উত্তরাধিকার (নীলকান্তের অগ্নিলিপি ও সময়ের বর্ণমালা)

  • আমানুর রহমান
  • Category: ছোটগল্প
  • Published on: Thursday, Feb 20, 2025

রাতের আকাশে ধূসর মেঘেরা যেন কালির আঁচড় কাটে—অন্ধকারের ক্যানভাসে শোকের হস্তাক্ষর। রুমার শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষা; বুকের ভেতর ধুকধুকানি যেন মাটির নিচে প্রোথিত ইতিহাসের স্পন্দন। দাদুর রহস্যময় কাসার বাক্সের মুখোমুখি সে, যার গায়ে জমে আছে ১৯৫২ সালের ধূলো, লৌহগন্ধী রক্তের আবছা স্মৃতি, আর বাক্সের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া অক্ষরহীন আর্তনাদ। বাক্সটি খোলার আগেই বাতাসে ভেসে এলো এক অদৃশ্য কাশফুলের গন্ধ—যেন ভাষার শহীদদের আত্মা দরজায় কড়া নাড়ছে, তাদের শব্দহীন ভাষায় বলছে: "আমাদের কবর থেকে কথা বলো।"  

 

"এই বাক্সের ভেতর শব্দ আছে... শব্দগুলোকে খাঁচা থেকে মুক্ত করতে হবে," দাদুর শেষ কথাগুলো রুমার কর্ণে বাজে, যেন অমোঘ মন্ত্র। হাতুড়ির আঘাতে তালা ভাঙতেই বাক্সের গহ্বর থেকে উড়ে এলো পলাশ ফুলের শুকনো পাপড়ি—প্রতিটি পাপড়ি যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গে লেখা কোনো চিরকুট। বিবর্ণ চিঠির স্তূপে লুকানো ছিল রক্তাক্ষরে লেখা এক মহাকাব্য: "মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা..."। চিঠির কোণায় জমাট বেঁধে আছে অশ্রু ও লৌহের সংমিশ্রণ। সবচেয়ে নিচে লুকানো ছিল নীলকান্ত পাথর—একটি ভাষার মরদেহ থেকে জন্মানো হীরকখণ্ড, যার গায়ে জেগে আছে বর্ণমালার অদৃশ্য ক্ষতচিহ্ন। পাথরটি স্পর্শ করতেই রুমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো অগ্নিশিখায় লেখা সংখ্যা: ১৯৫২। ঘরের দেয়াল গলে গেলো স্মৃতির সুরঙ্গে; সময়ের পাঁজর ভেঙে সে পড়ে গেলো এক কালোতীর্থে, যেখানে অতীত-বর্তমানের সীমানা ধুয়েমুছে গেছে।  

 

রুমার চোখ খুললো ঢাকা মেডিকেলের সামনের রাস্তায়। চারপাশে উত্তেজিত কণ্ঠে স্লোগান: "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!"। এক তরুণীর হাতে উড়ছে কালো পতাকা, মুখে রক্ত—সালাম, বরকত, রফিকের রক্তে রাঙা ফেব্রুয়ারি। বাতাসে লাউডস্পিকারের উর্দু ঘোষণা: "সমাবেশ নিষিদ্ধ!"—যেন শব্দের সৈন্যবাহিনী। রুমার গায়ে লাগলো টিয়ার গ্যাসের বিষাক্ত স্পর্শ, চোখ জ্বলে উঠলো অশ্রুতে, কিন্তু সেই অশ্রু যেন মাটির লবণাক্ততাকে চিনে নিচ্ছে।  

 

"তুমি কোত্থেকে?" এক তীক্ষ্ণ কণ্ঠ। রুমার সামনে দাঁড়িয়ে আব্দুল জব্বারের প্রতিকৃতি—না, জীবন্ত যুবক, যার গলায় জড়ানো স্কার্ফে লেখা "আমি বাংলায় ভাবি"। তার চোখে সেই দাহন, যা ইতিহাসের পাতায় ছাইচাপা আগুন; সেই দৃষ্টি যেন বলছে, "তুমি যদি আমাদের কথা ভুলে যাও, তাহলে আমাদের মৃত্যু বৃথা।"  

 

"এই পাথর... দাদু বলেছিলেন ভাষার বেদী থেকে এটা এসেছে," রুমা জড়িত কণ্ঠে বলল, তার হাত কাঁপছে নীলকান্ত পাথরের ভার বহন করতে না পেরে।  

