জুলাইয়ের স্মৃতিমাখা দিনগুলো
সূচনা কিন্তু ২০২৪ নয়, বরং ২০১৮ সাল। সে সময় দেশে সরকারি চাকরিতে প্রায় ৫৫ শতাংশ কোটা ছিলো। যা একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর অধিকারকে ব্যাপকভাবে হরণ করে। তারই প্রতিবাদে ২০১৮ সালে দেশে প্রথমবারের মতো কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তুমুল আন্দোলনের মুখে সরকার কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে এ প্রজ্ঞাপন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তৎকালীন কিছু ক্ষমতাবান মানুষের মনো:পুত হয় না। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে গুটিকয়েক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উক্ত প্রজ্ঞাপনের বিপক্ষে হাইকোর্টের আপিল বিভাগে রিট করে। ৫ জুন, ২০২৪ তারিখে মহামান্য হাইকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিগণ প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করে। ফলে পুনরায় বহাল হয় কোটা ব্যবস্থা। রায়ের পরপরই দেশের ছাত্রসমাজ পুনরায় কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। যার পরবর্তী ঘটনাগুলো ইতিহাসের পাতায় রক্তাক্ষরে লেখা হয়েছে।
দিনটি মার্চ মাসের ২০ তারিখ। এসএসসি পরীক্ষা পুরোপুরি শেষ। সাথে চলছে রমজান মাস। একদিকে পরীক্ষা শেষ হওয়ার আনন্দ অপরদিকে জীবনে আরেকবার রহমতের মাস এর আগমন। এই দুই আনন্দ মনকে প্রফুল্ল করে দিয়েছিল। কত পরিকল্পনা, কত চিন্তা-ভাবনা কই যাবো, না যাবো তা নিয়ে। অল্প অল্প করে প্রায় সব পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করি।
ঠিক ২ মাস ১৫ দিন পরে গুঞ্জন শুনতে পেলাম যে আবার নাকি দেশে কোটা ব্যবস্থা চালু হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে আবার আমার ছুটিও প্রায় শেষের পথে। মনটা এজন্য কিছুটা খারাপও। হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত শুনে মন আরও খারাপ হয়ে গেল ।
কোটা সংস্কার নিয়ে দেশে শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন এবং মিছিল-মিটিং। সত্যিকার অর্থে সমগ্র জীবনে অনেক আন্দোলন বা মিছিল-সমাবেশ হতে দেখেছি। কিন্তু এবারেরটা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিয়মিতই আন্দোলন সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতে শুরু করি। কিন্তু এরই মধ্যে একটা কঠিন সমস্যার মুখে পড়ে গেলাম আমি। হঠাৎ করে ব্যাপকভাবে জন্ডিসে আক্রান্ত হলাম। প্রথমবারের রক্ত পরীক্ষায় বিলুরুবিন ধরা পরে ৯.১। সাধারণত এর মাত্রা থাকে ১০। বাসার সকলে আতঙ্কের মধ্যে পরে গেল। আমার এমন আকস্মিক অসুস্থতার কারণে পরিবারের সকলের মন বিষন্ন হয়ে যায়। যাইহোক, কোটা সংস্কার বিষয়টি সরকারের কাছে গুটিকয়েক মানুষের ভিত্তিহীন প্রস্তাব মনে হতে থাকে। এই জন্য সরকার নানাভাবে দমন-পীড়ন চালাতে থাকে এই আন্দোলন কে দমাতে। বাসার বারান্দা থেকে মিছিল যেতে দেখেছি। আন্দোলন ধীরে ধীরে বেগবান হতে থাকে। ১৪ জুলাই তারিখে তৎকালীন স্বৈরশাসক তথা ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পোষা মন্ত্রীদের সাথে এবং মিডিয়ার সামনে একটি বৈঠক