর না পেয়ে সাতক্ষিরা থেকে ছুটে এসেছেন ঢাকা।কিন্তু তাকে কে বলতে পারবে তার ছেলে কোথায়?কে বলতে পারবে তার ছেলে ২দিন আগের সংঘর্ষে মারা গেছে?
কিন্তু ছেলেকে খুঁজতে এসে এখন তিনি এই বিশাল জনস্রোতের সম্মুখীন।কি করবেন তিনি?আগে কোথায় যাবেন?এত বড় জনস্রোত যে আটকে রেখেছে পথ।অগত্যা তাই বিশাল স্রোতের সামনে হাঁটছেন।জানেন না কোথায় যাচ্ছেন।আশা করছেন যেখানে যাচ্ছেন,সেখানেই যেন তার ছেলেকে খুঁজে পান।
রিকশাচালক আফজাল,রুজি-রোজগারের জন্য সিলেট থেকে এসেছেন।যুবক বয়স,পড়ালেখা জানেন না,তাই খেটে খাওয়ার সহজ একটা উপায় দিয়ে উপার্জন শুরু করেছেন।রিকশা নিয়ে বেরিয়েই দেখেন বিশাল জনস্রোত,সবাই স্লোগান দিচ্ছে।
এত ভিড়ের মধ্যে রিকশা নিয়ে এগোনো যাবে না।তাই না চাইতেও তাকে তার রিকশা ফুটপাতের ধারে বেধে রাখতে লাগলো।কিন্তু সেও জানতে উৎসুক কি চলছে?কিসের এত স্লোগান?কিসের আন্দোলন?উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে গেলো মিছিলের দিকে।মিছিলের সাথে-সাথে এগোতে থাকলো সামনে।
একটু সামনেই পাহারা দিচ্ছে পুলিশবাহিনী।ছাত্র-জনতার এই মিছিল দেখে পুলিশবাহিনীরও টনক নরে বসলো।এত মানুষ তারা আশা করে নাই।কি করবে এখন তারা?বড়-অফিসার অর্ডার দিলেন পজিশন নিতে।সবাই লাইন করে দাঁড়িয়ে পড়লো।ব্যারিকেড ঠিক করে ফেলল।বন্দুক প্রস্তুত করে ফেলল।মাইক হাতে জুনিয়র-অফিসার জনতার ভিড়কে থামার নির্দেশ দিলো।
কিন্তু তারা থামলো না।খবর এসেছে অন্য রাস্তাতে পাহারায় থাকা পুলিশেরা নাকি ছাত্র-জনতার ভিড়ের মাঝে কাঁদুনে গ্যাস-সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে।এজন্য এই জনতার-ঢল প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ।
থামার নির্দেশ না মেনে এই ছাত্র-জনতার ভিড় এগিয়ে গেলো ব্যারিকেডের সামনে।
ব্যারিকেড ভাংতে হবে।
রাজুতে যেতে হবে।
অন্যায়ের জবাব দিতে হবে।
ছাত্র-জনতা স্লোগান দিচ্ছে।
পারছে না পুলিশ সামাল দিতে এই জনস্রোতের-শক্তিকে।কি করবে তারা?
বড়-অফিসারে কাছে ফোন এলো,’কি অবস্থা ওই দিকের?’
অফিসার বলে,’জনতার ভিড় তো বাড়ছে।তাদের সামাল দেওয়ার জন্য গুঁটি-কয়েক পুলিশ যে যথেষ্ট নয়।‘
বড়-সাহেবরা বলে,‘এতদিন কেনো পুষেছি?কেন বারিয়েছি বেতন?তোমাদেকে কি বন্দুক দেই নাই?চালাও সেগুলো।বন্ধ করে দাও সব আন্দলনের চৌদ্দ-গুষ্টি।রাস্তা আমার খালি চাই।‘কারন বড়-সাহেবদের অতিথি আসছে।
বড়-অফিসার নির্দেশ দিলেন,’যা বলেছে বড়-সাহেব,মানতে আমাদের হবেই।‘’
এদিকে আবার বাড়ছে জনতার স্লোগান,কণ্ঠ হচ্ছে তীব্র,বাড়ছে তাদের ক্ষিপ্রতা।
কিন্তু তারা তো সাধারণ ছাত্র-জনতা,মারা যে তারা পরবেই।
বেতন কি তোদেরকে তারা দেয় নাকি বড়-সাহেবরা?এ কথা বলেই আকাশে গুলি চালালেন বড়-অফিসার।
কিছুটা পিছিয়ে গেলো ছাত্র-জনতা।হকচকিয়ে গেলো সবাই।কিন্তু আবার সবাই স্লোগান শুরু করল।ধিক্কার দেওয়া শুরু করলো তাদের।আবার এগিয়ে যেতে লাগলো।
না পালালে চালাও গুলি।২টা মরলে সব এমনিতেই পালাবে।দশের ভালোর জন্য একজনের মৃত্যু যে মঙ্গল,এটা কি তোমরা জানো না?
