আঁচল: অন্ধকারের আলোকবর্তিকা

  • আমানুর রহমান
  • Category: গল্প
  • Published on: Monday, Mar 24, 2025

সদরঘাটের উন্মুক্ত গঙ্গা বিষণ্ণ বর্ষার বিকেলে রক্তিম সূর্যকে গিলে ফেলছিল নিঃশব্দে। ২৬শে মার্চের প্রাক্কালে শহরের মাস্তুলে দুলছিল লাল-সবুজের পতাকা—অস্পৃশ্য উৎসবের মতো। কিন্তু নদীর ঘাটসংলগ্ন গলিগুলো ছিল অন্য এক মহাদেশ, যেখানে স্বাধীনতার আলোকরশ্মি প্রবেশাধিকার পায়নি ১৯৭১ সাল থেকেই। গলির বক্র পথে হাঁটছিলাম, যেখানে বস্তির ধূসর প্রাচীরে জমে আছে ইতিহাসের অলিখিত হায়েনাগুলো। হঠাৎ আবছা আলোয় দেখলাম এক নারীমূর্তি—নীল শাড়ির বাতাসে দুলন্ত আঁচলে মিশে থাকা এক ট্র্যাজেডির প্রতিমূর্তি। চুলের অগোছালো রাশিতে জড়ানো ছিল বিষাদের শেকল, চোখে—নিভে যাওয়া নক্ষত্রের পতনশীল রশ্মি। আঁচল! কলেজের সেই উজ্জ্বল ছাত্রী, যার কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের সুর বেঁধে রাখত সময়কে।  

 

"আঁচল... তুমি?" আমার কণ্ঠে বিস্ময় ভেসে গেল বেদনার সাগরে। সে মুখ ফেরাল, কিন্তু মুহূর্তেই ধরা পড়ল তার চোখের কোটরে জমে থাকা লজ্জার হিমশিলা। পিচঢালা রাস্তায় তার খালি পায়ের তলায় আটকে ছিল রক্তের স্ফটিক—প্রতিদিনের যুদ্ধের নীরব সংকেত।

 

সে ম্লান হাসল, "সংসার নামের ফাঁদ ছিঁড়ে আজ এই পঙ্কিল পথই আমার নিয়তি," বলল সে, গলার স্বরে বিষাদের ঘনঘটা। মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠল অতীতের আলোকচ্ছটা—যে আঁচল একদিন ছিল কলেজের মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূর্তিমতী প্রতিভা, যার কণ্ঠে মুগ্ধ হতো পুরো ক্যাম্পাস।  

 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা আমাদের প্রজন্মের মুখে এমন বাক্য! মনের গহনে জমে থাকা প্রশ্নগুলো যেন আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়তে চাইল। কিন্তু সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ আমাকে থামাল। তবে চোখের সামনে ভেসে উঠল অতীতের ছবি—সেই উচ্ছ্বাসময় আঁচল, যার প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি।আমরা পড়তাম ঢাকা কলেজে। আঁচল ছিল মেধা আর সঙ্গীতের সম্মিলন।যে কলেজের মঞ্চে দাঁড়িয়ে 'আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে' গাইতে গাইতে অশ্রু ঝরাত শ্রোতাদের। অধ্যক্ষ বলেছিলেন, "এ কণ্ঠ যেন স্বর্গের উপমা।" কিন্তু তার জীবন ছিল এক করুণ সিম্ফনি, যার নোটগুলো লেখা হয়েছিল যুদ্ধের আগুনে। এক মুক্তিযোদ্ধার স্নেহে বেড়ে ওঠা এই মেয়েটির জন্মই হয়েছিল যুদ্ধের বিভীষিকাময় এক রাতে।

 