সমাবেশ আয়োজন করে। টিভির সামনে আমি আর আব্বু বসে আছি। আব্বুকে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “কি মনে হয়? দেশের অবস্থা কোনদিকে যাবে?” আব্বু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “এত বছরে যেহেতু এই জালেমের কিছু হয়নি, এবারেও মনে হয়না যে কিছু হবে।” আমি কিছু একটা বলতে যাব ঠিক তখনই টিভির পর্দায় একজন বলে উঠল, এখনই সরাসরি সম্প্রচার হবে প্রধানমন্ত্রীর মতবিনিময় সভা। কোনও কোথা না বলে দুজনে এক নজরে তাকিয়ে থাকলাম টিভির পর্দায় ।
হঠাৎ পর্দায় ভেসে উঠে সেই ফাসিস্ট জালেম শেখ হাসিনার চেহারা। শুরু হলো সভা। সাংবাদিকদের একেকটা প্রশ্নের খুব ভেবেচিন্তে উত্তর দিতে শুরু করলো মানুষরূপী জালেমটি । হঠাৎ এক সাংবাদিক এর অত্যন্ত সাধারণ প্রশ্নের উত্তরে এমন কথা
বলে উঠে জালেম সরকার এর প্রধানমন্ত্রী, যা ছাত্রসমাজ এর শান্তিপূর্ণ সকল কর্মসূচিকে বিশৃঙ্খলা ও যুদ্ধের রূপে রূপান্তর করে তোলে। হাসিনা বলে ওঠে “সরকারি চাকরি মুক্তিযোদ্ধার নাতি পুতিরা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?” জালেম সরকার প্রধানের এই কথা শুনে আমি আর আব্বু স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখে এধরনের কঠিন বৈষম্যমূলক এবং বেকুব কথা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
যেহেতু জন্ডিসে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ছিলাম, ডাক্তার তিনটি স্যালাইন নিতে বলেছিল। তারই দুই নং স্যালাইন চলছিল সেই রাতে । প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্রদের প্রতিবাদে মুখরিত হয়ে যায় ক্যাম্পাস । সবার মুখে একই স্লোগান—“তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার।” তারা আরও বলতে থাকে— “কে বলেছে কে বলছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার।” এমনকি তারা আরও একটি স্লোগান দেয় তা হলো, “চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।” এমন জালাময়ী সমস্বরে দেওয়া স্লোগান শুনে গাঁয়ের লোম দাড়িয়ে যাচ্ছে। ক্যানোলার অগ্রাংশ যেটা চামড়া ভেদ করে ভিতরে ঢুকেছে হঠাৎ-ই ব্যথায় টনটন করে উঠল। বাবাকে ডাক দিলাম। বাবাকে খবরটা দেওয়া মাত্রই বাবা শুধু একটা কথাই বলল, “শোন বাবা, ৫২ তে ছাত্ররাই মাতৃভাষা বাংলা এনে দিয়েছিল। ছাত্রদের রাগলে ভালো কিছু হবে না। এবার দেখ কি হয়।”
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। আমি এত মাত্রায় জন্ডিস নিয়ে শরীর বেশ দুর্বল। হঠাৎ-ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ভাইয়ের কল আসলো। আম্মু পাশে বসেই কথা বলছিল। ভাই বলল, “খালা দেশের অবস্থা তো ভালো মনে হচ্ছে না। আজকে সিনিয়ররা ডাকছে। ১১ টার পরই সবাই আন্দোলন এ বের হব।” আম্মু বলল, “বাবা সাবধানে থাকিস। আর এগুলোর মধ্যে এত যাস না। কোনো খারাপ পরিস্থিতি হওয়ার আগেই বাসায় চলে আসিস। হলে থাকা লাগবে না তোর।”