"ওই পাথরই তো আমাদের সময়ের সাক্ষী!" যুবকের গলার স্বর বিষাদে ভেজা, "এটা শুধু পাথর নয়, এটা মাতৃভাষার কান্নাকে স্ফটিকে বন্দী করেছে। প্রতিটি ব্যবহারে এর ওজন বাড়ে, কারণ এটা আমাদের স্বপ্নের মূল্য শুষে নেয়। দেখো..."—যুবক পাথরটি উঁচু করে ধরতেই এর গায়ে ফুটে উঠলো অদৃশ্য বর্ণমালার দাগ—যেন রক্তে লেখা 'অ', 'আ', 'ক', 'খ'।  

 

রুমা দেখে ১৪৪ ধারা ভাঙার নেশায় মাতাল ছাত্রদের মিছিল। পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাসের বিষাক্ত ধোঁয়ায় অক্ষরগুলো যেন মুখ খুলছে:  

- একটি কিশোরী রক্তে লিখছে মাটিতে "বাংলা"—তার আঙুলের স্পর্শে মাটি হয়ে উঠছে স্বর্ণখণ্ড।  

- পুলিশের বুটের তলায় পিষ্ট হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের বই—কবিতার পংক্তিগুলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে পাপড়ির মতো।  

- কারাগারে শেকলে বাঁধা এক কবি জ্বলন্ত কাগজে লিখে যাচ্ছেন চিরকুট—আগুনে পুড়ে যাওয়া শব্দগুলো ছাই হয়ে উড়ছে আকাশে, নতুন নক্ষত্র গড়তে।  

 

নীলকান্ত পাথর জ্বলে উঠলো নীল শিখায়। রুমা আবিষ্কার করলো, পাথরটি শব্দকে শক্তি দেয়—স্লোগানগুলো যেন অদৃশ্য ঢাল তৈরি করছে। কিন্তু প্রতিবার ব্যবহারে তার স্মৃতি ম্লান হয়। সে ভুলে যাচ্ছে ইংরেজি বর্ণমালা! 'A'-এর জায়গায় মনে পড়ছে 'অ', 'B'-এর বদলে 'ব'। ভাষার জাদু দ্বিমুখী খড়্গ—একদিকে মুক্তি, অন্যদিকে বিস্মৃতির বিষাক্ত ফসল।  

 

২১শে ফেব্রুয়ারি ভোর। মেডিকেলের গেটে জমেছে মানবতার মিছিল—প্রতিটি পা ফেলার শব্দে মাটি কেঁপে উঠছে। রুমার হাতে পাথরটির তাপ অসহ্য; এটি যেন গলিত লাভা, যে লাভা শব্দের আগ্নেয়গিরি থেকে নিঃসৃত। পুলিশের গুলি বর্ষণ শুরু হতেই সে পাথরটি উঁচু করে ধরল—এক স্ফুলিঙ্গে জ্বলে উঠলো ভাষা শহীদদের সমস্ত কবিতা! গুলি থেমে গেল না, কিন্তু শব্দগুলো স্টেনগানকে করলো নিরস্ত্র—প্রতিটি গুলি বন্দুকের নলেই জমে থাকা কবিতার পংক্তি।  

 

"থামো! আমাদের ভাষাকে থামাতে পারবে না!" রুমার চিৎকারে বাতাস কেঁপে উঠল। পাথরটি ফেটে গেল—স্ফটিকের টুকরোগুলো আকাশে ছড়িয়ে পড়লো নক্ষত্রমালার মতো। তারপর কেউ যেন একজন রুমার কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো, "আমাদের সময় শেষ হয়ে আসছে। হয় আমরা জয়ী হব, নইলে এই মাটির সঙ্গে মিশে যাব। তবে আমাদের লড়াই বৃথা যাবে না। তোমার ফিরে যাওয়ার সময় এসেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের গল্প তুলে ধরো।"  

 

ভগ্ন পাথর থেকে প্রেরিত আলোকরশ্মি রুমাকে অদ্ভুত আলোয় মোড়ানো সময়চক্রে প্রবেশ করালো—যেন কোয়ান্টাম সুতোয় বোনা এক টাইমলুপ।  

 

রুমা যখন বর্তমান সময়ে ফিরে এল, তখন তার হাতে ছিল পাথরের খণ্ডাংশ—এখন তা নিষ্প্রাণ, যেন ভাষার মমি। সে বুঝল, নীলকান্ত পাথর কোনো জাদুর বস্তু নয়; এটি সময়ের গোপনীয়তার এক ভয়ংকর অস্ত্র—যা শব্দকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে, কিন্তু প্রতিদানে ভূতের মতো শুষে নেয় স্মৃতির রস।  