১৯৭১ সালের কুমিল্লার গ্রামে ডিসেম্বরের রাত। পাকিস্তানি সেনাদের বুটের আওয়াজে কেঁপে উঠছিল মাটি। ডোবার পাড়ে স্তূপ করা নারীদেহ—কেউ নিষ্পেষিত, কেউ বেয়নেটবিদ্ধ, কারো স্তনে গুলির ক্ষতচিহ্ন। সেই নারকীয় নিশীথে এক মুক্তিযোদ্ধা (যাকে আঁচল ডাকত 'কাকু') শুনেছিলেন একটি শিশুর কান্না—মৃত মায়ের বক্ষ থেকে উঠে আসা এক টুকরো জীবন। কাদায় লুটোপুটি মা, মুখে জমাট বেঁধে আছে লালা-রক্তের কাদা, আর তার কোলে নবজাতক—আঁচল। কাকু তাকে উদ্ধার করেছিলেন। কাকুর কাছেই আঁচল শিখেছিল জীবনযুদ্ধের নিষ্ঠুর পাঠ। তিনি বলতেন, "মুক্তি কেবল দেশের জন্য নয়, প্রতিটি নারীর আত্মার জন্য।"  ।

 

কিন্তু ২০০১ সালের এক শ্রাবণে কাকু চলে গেলেন কর্কটরোগে। মৃত্যুশয্যায় আঁচলের হাত চেপে বলেছিলেন, "তোর মায়ের রক্তে লেখা ইতিহাস কখনো ভুলিস না।" সে ইতিহাসই হয়তো আঁচলের ভাগ্যকে করেছিলো পঙ্কিল।  

 

রাজিব—একজন ক্ষমতাধর যুবক, যার ছিল পৈতৃক সম্পত্তির বিস্তৃত সাম্রাজ্য, সামাজিক প্রতিপত্তি, আর চোখ ধাঁধানো আভিজাত্য। কিন্তু তার মোহ ছিল অন্য জায়গায়—আঁচল, যে ছিল এক বীরাঙ্গনার কন্যা। জন্মের ইতিহাস জানার পরও রাজিব বলত"তুমি তো বীরাঙ্গনার কন্যা, তোমার রক্তে দেশপ্রেমের গল্প।” অথচ আঁচল জানত, এই গল্পের অন্তরালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর বাস্তবতা।

 

অসংখ্য প্রত্যাখ্যানের পরও রাজিব দমেনি। ধৈর্য আর জেদের আগুনে একদিন সে পুড়িয়ে ফেলে আঁচলের স্বাধীনতা। অগত্যা আঁচল আত্মসমর্পণ করল—রাজিবের বাহুতে নয়, তার ক্ষমতার নিষ্ঠুর শেকলে। বিয়ের প্রথম কয়েকমাস যেন ছিল ছলনাময়ী কোনো রূপকথা—প্রাসাদোপম বাড়ি, আঁচলের কবিতার খাতা, রবীন্দ্রসঙ্গীতের মায়াময় আবেশ।

 

কিন্তু স্বপ্নের মোহ দ্রুতই গলে যেতে লাগল দুঃস্বপ্নের উত্তাপে। রাজিবের চরিত্রে নেমে এল অন্ধকার, যেখানে মাদক আর চোরাচালানের কালো হাতছানি তাকে আরও হিংস্র করে তুলল। একদিন আঁচলের কবিতার খাতা ছিঁড়ে ফেলে রক্তচক্ষুতে সে গর্জে উঠল, "বীরাঙ্গনার মেয়ে হয়ে এত লেখালেখি কেন? তোদের কাজ শুধু স্বামীর ইচ্ছের দাসত্ব করা!"

 

সেই রাত থেকে আঁচলের জীবন পরিণত হলো এক ভয়ংকর কারাগারে। প্রতিরাতে শুরু হতো অমানবিক নির্যাতনের উৎসব—লোহার রডের নির্মম আঘাত, চাবুকের ক্ষতবিক্ষত দাগ, আর রাজিবের বিকৃত উল্লাস। আঁচলের কান্না প্রতিধ্বনিত হতো দালানের দেয়ালে, কিন্তু সে চিৎকার কখনো বাইরে পৌঁছাত না। দিন শেষে, তার শরীর থেকে গড়িয়ে পড়ত লাল স্রোত—একটি সাহসী আত্মার নিঃশেষিত আর্তনাদ।

 