আরও কিছুক্ষণ ভাইয়ের সাথে কথা বলে কল রেখে দিল মা।সকাল থেকেই অনেক শিক্ষার্থী একসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলন এ যায়। তবে দুপুর গড়াতে না গড়াতেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন ওরফে হেলমেট বাহিনীর হিংস্র জন্তুগুলো আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। একদিকে ছিলো খালি হাতে থাকা সাধারণ শিক্ষার্থী, যাদের মনে ছিলো অসীম সাহস। অপরদিকে ছিলো হেলমেট বাহিনীর জানোয়ারগুলো যাদের হাতে ছিলো ধারালো অস্ত্র, লাঠি এমনকি কারো কারো কাছে পিস্তল। মাঝখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে পুলিশবাহিনী যারা সার্বিকভাবে ছিলো মনুষত্যহীন। সেই দিন হেলমেট বাহিনী ব্যাপকভাবে হামলা চালায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর। ছাত্র-ছাত্রীরা মারাত্মকভাবে আহত হয়। অনেকের মাথা ফেটে যায়। সেই দিনের ভিডিও ফুটেজগুলোতে স্পষ্টই দেখতে পেরেছি মনুষত্যহীন পুলিশদের নীরব দর্শকের ভূমিকা। দিনটা কেমন জানি বিষন্ন ছিলো। বিকালে আমার বিলুরুবিন পরীক্ষা করতে যাওয়ার কথা। আব্বু আর আমি বের হই। যাচ্ছি ইসলামী ব্যাংক হসপিটাল এ। যাওয়ার সময় মিরপুর-১০ এর দিকে একটা ছোটখাটো জটলা যেতে দেখলাম। মন চাচ্ছিল যে অধিকার রক্ষার্থে তাদের সাথে আমিও যোগ দেই। কিন্তু শরীর বেশ দুর্বল। মনের জোর থাকলেও পাচ্ছি না শরীরে কোনও শক্তি। টেস্ট করে বাসায় ফিরলাম। খবর পেলাম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর সেই ভাই নাকি সুস্থ
আছে।
হেলমেট বাহিনীর ন্যাক্কারজনক কাজের কথা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পরে। সাধারণ ছাত্রদের পক্ষ থেকে সমন্বয়করা সরকারকে ৯ দফা দাবি বেধে দেয়। তবে ১৬ জুলাই সকাল সাড়ে আটটার দিকে হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। ৩য় স্যালাইন দেয়া শেষ ইতোমধ্যে। একেক টা স্যালাইন চলে প্রায় ১২-১৩ ঘণ্টা। আজকে হাত থেকে ক্যানোলা খুলে দেওয়ার কথা। চোখ এখনও আগের মতো হলুদ। হ্যাট মুখ ধুয়ে নিলাম। আম্মু খাবার এনে খাইয়ে দিল। সারাদিন তেমনভাবে টিভি বা মোবাইল খুললাম না। বেশ খারাপ লাগছিল দেখে প্রায় সারাদিনই শুয়ে ছিলাম। সন্ধ্যার দিকে ফেসবুক এ ঢুকে গা শিউরে উঠল। পুরো নিউজফিড জুড়ে শুধুমাত্র একটি ভিডিওই দেখতে পেলাম। ভিডিও তে দেখলাম যে যুবক বয়সের এক ছেলে আন্দোলনের সময় মনুষত্য ও বিবেকহীন পুলিশবাহিনীর সামনে বুক পেতে দাড়িয়ে আছে আবু সাইদ নামক এক ছেলে। পুলিশ তাঁকে পরপর দুইটি গুলি করে। দুই কদম যেতে না যেতেও রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে সে। পরে হাসপাতাল এ নিলে সে মারা যায়। মানুষের কমেন্টস থেকে জানতে পারলাম যে সে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র ছিলো। ২৬ বছরের এই মেধাবী ভাইটি কোনও অপরাধ ছাড়াই পুলিশ এর গুলিতে মারা গেল। সবচেয়ে অবাক হলাম আওয়ামী লীগ এর মনুষত্যহীন সমর্থকদের কমেন্ট দেখে। যেখানে, ভিডিও তে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে পুলিশ তাঁকে কাছ থেকে গুলি করে মেরে ফেলে, সেখানে তারা নির্দ্বিধায় তা অস্বীকার করছে বিষয়টি। যাই হোক, আবু সাইদ এর মৃত্যুর পর দেশে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। বাঙালি মানুষ মুক্তিকামী হতে শুরু করে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি খারাপ দেখে ১৬ জুলাই রাত থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
