চুরি
- কোন সমস্যা হবে না তো?
- নেহি নেহি! কুচভি নেহি হোগা!
- বুঝো কিন্তা
- আরে সাব! এক বুড়ি ওউরাত ছাড়া কই
- নেহি হে! রিলেক্স কিজিয়ে!
- ঠিক আছে,নাও তোল..১ ২ ৩....
রাত একটা বাজছে | রাত অনেক বেশি,মেঘ জমলেও বোঝা যাচ্ছে না |
- দেখে তো মনে হচ্ছে বেশিদিনের না!
- নেহি সাব! এক হাফতা হোগা জিয়াদা সে জিয়াদা!
- কাপড়টাও তেমন ময়লা লাগছে না,ফর্সাই আছে |
- হু!
- এখন নিয়ে যাব,বলো কোন সমস্যা আছে কি না! যদি পরে খোঁজাখুজি লেগে যায়!
- সামাঝবেই না! খালি এক বুড়ি ওউরাত আসে,প্রায় প্রতিদিনই আসে,কান্না করে, হাম লে যাতে হে,আল্লাহ ভরসা!
- আল্লাহ আমাদের এ কাজে সহায় করবে বলে তোমার মনে হয়?
- না সাব! তবুও তিনিই তো লিখসেন,সাব তার লেখার ফল! আজ হে,কাল নেহি, কদিন পর এই কাবারমে আনা পাড়েগা!
- কথা কম! এটাকে ভ্যানে তোলো, আর কবরটা আবার মাটি দিয়ে ভরে দাও,বোঝা যেন না যায় |
হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে | জেল হোসেন আর লাকি আলী একটি লাশ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন| খুব জোরে বৃষ্টি শুরু হলো | তবে জেল হোসেন বৃষ্টির কোনই তোয়াক্কা করেন না| গত বার বছর ধরে এটা তার কাজ, এখন ডালভাত |
- সাব আ গায়া!
- নেও, পা ধরো তুমি,আমি সামনের দিকটা ধরছি|
- বহুত জেয়াদা ওয়াজান লাগছে!
- মেবি কোন পুরুষ মানুষের লাশ |
- কিউ? ওউরাতও হতে পারে!
- সম্ভব! উফ! নাও, ঐ স্ট্রেচারটাতে রাখি!
বড় না,তবে গোডাউনটা খুব গোছালো,সবকিছু খুব সুন্দরভবে সাজানো, মনে হয় প্রায়ই এখানে কাজ করা হয়,কেমন কাজ তা বোঝা যাচ্ছে।
- সাব! পেইসা?
- দিবো দিবো! একটা সিগারেট ধরাও!
- ভিগ গায়া!
- মহিলাটা কি কালও আসবেন?
- আয়েগি সাব! আয়েগি! হার দিন আসে!
- তুমি এমন হিন্দি উর্দূ বাংলা সংকর বলা বন্ধ করো! অসহ্য লাগছে!
- ঠিক হেয়! ইয়া খোদা! রেহেম কার!
- এই নাও টাকা! বহিষ্কার হও!
- সাব লাইট! (একটা ছোট টর্চ লাইট আগায় দিয়ে
- হুম (হাতে নিয়ে)
- সেলাম সাব!
লোকটা খুব বেশি কথা বলে,আবার জারজ ভাষায় কথা বলে,শুনলেই ইচ্ছা করে থাপড়ায়ে পাইনেট করে রেখে দি কিন্ত লোকটা অনেক সাহায্য করে,সাহায্যকারীকে ছোট করে দেখতে নেই,সে যেই হোক না কেন,যে কাজের জন্যই হোক না কেন!
এমন চিন্তা করতে করতে জেল হোসেন স্ট্রেচারের দিকে যায় | চোখে মুখে কোন ভংগিমা নেই,যত দ্রুত কাজটা করার,করতে হবে| অর্থই প্রধান এই পৃথিবীতে! অক্সিজেন,পানি,মাতা পিতার পরেই টাকা পয়সার স্থান! আর উপরে তো আছেনই! সবই তার ইশারার অপেক্ষায়|
বডিটা জেল হোসেনের পছন্দ হয়েছে,কারণটা বয়স! বয়স বেশিও না আবার খুব কমও না,তেমন পঁচেও নি,প্রচুর অর্থ শুয়ে আছে তার সামনে,মৃত হয়ে |
তার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম হাতের কাছে আনলেন,একটা টুলের মত,তার ওপরে সব রাখা| সামনে টাকার বস্তা,কাটাকুটি করা দরকার| একটা হলুদ বাল্ব জ্বলে ঝুলছে তার মাথার উপর,যা যা দরকার বের করা হচ্ছে| কখনও সার্জারি না করলেও ডাক্তারি জিনিসপত্র সম্পর্কে ধারণা তার অগাধ আছে| কাটতে পারলে,আর সেলাই পারলেই মামলা ডিসমিস! ভেতরে কি কেমন হয়ে থাকল মাথা ব্যথা নেই| সব অস্ত্রপাতি ঠিকভাবে লাইনমত সাজাচ্ছেন,মাঝে উপরের বাল্বটা হালকা নিভু নিভু করে বন্ধ হয়ে গেল | হওয়াটাও স্বাভাবিক,বাংলাদেশে হালকা মেঘ গুড়গুড় করলেও কারেন্ট থাকে না,এখানে তো তাও পশলা বৃষ্টি হইসে| কারেন্ট সমস্যার সমাধান কোন সরকারের পক্ষেই সম্ভব হবে না|
এমন ভাবতে ভাবতে টর্চটা বের করতে গিয়ে একটা স্পষ্ট গলায় আওয়াজ শুনলেন জেল হোসেন |
- আসসালামু আলাইকুম! (অজ্ঞাত কেউ)
- কে? কে? কে কথা বললো?