২০০৫ সালের এক ঘনকালো, ভয়াল আমাবস্যার রাতে আঁচলের জীবনে নেমে আসে এক দুঃস্বপ্নের বিভীষিকা। স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতায় তিনজন নরপিশাচ তার ঘরে প্রবেশ করে, মদ্যপ দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। আঁচল লড়াই করেছিল, চিৎকার করেছিল, কিন্তু সেই নৃশংসতা রুখতে পারেনি।

"তোর স্বামীই আমাদের ডেকেছে!"—একজন নরপশু বিকৃত হাসিতে বলল। তারপর তারা পরস্পর বলাবলি করল, "এটা তো মুক্তিযোদ্ধাদের বীজ, আজ একে নিশ্চিহ্ন করব!" আঁচলের আর্তনাদ, লাঞ্ছনা আর কান্নার স্রোতে রাত ভেসে গেল, কিন্তু কেউ তাকে রক্ষা করতে এলো না।

ভোর হলে রাজিব, যে একসময় ছিল তার স্বামী, তাকেই দোরগোড়ায় টেনে বের করল, উলঙ্গ, ক্ষতবিক্ষত অবস্থায়। আঁচল কাঁদছিল, ভিক্ষা করছিল একটু আশ্রয়ের জন্য। কিন্তু রাজিবের কণ্ঠ ছিল বরফের মতো শীতল ও নির্মম—"তুই এখন ব্যবহৃত পণ্য! সমাজ তোকে ছুঁড়ে ফেলবে। যেখানে খুশি চলে যা!"

আঁচল তাকিয়ে দেখল, সেই মানুষটিই তার সর্বনাশের নীরব কারিগর, যে একসময় ভালোবাসার নামে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সমাজের চোখে সে আজ কলঙ্কিত, অথচ অপরাধ তার নয়!

আঁচল মামলা করল নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে। কিন্তু আদালতের করিডরে প্রতিটি দিন যেন তাকে পুনর্বার ধর্ষণ করা হতো। উকিল জিজ্ঞাসা করলেন, "ধর্ষণের সময় আপনি কী পরিহিত ছিলেন?" পুলিশের ডায়েরিতে লেখা হলো—'পতিতালয়ের নারী, ব্যাভিচারের ষড়যন্ত্র'। সংবাদপত্রের হেডলাইন হাস্যকরভাবে বিকৃত করল সত্য—'বিরাঙ্গনা কন্যার কুরুচিকর অভিনয়'।

 

একদিন এক আইনজীবী পত্রপাঠ বলল, “মা, এই দেশে ধর্ষণের মামলায় জয়ের হার মাত্র ০.৩%। তুমি কি পরিসংখ্যানের বিরুদ্ধে লড়বে?স্বাধীনতার ৩৫ বছর পেরিয়ে গেছে, অথচ ন্যায়বিচারের দ্বার এখনো নারীর জন্য শিকলবন্দি!”

 

আঁচল প্রতিধ্বনিত কণ্ঠে উত্তর দিল, “আমার মা লড়াই করেছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য, মৃত্যুকেও তুচ্ছজ্ঞান করে। আর আমি লড়ছি সমাজের এই পুঁজে ভরা ব্যাধির বিরুদ্ধে। আমরা দুজনেই হার মানিনি। আর মানবো না।”

 

২৬তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আদালতের রায় এলো—“অপ্রতুল প্রমাণ।”

 

আঁচলের ঠোঁটে কষাঘাতের মতো হাসি ফুটে উঠল। গভীর শ্বাসে সে বলল, “১৯৭১-এ যারা নারীর শরীরে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিল, আজ তাদের উত্তরসূরিরাই আমার ন্যায্যতা শোষণ করে নিল!”

 

২৬শে মার্চ, ২০২৪। সদরঘাটের ঘুপচি অন্ধকার গলি থেকে লিখছি এই প্রতিবেদন। ঠিক তখনই, দূরে মাইকের গর্জন কানে এল—

 

"নারী মুক্তি, দেশের মুক্তি!"