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তখন ছাত্র আন্দোলন উত্তাল। তরুণ প্রজন্ম রাষ্ট্রীয় স্বৈরশাসক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠেছে। তাদের চোখে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ভাষা সৈনিকদের সেই একই জ্যোতি, যা রুমা দেখেছিল সময়ের পরিভ্রমণে। রুমা তাদের সঙ্গে যুক্ত হলো—তার কণ্ঠে শোনা গেল সত্যের শক্তি, যেন ৫২'র যুবকেরা তার ভোকাল কর্ডে আশ্রয় নিয়েছে। সে লিখে চলেছে দেয়ালে, ৫২ দেখেনি,২৪ দেখিছি"—প্রতিটি অক্ষরে ঝলসে উঠছে নীলকান্ত পাথরের অবশিষ্ট তাপ।  

 

রুমার নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রের অন্ধকার শাসনের বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় প্রতিরোধে পরিণত হলো। প্রতিটি প্রতিবাদ, প্রতিটি শ্লোগান যেন ভাষা সৈনিকদের চেতনায় অন্তর্নিহিত—একটি স্লোগানের মৃত্যু হলে অন্য স্লোগান জন্ম নেয়, যেন হাইড্রার মতো।  

 

এক রাতে, আন্দোলনের সময় পুলিশের ছোঁড়া কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে রুমা স্মরণে সেই বীর সন্তানদের, যারা নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন বাংলা মায়ের ভাষার জন্য। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই দৃশ্য—একটি কিশোরীর রক্তে লেখা 'বাংলা' শব্দটি মাটিতে জ্বলজ্বল করছে, আর সেই রক্তের স্রোত বেয়ে ভেসে আসছে হাজারো কবিতার নৌকা।  

 

ছাত্র আন্দোলন ক্রমশ ভয়ংকর রূপ নিল। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন বেড়ে গেল, কিন্তু ছাত্রদের দৃঢ়তা ভাঙা গেল না। সেকালের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ স্বরূপ ভাষা আন্দোলনের যেন এককালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন; একই সূত্রে গাঁথা দুই বিপ্লবী সংগ্রামের পূর্ণমিলনী। রুমার হাতের পাথরখণ্ডগুলো কখনো তাপ ছড়ায়, কখনো বরফশীতল—যেন তা প্রজন্মান্তরের উত্তাপ ও শীতল নির্মমতার প্রতীক।  

 

পরিশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জয়ের ধ্বনি তুললো। এই বিজয় যেন ছিল ভাষা আন্দোলনের আঙ্গিকে একটি নতুন অভিধান—যেখানে 'জয়' শব্দের প্রতিশব্দ হলো 'অসম্পূর্ণতা'। রুমা জানত, তাদের সংগ্রাম একদিন ইতিহাসের অংশ হবে, ঠিক যেমন ছিল ৫২'র সেই রক্তাক্ত ভোর।  

সেদিন রাতের আকাশে তারা ঝলমল করছিল। রুমা আকাশের দিকে তাকিয়ে অনুভব করতে থাকলো, রক্তের ধারায় জ্বলছে মুক্তির আগুন। নীলকান্ত পাথরের শেষ টুকরোটি সে ছুঁড়ে দিল আকাশে—সেটি মিশে গেল নক্ষত্রপুঞ্জের সাথে। "এই লড়াই থামবে না কখনও," সে বলল নিজেকে, "সময়ের প্রতিটি বাঁকে আমরা আবার লড়াইয়ে নামব। কারণ আমরা তাদেরই উত্তরাধিকার, যাদের রক্ত আর অশ্রু দিয়ে যে ভাষা জন্ম নেয়, সে ভাষাই যেন যুগ-যুগান্তরের জন্ম দেয় আরো একটি মুক্তির বিপ্লব।"

 

 

উত্তরাধিকার || আমানুর রহমান

 

আমি একজন ছাত্র। আমি হাবিবউল্লাহ বাহার ইউনিভার্সিটি থেকে ফিনান্স এন্ড ব্যাংকিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর করছি। আমি বই পড়তে খুব পছন্দ করি। বইয়ের সাথে রয়েছে আমার এক নিবিড় সম্পর্ক। এছাড়াও মুভি দেখতেও আমার খুব ভালো লাগে। অবসর সময়ে আমি কবিতা, ছোট গল্প লিখি এবং বুক রিভিউ-মুভি রিভিউ করে থাকি। ঘুরাঘুরি করতে এবং বাস্তবিক ছবি ফ্রেম বন্ধি করতেও  খুব ভালো লাগে।

 

 

 

This post of CC is sponsored by- Print World