বাবার ঘ্রাণ

  • মুহাঃতাসদীকুল হক
  • Category: ছোটগল্প
  • Published on: Monday, Mar 24, 2025

তখন ছাত্রজীবনের গায়ে হাওয়া লাগানো সুখ ছেড়ে সবে বাস্তব জগতে পা দিয়েছিলাম। নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে হঠাৎই বেকার তকমায় নামিয়ে দিয়েছিল সবাই আমাকে। হাতেগোনা ক'টা টাকা নিয়ে অন্ধকার এক মেসে উঠে পড়লাম। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ!

রোজ ভোর হয় আর একটাই প্রার্থনা করি," আল্লাহ! আজকে যেন চাকরিটা হয়ে যায়!" আমার সমবয়সী ছেলেরা যেখানে অনেকেই চাকরি করে বাসায় টাকা পাঠায় সেখানে আমি উলটো পরিবার থেকে টাকা নিই। বাবা অবশ্য কখনো কিছু বলেন নি, কাউকে বলার সুযোগও দেন নি। কেউ বললেই বলত, "আরে কেবল বের হইছে! চাকরি হবে নিশ্চয়!"

একদিন মেসের রুমমেট ভাইয়ের চাকরি হয়ে গেল। বেশ বড়সড় একটা কোম্পানির ম্যানেজার পোস্ট। বেতনও বেশ ভালো। কাঁদতে কাঁদতে বলল, " এই অন্ধকার মেস খুব ভয় লাগত রে! মনে হত আর পারব না! ওদিকে পরিবারের হাল ধরতে হবে! বেশ তাড়া ছিল। এই চাকরিটা না হলে যে কি হত! খুব ইচ্ছে ছিল বাবা-মা আর ওই ছোট্ট বোনকে নিয়ে একসাথে বড় মাছ-ডাল- সবজি দিয়ে ভাত খাব! স্বপ্নটা বোধহয় পূরণ হচ্ছে রে।" ভাইয়ের বাবা এসে নিয়ে গেল ভাইকে। ভাইয়ের বাবার 

চোখটা কথায় কথায় বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ছে। ভাগ্য ভালোই ছিল বলতে হয়। ছেলেকে স্বপ্নের আসনে বসতে দেখে গেলেন।

ছাত্রজীবনে বেশ কয়েকবারই বাবাকে জ্যামের এই শহরে নিয়ে এসেছি। হইহই করে অনেক জায়গায়ও ঘুরিয়েছি। সময়ের পরিক্রমায় নিঃস্ব আমি আর এখন ডাকতে পারি না। বাবাও সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছে। পেনশনের ক'টা টাকায় হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে মা। মন খারাপও লাগত। হঠাৎ একদিন ঠিকানা খুঁজে বাবা হাজির। ব্যাগে নিয়ে এসেছে বাবার পছন্দের শার্টটা। বলল," প্রতিদিন এখানে-ওখানে যাস। এই শার্টটা রাখা। এইটা রেখে আমার আর কাজ নেই। " এরপর বাবার হাত ধরে বের হলাম এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর বাস্তবতা নিয়ে আলাপ করতে। বাবা-ছেলে হেঁটে হেঁটে জীবন যুদ্ধের অনেক কথা হল। ফেরার সময় বাবার পকেটের একমাত্র সম্বল পাঁচশ টাকার নোটটা ধরিয়ে দিয়ে গেল। বলল, "খালি হাতে এসেছি। কোন খাবারই আনতে পারি নি। এখানে কি সব খাস! এটা রাখ তো! কিনে নিস কিছু।" ফেরার কথা নিয়ে ভাবতেই "আরে চলে যাব কোনমতে ! তোকে এত আব্বাগিরি দেখাতে হবে না!" কান্না ধরে রাখতে পারি নি সেদিন।

অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। বেকার তকমা সরিয়ে সরকারি চাকুরি পেয়েছি। অকর্মার তকমা থেকে বেরিয়ে ধাপে ধাপে আদর্শ ছেলে,স্বামী,বাবা হয়েছি। আজ বেশ বড়ো একটা মিটিং আছে অফিসে। ট্রাঙ্ক ঘাটতে গিয়েই বের হল সেই শার্টটা। গায়ে জড়াতেই বাবার এক ঘ্রাণ পেলাম। মেলাদিন হল, বছর দুয়েক তো হবেই, এই ঘ্রাণটা পাই না আর। বউয়ের বারণ সত্ত্বেও ঠিক করলাম এই শার্টটা পড়েই আজকে যাব। বাবার উমে নিজেকে আবার ছোট্ট আমি ভাবার লোভ তো এত সহজে ছাড়া যায় না। হোক পুরাতন, তাও এই ঘ্রাণ মিশে থাকুক আমার শরীরে।

 

 

 

বাবার ঘ্রাণ || মুহাঃতাসদীকুল হক

 

লেখকের নাম মুহাঃতাসদীকুল হক। জন্ম ২০০২ সালে পদ্মা নদীর পাড়ে রেশমের জন্য খ্যাত রাজশাহী নগরীতে। স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে তিনি এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত। তিনি বর্তমানে লেখালেখির কাজের সাথে জড়িত।