 

ভিড় চিরে এগিয়ে যাই। সামনে বিশাল জমায়েত। মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে এক নারী—মাথায় লাল-সবুজের রুমাল, হাতে শক্ত করে ধরা মাইক্রোফোন। চোখ-মুখ দাউ দাউ আগুন। চিনতে অসুবিধা হলো না—সে আঁচল!

 

তার কণ্ঠে দাবানলের শপথ—

 

"আমি বীরাঙ্গনার সন্তান। মায়ের রক্তে রঞ্জিত আমার শরীর, দেশের মাটিতে আঁকা আমার পরিচয়। অথচ এই সমাজ আমাকে পতিতা বলে দাগিয়ে দিয়েছে! আমার মা অস্ত্র ধরেছিলেন স্বাধীনতার জন্য, আর আমি লড়ছি সমাজের বিষাক্ত শিকল ভাঙার জন্য। আমি জানি, মৃত্যু আসবেই। কিন্তু আমার শেষ নিঃশ্বাসও হবে প্রতিরোধের আগুন!"

 

চারপাশ থেকে উঠে এল নারীদের গর্জন। পতিতালয়ের নিপীড়িত দাসী, কারখানার ক্লান্ত শ্রমিক, ঘরের দেয়ালে বন্দি গৃহবধূ—সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। স্লোগানে কেঁপে উঠল শহর—

 

"ধর্ষণের দাগ আমাদের নয়,বরং এটা সমাজের কলঙ্ক!”

 

আঁচল এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে 'বীরাঙ্গনা সন্তান সংগ্রাম পরিষদ'। তাদের দাবি—ধর্ষণের মামলায় দ্রুত বিচার, পুনর্বাসন নিশ্চিতকরণ। স্বাধীনতা দিবসের সেই রাতে আঁচল বলেছিল, "১৯৭১-এ মা দেশকে মুক্তি দিয়েছিলেন। আজ আমরা মুক্তি চাই সমাজের যৌনলোলুপ দৃষ্টি থেকে।"  

আমার কলম ছুটে চলেছে, নোটবুকের পাতায় শব্দেরা গেঁথে যাচ্ছে প্রতিবেদন হয়ে। লেখার অন্তিম প্রান্তে এসে দেখলাম—সদরঘাটের গলিতে প্রথমবারের মতো জ্বলে উঠেছে স্ট্রিটলাইট। স্নিগ্ধ দীপ্তির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে আঁচল, তার চোখে জ্বলজ্বলে বিদ্রোহের আগুন, ঠোঁটে এক তৃপ্ত বিস্ফোরণ।

সে ধীর অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “লিখে দিও—আমি পতিতা নই, আমি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, যে একদিন এই পচে যাওয়া ব্যবস্থাকে দাহ করবে!”

আঁচলের গল্প শুধুমাত্র একটি নারীর শোকগাথা নয়—এটি বাংলাদেশের প্রতিটি নিপীড়িত নারীর সংগ্রামের অমোঘ সাক্ষ্য। সমাজের প্রতিটি অন্ধকার গলি যখন অন্যায়ের শেকল ভেঙে আলোর স্পর্শে জাগ্রত হবে, সেদিনই প্রকৃত স্বাধীনতার বিজয় ঘোষণা করা যাবে। আঁচলরা পরাজিত হওয়ার জন্য জন্মায়নি—তাদের শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে বীরাঙ্গনাদের দুর্নিবার সাহস ও অপরাজেয় লড়াইয়ের চেতনা।

 

 

 

আঁচল: অন্ধকারের আলোকবর্তিকা || আমানুর রহমান

 

অমানুর রহমান একজন সফল ব্যক্তি যিনি তার কঠোর পরিশ্রম, সৃজনশীলতা ও নেতৃত্বের গুণাবলীর মাধ্যমে অনেককে অনুপ্রাণিত করেছেন। শৈশব থেকেই তিনি তার শিক্ষায় আগ্রহী ছিলেন এবং পরবর্তীতে কর্মজীবনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেন। তার নেতৃত্বগুণ ও মানবিকতা সমাজে উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে অনেকের জীবন বদলে দিয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি উদার ও নিঃস্বার্থ, যা তাকে একটি দৃষ্টান্তমূলক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।