- আমি ভাই!
- হ্যাঁ? হ্যাঁ? কে? কে কথা বলে??
(ভাবছেন আজ তো একটু টানেনওনি!!
তাহলে মাথায় শব্দ আসে কেন?)
- আমি বলছি,একদিকে তাকান।
জেল হোসেন বুঝতে পারলেন কথাগুলো তার সামনে মৃত বডিটা বলছে| যা কিনা কোন মতেই সম্ভব না!! এখানে নিশ্চয় কেউ আছে অথবা কেউ মশকরা করে, হতে পারে একে কিছুক্ষণ আগেই মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে, তাকে ভয় দেখানোর জন্যই এই কারসাজি! তিনি মনে মনে ঐ লোককে গালি দিলেন আচ্ছামত যে তার সাথে এমন ঠাট্টা করছেন |
- কি হলো? সালামের উত্তর দেন না কেন? আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না? (একটা ঘনমত ছায়া দেখা যাচ্ছে সে স্ট্রেচারের উপর,মানুষই হবে! হতেই হবে! ভুতের ঘন অবয়ব থাকে না,ওরা অদৃশ্য,ওরা বাতাসের মত,আছে কিন্তু দেখা যায় না)
- ওয়ালাইকুম আসসালাম!
- আপনার নাম কি?
- জেহ্.. জ্.ে. জেল হোসেন
- আপনি যা করছেন তা কি ঠিক?
- (কাঁপা গলায়) জ্বি না!
- আপনি আপনি করবেন না,আমি বয়সে আপনার ছোট ছিলাম |
- ছিলাম?
- হ্যাঁ! আগে ছিলাম,এখন নেই!
- ওহ!
- আপনার কাজটা আমার পছন্দ না,পছন্দ হওয়ার কোন কারণও নেই, আপনি বুঝতে পারছেন কি বলতে চাচ্ছি?
- হ্যাঁ!
- ভয় লাগে না?
- লাগে|
- কেন? ভয়তো এতোদিন ধরে লাগেনি, এখন কেন?
- (নিশ্চুপ)
- ছেড়ে দিন, ভাল হয়ে যান
- আচ্ছা!
- লজ্জা লাগা উচিত,মৃত্যু সবারই হবে,হবে না?
- হবে
- আপনারও হবে, না?
- হবে
- আপনার দেহ নিয়ে কেউ ব্যবসা করলে কেমন লাগবে আপনার?
- (নিশ্চুপ)
- আপনি মৃত্যুকে ভয় পান না,মৃতকে সম্মান করেন না,এটা মোটেও ঠিক নয়,ভাল হয়ে যান |
- আচ্ছা (জেল হোসেন বাম হাত স্পন্দনগতিতে কাঁপছে,ঘটনা যা ঘটছে বিশ্বাস হচ্ছে না,বিশ্বাসযোগ্যও না )
- হাত কাঁপছে কেন?
- এমনি!
- ভয় পাবেন না,আমি আপনার ক্ষতি করবো না,করতে পারবো না,চাইলেও না
- আপনি আমাকে মাফ করে দিন,চলে যান
- কোথায় যাব? আর মাফ? আমিতো আপনার উপর কোন অনুভূতি দেখাতে পারব না!
- চলে যান প্লিজ!
- আবার আপনি? বয়সে ছোট আমি, ভয় পেয়েন না,খালি একটা কথা রাখতে হবে, রাখবেন?
- অবশ্যই রাখবো! বলো
- আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই রেখে আসেন, আমার মা প্রতিদিন আমাকে দেখতে আসেন,কাঁদেন,কথা বলেন, দোয়া করেন,আমি এগুলো হারাতে চাই না
- আমি অবশ্যি তাই করবো!
- আপনার কাছে সিগারেট আছে?