রাতে আব্বু জন্ডিস টেস্ট এর রিপোর্ট নিয়ে আসে। বিলুরুবিন এর মাত্র আরও বেড়েছে। এখন ১৫.৬। তবে দেশের যে অবস্থা, এত কিছু দেখার পর শরীর এর অস্বাভাবিকতাতে তেমন বিচলিত হলাম না। দিন দিন অবস্থা আরও খারাপ হলো। ৯ দফা থেকে দাবি ১ দফায় পরিণত হয়ে গেছে। সবার দাবি এখন শেখ হাসিনার পদত্যাগ। এভাবে দিন গড়াতে লাগলো।
১৯ জুলাই, শরীর যে খুব ভালো তা না। মানসিকভাবে আন্দোলনে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও শারীরিকভাবে সেই পরিমাণ শক্তি নেই। খবরে দেখলাম সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্ররা এক হয়ে আন্দোলনে নেমেছে। শুধু তাই নয়, স্কুল-কলেজ এর শিক্ষার্থীরাও ঝাঁকে ঝাঁকে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনে নামতে শুরু করেছে। এই দিনে হঠাৎ করে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেল। ভাবলাম হয়তো কিছুক্ষণ পরে কল আসবে। কিন্তু সারাদিনেও আর ইন্টারনেট ঠিক হলো না। পরে দেখলাম আওয়ামী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জোকার জুনায়েদ আহমেদ পলক মিডিয়ার সামনে এসেছে। শুনতে লাগলাম তার বেকুব বক্তব্য। তার ভাষ্যমতে, “ইন্টারনেট নাকি বন্ধ করা হয় নি, এমনি এমনি বন্ধ হয়ে গেছে।” তার এরকম হাস্যকর মন্তব্য শুনে হাসতে লাগলাম।
পরদিন ২০ জুলাই সন্ধ্যায় বসে আছি। এই কয়েকদিন ধরে শরীর আগের চেয়ে কিছুটা ভালো অনুভব করছি। তবে পুরোপুরি সুস্থ নয়। যেহেতু ইন্টরনেট ব্যবহার করতে পারছি না, তাই দেশ-দশের খবর দেখার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে টিভি দেখছি। রাট দশটার খবরে জানানো হলো রাত ১২ টা থেকে নাকি কারফিউ জারি হবে। নিজের জীবনে প্রথমবার কারফিউ দেখব।সরকারের হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেমন জানি সন্দেহজনক। পরদিন দুপুর ১২ টা পর্যন্ত কারফিউ চলতে থাকে। এরপর মাঝে ২ ঘণ্টার বিরতি দিয়ে পুনরায় কারফিউ বহাল থাকে। এভাবে দেশের অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকে। বাঙালর
দামাল ছাত্ররা ২০২৪ সালে এসেও যেন ৫২ কে দেখিয়েছে। ৫২-এর মতোই বাংলার দামাল ছাত্ররা কারফিউ উপেক্ষা করে আন্দোলন করতে থাকে।
২৫ জুলাই সকাল ১১ টা ৩০ মিনিট। ঘুম থেকে উঠে অনেক বেশি ক্লান্ত অনুভব করি। আজকে আবার বিলুরুবিন টেস্ট দিতে যাওয়ার কোথা। ঘুম থেকে ওঠার পরপরই আম্মু কেমন জানি আতঙ্কের চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, “কি আম্মু কিছু হইছে নাকি?” আম্মু বলল, “তোর বড় বন ফোন দিছিলো। তুই নাকি ফেসবুকে উল্টা-পাল্টা পোস্ট করতেছিস?” আমি বললাম, “উল্টা-পাল্টা পোস্ট কোথায় করলাম? যেটা ন্যায্য, ন্যায় কথা সেটাই করতেছি। এই জাওয়াদ কখনোই এরকম বৈষম্য বা অন্যায়কে সহ্য করতে পারবে না।” আম্মু বলল, “বেশি বড় হয়ে গেছিস? শুনছি এরকম পোস্ট যারা করতেছে তাদেরকেও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমি এত কোথা শুনব না, তুই এখনই সব পোস্ট ডিলিট করবি।” আম্মুর সাথে এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি চলতে