কিন্তু
নেই কোন কিন্তু!
এগোতে থাকলো সবাই।তাদের থামানো সম্ভব না।বাড়ছে স্লোগান।তার সাথে চিৎকার করে সবাইকে পিছু হটতে বলছে ছোট-অফিসার।জনতা দিচ্ছে ধিক্কার।বড়-অফিসার নির্দেশ দিলেন, ’অ্যাটাক, চালা গুলি।‘না চাইতেও অনেককে চালাতে হলো গুলি।তাদের কারো আবার চোখে জমেছে অশ্রু।এদের আমরা চিনি না,কিন্তু এরা তো আমাদের মতই মানুষ,তাও আমাদের চালাতে হবে গুলি।
মুহূর্তেই গুলির শব্দে পিছিয়ে পড়লো সবাই।লুটিয়ে পড়লেন সাংবাদিক।তারপরেই লুটিয়ে পরলেন মজাফফর চৌধুরী,সঙ্গে পরে গেলো ৩বছরের বাচ্চাটা।গুলি বুকে বসে পরলেন রিকশাচালক আফজাল।শরীরে গুলি নিয়ে নিথর বাচ্চাটার দিকে তাকিইয়ে থাকলেন কবির সাহেব।৩টা গুলি খেয়েও রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকলো জোবায়ের।পাশে পড়ে আছে তার এক সহপাঠী। পালিয়ে যাচ্ছে সবাই।মারা পরেছে অনেকে।কাউকে সে চেনে না।
বড়-অফিসার এবার গুলি চালালেন।প্রথমে বাচ্চার দিকে তাকিয়ে থাকা কবির সাহেবকে।তারপর গুলি চালালো জোবায়েরের বুকে।সে স্লোগান দিতে থাকলো।তাকালো মৃত কবির সাহেব আর তার মৃত বাচ্চাটার দিকে।ক্ষোভে ফেটে পরে চিৎকার করে উঠলো সে।কিন্তু এবার গুলি এসে লাগলো তার মুখে।লুটিয়ে পড়লো সে।
ফাঁকা হয়ে গেলো পুরো এলাকা।পরে রইলো কিছু মৃতদেহ।
বড়-সাহেবরা ফোন দিলেন।বললেন,’কয়টা মরছে?’
বড়-অফিসার বলল,’১২থেকে ১৫টা।‘
জলদি সরাও তাদের লাশ,ফাঁকা কর রাস্তা,অতিথিরা যে চলে এসেছে কাছেই।
সরাতে লাগলো লাশগুলো সবাই মিলে।অনেকেই কাঁদছে,কি করে ফেলেছে তারা!দুজন তখনও জীবিত।এক কনস্টেবল বুটের বাড়ি মারল কয়েকবার রিকশাচালকের মাথায়।মাথা ফেটে,মগজ বেরিয়ে মারা গেলো সে।আরেকজনকে গুলি করে মেরে ফেলল অন্য এক কনস্টেবল।
লাশগুলো তাদের বড়-গাড়িতে তোলা হয়ে গেছে ততক্ষণে।বড়-অফিসার আরেকবার নজর ফেরালেন চারিদিকে।একটা ক্যামেরা পড়ে আছে।সাংবাদিক সাদেকের ক্যামেরা।তুলে নিয়ে দেখলেন এক্ষণও চালু আছে।রেকর্ড হচ্ছে সব।
মাটিতে রেখে বুটের হিল দিয়ে মারতে লাগলো ক্যামেরাতে।গুড়ো করে দেওয়ার পর লাথি দিয়ে সরিয়ে দিলো ফুটপাতের ধারে।আর এক অট্টহাসি দিয়ে বলল,’এখন পরিষ্কার হয়েছে রাস্তা!’
অ্যাটাক || আল ইয়াসার আরাফাত
আল ইয়াসার আরাফাত একজন উদ্যমী ছাত্র, যিনি সম্প্রতি তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করেছেন। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখিতে অত্যন্ত আগ্রহী। বই পড়া তার নিত্যদিনের অভ্যাস, যা তার জ্ঞানের পরিসরকে বিস্তৃত করেছে। আল ইয়াসার মাঝে মাঝে ছোট গল্প ও কবিতা রচনা করে থাকেন, যা তার সৃজনশীলতাকে প্রকাশ করে। লেখালেখির মাধ্যমে তিনি তার চিন্তাভাবনা ও অনুভূতিগুলো সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে ভালোবাসেন। ভবিষ্যতে তিনি তার শিক্ষাজীবন ও সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে সমাজে একটি বিশেষ স্থান প্রতিষ্ঠা করার দিকে মনোযোগী।