- না! মানে হ্যাঁ,ভিজে গেছে
- ছেড়ে দিন,বাজে জিনিস,আপনার মেয়ে এটা পছন্দ করে না
- জ্বি?
- আপনার দুই মেয়ে,ঠিক না?
- হ্যাঁ! (অবাক হয়ে
- নাম কি তাদের?
- মিমি আর মুমু
- যমজ?
- না মিমি বড় আর মুমু দুই বছর ছোট
- আপনি ভুল বললেন, মুমু বড় আর মিমি তিন বছর দুইমাস ছোট,ঠিক বলিনি?
- (ভুল বুঝতে পেরে) হ্যাঁ ঠিক বললেন!
- আপনি এখনও ভয়ে আতংকিত, ভয়ের কিছু নাই,আমি মৃত,মৃতরা মানুষের ক্ষতি করে কম, জীবিতরা করে বেশি,আপনি কাজটা ছেড়ে দিন,কাজটা ভাল না,অনেক পাপ চড়ছে,চড়তেই থাকবে,মেয়েগুলো কষ্ট পাবে|
- আমি ছেড়ে দিবো!! ওয়াদা করুন
- ওয়াদা করছি!
- আমার দেহটা যেখানে ছিল রেখে আসুন, পুতে আসুন, আপনার পাপ কমে যাবে।
- তুমি যা বলবে তাই করবো! পুতে আসব, ঘেরাও করে দিব
- তা দরকার নেই,যেমন ছিলাম তেমন রাখবেন!
- জ্বি!
- একটু পানি খাওয়াতে পারবেন? পানি খাব!
- হ্যাঁ! মানে পানি! পানি পাওয়া যাবে না মনে হয়!
- দরকার নেই,আমার মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চান?
- হ্যাঁ শুনি,বলো|
- না থাক,আপনাকে যা বললাম তাই করবেন,ভাল থাকবেন |
বাতি জ্বলে উঠল | আলো এলো,হলুদ আলো,
জেল হোসেন এর স্বস্তি ফিরে এলো, তার সামনে লাশ পড়ে আছে,কিছুক্ষণ আগেই চুরি করে নিয়ে আসা লাশ,কাফনের ময়লা কাপড়ও ঠিক তেমনভাবেই আছে,লাশের মুখ ঢাকা, সব ঠিকই আছে | ভয় আস্তে আস্তে কাঁটতে লাগল জেল হোসেনের, তার কাজ তাকে করতেই হবে | এ কাজ দিয়ে তার রুটিরুজি তার পরিবার চলে,তার স্ত্রীর দামী পোষাক,গয়না আর বাচ্চাদের প্রয়োজন মেটে এই অসৎ কাজ করে | লজ্জাবোধ আগে থাকলেও,এখন শূন্যের কোটায় | প্রয়োজন সবচেয়ে বড় শত্রু মানুষের |
লাশের সব কাজ শেষ। শুধু সেলাই বাকি। বাতি নিভু নিভু করছে। রাত কত কে জানে।
রাত ৩ টারর কিছু বেশি হবে। অন্ধকারে ভালো মতো দেখা যাচ্ছে না। কলিংবেল বাজছে। নির্ঘাত মিমির বাবা এসেছে। লোকটার কোনো ঠিকঠিকানা নাই। দরজা খুলতে যায়
- জানো কতা বাজে??
- তাতে কি হল রেহানা?
- এত রাত করে এসে বলছে, কি হল?
- আরে কাজে আটকে গিয়ে ছিলাম।
- এমন কি কাজ জে রাত ৩টা পর্যন্ত থাকতে হয়?
- ভালো লাগছেনা কথা বলতে আমি ঘুমাবো।
- খাবে না?
- না।
রেহানা জেল হোসেনের মাথায় হাত দিয়ে দেখল তার গাঁয়ে প্রচন্ড জ্বর।
এমনই চলে প্রতিদিন | দিন দিন চলার পরও রেহানার চিন্তা কমে না,চিন্তা তো নয়,দুঃচিন্তা |
চুরি || ওয়াসিফ মাহমুদ স্বরণ
ওয়াসিফ মাহমুদ স্বরণ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিষয়ে অধ্যয়নরত একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা ও আগ্রহ রয়েছে। তিনি ছোটগল্প পড়তে এবং লিখতে বিশেষভাবে পছন্দ করেন। তার লেখনীতে মানবিক আবেগ, সমাজের নানা দিক এবং জীবনের বাস্তবতা ফুটে ওঠে। ওয়াসিফের সাহিত্য চর্চা এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সমন্বয় তাকে একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হিসেবে গড়ে তুলছে। ভবিষ্যতে তিনি তার এই দক্ষতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে সাহিত্য ও প্রযুক্তি উভয় ক্ষেত্রেই অবদান রাখতে চান।