থাকে। এক পর্যায়ে আম্মু আমাকে রীতিমত বাধ্য করে পোস্ট গুলো ডিলিট করায়। ওইদিন আম্মুর উপর আমার বেশ রাগ হয়। অসুস্থতার কারণে এতদিন আন্দোলনে যেতে পারিনি। তবে আজকে যাবই যাব নিয়ত করে ফেল। বিকলে ফোন দিলাম আন্দোলন এ যাওয়া এক বন্ধুকে। কল ধরা মাত্রই সে হাপাতে হাপাতে জিজ্ঞেস করে, “বন্ধু তোর শরীর কেমন?” সত্যি কথা বলতে সেই বন্ধুর মুখের কোনও কোথায় আমি এতদিনে কখনও আবেগী হয়নি। তার এই একটি প্রশ্ন করাতে আমার অনেক গর্ব হলো এমন একজন বন্ধু পাওয়াতে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমি আছি ভালোই, তুই এখন কোথায় আছিস আর কেমন আছিস?” কল এর ওপাশে চলতে থাকা স্লোগান আর বন্দুকের গুলির শব্দ আমার কানে আসে। রক্ত যেনো টগবগ করে ফুটতে শুরু করে। বন্ধু বলল, “আমি মিরপুর-১০ এ আছি। আলহামদুলিল্লাহ, এখন পর্যন্ত ভালোই আছি।” কোথা শেষ কাওয়ার আগেই কলের ওপাশ থেকে কে যেনো চিৎকার করে বলে উঠল, “এই ওর গুলি লাগছে, ওর গুলি লাগছে।” কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিলাম কিন্তু বন্ধুর কণ্ঠে হ্যালো শুনে আবার সাহস ফিরে পেয়েছিলাম। আমি বললাম, “তুই থাক আমি আসতেছি।” বন্ধুকে আর কোনো কোথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলাম।
বিকাল ৪ টা ১২ মিনিট। আম্মুকে বললাম, “আম্মু আবিরের বাসায় যাচ্ছি।” [বি.দ্র: আবির আমার বন্ধু।] আম্মু এক শব্দে বলে দিল, “না”। মন মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। আমি আবার পাল্টা প্রশ্ন করলাম,”কেন?” আম্মু বলল, “দেশের অবস্থা কি দেখতেছিস না? যাইতে মানা করছি মনে যাবি না।”
(L
আমি বললাম, আমার দরকার আছে মানে আমি যাব। পরীক্ষা শেষ হয়েছে কতদিন হল। এখন পর্যন্ত কোন বই নাই যে পড়া শুরু করব। আমি যেয়ে বইটা নিয়ে চলে আসবো। " আমার শরীর যে খুব ভালো তা নয়। তারপরও মনের সাহস দেখিয়ে আম্মুর সাথে তর্ক-বিতর্ক করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। যদিও আম্মু শেষ পর্যন্ত এটাই বিশ্বাস করে নিয়েছিল যে আমি আবিরের বাসায় যাচ্ছি। রাস্তায় বেশ কয়েকদিন পর নামলাম। মাথা হালকা ঘুরছিল। রাস্তা পুরাই ফাঁকা। মনে হচ্ছে করোনাকালীন সময় চলে এসেছি। বের হয়ে মেইন রোডের দিকে যেতে শুরু করলাম। একটা মাত্র চায়ের টং দোকান শুধুমাত্র খোলা দেখলাম। যেখানে দুইজন বসেছিল। মেইন রোডের দিকে যেতে না যেতেই দেখতে পেলাম ১০ থেকে ১৫ জনের একটি জটলা মিরপুর ১০ এর দিকে আগাচ্ছে। তাদের সাথে আমিও মিশে যাই। মিরপুর ১০ এর দিকে যত এগোতে থাকি গুলি এবং স্লোগানের শব্দ তত তীব্র হতে থাকে । হঠাৎ শরীরে কেমন জানি অদৃশ্য শক্তি এসে পড়ে। শরীরে যত শক্তি আছে সবটুকু দিয়ে স্লোগান দিতে
শুরু করি। ১০ এর কাছাকাছি যেতেই দেখা যা হয়ে যায় সেই বন্ধুর সাথে। এভাবে স্লোগান এবং ফাঁকে ফাঁকে ইট পাটকেল নিক্ষেপ চলতে থাকে। ৩০-৪০ মিনিট পর হঠাৎ আম্মুর কল। প্রথমবার ধরিনি, দ্বিতীয়বার ধরিনি, এমনকি তৃতীয়বারও ধরিনি। চতুর্থবারেও ধরতাম না তবে হঠাৎ মনে হল যদি আমার কিছু হয়ে যায় আর তো কথা বলতে পারব না। তাই একটু দূরে গিয়ে কল ব্যাক করলাম। সালাম দিতেই আম্মু জোরে করে কেঁদে উঠলো। জিজ্ঞেস করল, “কই তুই?”
আমি বললাম, “আবিরদের বাসার নিচে।” এবার কিছুটা ধমকে সুরে বলে উঠলো, “আমার সাথে মিথ্যা কথা বলোস? তোর এত বড় সাহস। তুই এখনই যেখানেই থাকিস বাসায় আয়”। আমি বললাম, “একটু পরে আসি”। আম্মু এবার আবার কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুই ১০ মিনিটের মধ্যে বাসায় আসবি। " আমি ঠিক আছে বলে কল রেখে দিলাম। তারপরও আরো এক ঘন্টা ছিলাম। যার মাঝখানে প্রায় ৩০ বারের মতো কল দিছে। বাসায় ঢোকামাত্রই আম্মু কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে বলল, “এভাবে মিথ্যা বলে যাওয়াতে যদি তোর কোন ক্ষতি হয়ে যেত তখন কে দেখতো?” আমি বললাম, “আমার ভাইয়েরা জীবন শেষ করে দিচ্ছে দেশের জন্য সেখানে আমি কাপুরুষ এর মত একজন ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া ছেলে হয়ে কিভাবে ঘরে বসে থাকি।”
খবরে অনেক নিউজ দেখি দেশের অবস্থা। দিনশেষে সাধারন জনগণ সবার দাবি একটাই। তাহলে হাসিনার পদত্যাগ। শরীর আবার খারাপ হতে শুরু করে। এর মধ্যে আরেকবার পরীক্ষা করে। বিলুরুবিনের মাত্রা খুব যে কমেছে তা নয়। ১৫.৬ থেকে আবার ১১.৩ এ নেমেছে। ইতিমধ্যেই শুনতে পাই ছাত্রলীগ নাকি ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করছে ছাত্রদের বিপক্ষে। এভাবেই কিছুদিন কেটে যাওয়ার পরে ২৭ এ জুলাইয়ে পুনরায় ইন্টারনেট ব্যবস্থা সচল করা হলো। ২৯ জুলাই পুরো বাংলাদেশে এক ব্যাপক সংঘর্ষ সংঘটিত হলো সাধারণ ছাত্র বনাম বাংলাদেশের সরকার এর সাথে।
এভাবেই দেখতে দেখতে ৩ আগস্ট, ২০২৪ লংমার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় যা সংঘটিত হবে ৬ আগস্ট ২০২৪। তবে ৪ আগস্ট রাতেই ঘোষণা করা হয় যে লংমার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ৬ আগস্ট নয় বরং সংঘটিত হবে ৫ আগস্ট ২০২৪। অর্থাৎ একদিন এগিয়ে আনা হয়। সেদিন রাতে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি যে পরদিন এই কর্মসূচির সাথে আমিও যাব গণভবনের দিকে। যেই ভাবা সেই কাজ মোবাইলের ওয়ালপেপারে নিজের যাবতীয় তথ্য দিয়ে সেভ করে নিই। পরের দিন সকালে যখনই বের হতে যাব তখনই আম্মু বাধা দিতে শুরু করে কান্নাকাটি করতে শুরু করে। বাড়ির সবাই এক হুলস্থুল কাণ্ড শুরু করে। সবাইকে বুঝেও শেষ পর্যন্ত বের হতে পারিনি সকালে। রাগ করে অভিমানে সকালে না খেয়েই ঘরে বসে ছিলাম। তবে ঘরে বসে থাকলেও মন তো ছিল সড়কে। টিভির সামনে বসে সর্বক্ষণই সেই খুশির সংবাদ এর অপেক্ষা করছি।
৫ আগস্ট দুপুর ১টা। কেবলই বন্ধু তামিমকে ফোন দিয়েছি তারা নাকি এখনই গণভবনের উদ্দেশ্যে বের হবে। আমি বললাম এখন আমিও যাব আর আম্মুর কথা শুনবো না। কল রেখে দেওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে আবার কল ব্যাক করল। সে বলল, “বন্ধু শেখ হাসিনা তো পদত্যাগ করছে। তাড়াতাড়ি খবর দেখ।" আমি টিভি খুলে বসলাম। দেখলাম আসলেই প্রত্যেকটি টিভি নিউজ চ্যানেলের শিরোনামে এই একই সংবাদ। সুন্দর করে লেখা পদত্যাগ করলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজের মনে যে কি পরিমানে আনন্দ হয়েছিল সেই দিন কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না। এতগুলো জীবন কেড়ে নিল শুধুমাত্র এই পদত্যাগের জন্যই। শেষ পর্যন্ত কি হলো তার। মহান আল্লাহর কাছে দুই রাকাত নফল আদায় করলাম শুকরিয়া স্বরূপ। বন্ধুকে আবার কল দিলাম যে এখন গণভবনে যেতেই হবে। অন্তত আনন্দ উদযাপনের জন্য হলেও। বন্ধু, তার ভাই এবং আমি বেরিয়ে পড়লাম গণভবনের উদ্দেশ্যে পায়ের যাত্রা করে। ১০ নাম্বারে জীবনে কখনো এত মানুষ দেখি নি সেদিন যত মানুষ দেখেছি। সকলের মুখেই হাসি। সুখের হাসি। আনন্দের হাসি। পুরো ১২ কিলোমিটার পথযাত্রা করে পায়ে হেঁটে সেদিন গণভবনে গিয়েছিলাম। শরীরে তখনো জন্ডিসের রোগ রয়েছে। তারপরও তাকে আর ভ্রুক্ষেপ করার সময় নেই। সেদিন গণভবন থেকে
ফিরেছিলাম রাত বারোটায়। মনের প্রশান্তি কি প্রশান্তি আহা প্রশান্তি। সেদিন রাতেও বেশ কয়েক জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছিল পুলিশের সাথে সাধারণ মানুষের। তবে দিনশেষে সুখ এক জায়গায় যে সেই জালেম দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে নেই ।
সর্বোপরি সব ঘটনা বহুল শেষে আগস্টের ৮ তারিখ হতে সমগ্র দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয় এবং আমারও কলেজ
শুরু হয়।
এভাবেই দিন চলে যায়, দিন চলে যাবে। স্মরণ এবং ইতিহাসের পাতায় সর্বদাই রয়ে যাবে আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ফারহান এর মতো নাম না জানা অনেকে। আমরা একসময় বইয়ের পাতায়, রচনা লেখায় পড়তাম ৫২ আন্দোলনে রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত সহ নাম না জানা অনেকের শহীদ হয়। তখন হয়তো আমি ছিলাম না। কিন্তু ২৪ এর আন্দোলনে তো ছিলাম। এও যেন এক বিরাট স্বাধীনতা। এখন হয়তো মানুষ পড়বে বইয়ের পাতায় ২৪ এর বৈষম্য বিরোধী কোটা আন্দোলনে আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ফারহানের মত নাম না জানা অনেকের শহীদ হয়। আজ ইতিহাস সাক্ষী হয়ে রইল এসকল ঘটনার।
বাংলা একটি কথা রয়েছে, “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা বেশি কঠিন” আসলেও তাই।
তাই আমাদের মাথায় সবসময় রাখতে হবে যে দেশের স্বাধীনতা আমার কোন কর্মকান্ডে কিংবা আমার দেশের কোন মানুষের কর্মকাণ্ডে যাতে ক্ষুন্ন না হয়। তাহলেই জীবন সুন্দর হবে এবং দেশ নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাবে উন্নতির দিকে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলার মানুষের, সমগ্র বাংলাদেশের ছাত্র জনতার এক অনন্য প্রচেষ্টার ফলাফল। এই বিপ্লবে অবদান আমার আপনার সকলের। দেশকে ভালোবেসে দেশের উন্নতির জন্য তাই আমাদের সকলের উচিত নির্দ্বিধায়, নির্লোভে কাজ করে যাওয়া।
জুলাইয়ের স্মৃতিমাখা দিনগুলো || জাহিন জাওয়াদ
জাহিন জাওয়াদ মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের একজন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি বই পড়তে ভালোবাসেন এবং বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে লেখালেখি করেন। তার প্রবন্ধগুলোতে তিনি জীবনের নানা বাস্তবিক চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে, তার সাম্প্রতিক লেখায় তিনি জুলাই মাসের বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন, যা পাঠকদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে। লেখালেখির প্রতি তার এই অনুরাগ ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধ হবে বলে আশা করা যায়।