অকালে ঝরে পড়া ফুলের গল্প
প্রকৃতিতে তখন বর্ষাকাল। শ্রাবণের ভরা বৃষ্টিতে বাংলার প্রকৃতি জুড়ে এক মনোমুগ্ধকর স্নিগ্ধ রূপ ফুটে উঠেছে। কিন্তু "২৪ এর বর্ষাকালে যেন আনন্দের মাঝে বিষাদের বার্তা এনে দিলো! জুলাই মাসের প্রথমার্ধে কোটা-সংস্কারের দাবিতে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো ছাত্র-জনতার মিছিল-আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠলো।কিন্তু ফ্যাসিবাদী সরকার ছাত্রদের দাবিকে তেমন আমলে নিলো না। তবুও ছাত্ররা কোটা-সংস্কারের দাবি আদায়ে বিক্ষোভ, সমাবেশ ,মিছিল ,আন্দোলনে বদ্ধপরিকর। বিশাল এই আন্দোলন দমন করতে সরকারের নির্দেশে পুলিশ আন্দোলন রত ছাত্রদের উপর সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও ছোররা গুলি বর্ষণ করে। রাজপথ সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেটের তান্ডবে ধোঁয়াশা ও অন্ধকারে ছেয়ে গেলো।
শ্রাবনের কালো মেঘ আর সাউন্ড গ্রেনেড, বুলেটের ধোঁয়াশা পরিবেশের স্বমন্বয়ে যেন চারদিক থমথমে স্থবির হয়ে উঠলো।কিছুক্ষণের জন্য আন্দোলনে ছন্দ-পতন হয়।রাবার বুলেটের অতর্কিত আক্রমণে কেউ প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে পড়ে ,আবার কেউ স্থির হয়ে বুক পেতে দেয় বুলেটের সামনে।এজন্য অনেক হতাহতের ঘটনা হয়।গুরুতর আহত হয়ে কারও স্থান হয় হাসপাতালে।কেউ ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়।
এতো হতাহতের ঘটনায় ছাত্র-জনতার বিদ্রোহ আরও তীব্র ও প্রবল হয়ে উঠে।ছাত্র-জনতা হত্যার বিচার দাবিতে রাজপথে নামে।প্রতিবাদ-বিদ্রোহ-আন্দোলনে চারপাশের বৃষ্টিমুখর প্রকৃতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠে।আন্দোলন দমন করতে পুলিশের কঠোর-নজরদারি শুরু হয়।কোথাও যেন কোনো নিরাপত্তা নেই।সবার মাঝেই তৈরি হয় ভয়-আতঙ্কে ঘেরা চাপা উত্তেজনা। ঢাকা শহরের যাত্রাবাড়ী এলাকার অবস্থা আরও উত্তপ্ত। গোলাগুলির শব্দ, সাউন্ড-গ্রেনেড গোটা এলাকায় ধোঁয়াশাভাব।এতো নৈরাজ্য , আন্দোলনেও যাত্রাবাড়ী নিবাসী পাঁচ বছরের ছোট তিথি বন্ধুদের সাথে খেলায় মত্ত।তিথির ছোট শিশুমন যুদ্ধ, নৈরাজ্য, আন্দোলন বুঝে না।তিথি যেন ছোট্ট ফড়িংয়ের মতো এদিক-সেদিক ছুটে বেড়ায়।তিথি খোলা জানালা দিয়ে দেখে ,বিল্ডিংয়ে ঠাসা-ঠাসি করে দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের ফাঁকজুড়ে এক টুকরো নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে , যে নীল আকাশে এক ঝাঁক বিহঙ্গ মুক্ত-স্বাধীন হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।মা আফসানা বেগম তিথিকে দুপুরের খাবারের জন্য ডাক দিয়ে বলে ," মা ,তিথি। এসো মা দুপুরের খাবার খেতে এসো।"
তিথি ছোট করে জবাব দেয় ," জি ,মা।আসছি।"
মা-বাবার সাথে খেতে বসে তিথি তার মাকে বলে ," মা ,জানো। আজকের আকাশটা অনেক সুন্দর। আমি ছাদে খেলতে যাই আর আকাশটা খুব কাছ থেকে দেখে আসি ?"
মেয়ের কথা শুনে আফসানা বেগম বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং মেয়েকে বুঝিয়ে বলে ," না ,মা ।আজকে ছাদে যেও না।আকাশে কালো-মেঘ জমতে শুরু করেছে।তুমি অন্য কোনোদিন ছাদে আকাশে দেখতে যেও।"
কিন্তু অবুঝ শিশুমন কী মায়ের শাসন -বারণ বুঝে ?
দুপুরের খাবার শেষে বাবা রেজাউল হক টেলিভিশনে দেশের খবরাখবর শুনতে ড্রয়িংরুমে যায়।অস্থির পরিস্থিতির কারণে রেজাউল হকের অফিস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।
আফসানা তিথিকে নিয়ে শোবার ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেয়।তিথিকে গল্প শোনাতে শোনাতে কখন যে আফসানা বেগমের চোখজোড়া ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে ,তা তিনি টেরই পান নি।সেই সুযোগে তিথি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চুপিসারে ছাদে উঠে। ছাদে প্রতিবেশী বাসার তিথির সমবয়সী ছেলে-মেয়েও খেলা করছিলো।সব কিছু রৌদ্রোকজ্জ্বল দিনের মতো সুন্দর ও ঝলমলে। তিথি অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে কতো সুন্দর খেলা করছিলো।বাইরের রাস্তা তখনও মিছিল -আন্দোলনে উত্তাল। আন্দোলন দমনে বুলেট, গুলির তর্জন-গর্জনে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।বাচ্চাদের সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।তাদের কাছে সেই বুলেট ,গুলি বর্ষণকে খেলা বলেই মনে হয়।হঠাৎ প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে আফসানা বেগমের ঘুম ভাঙ্গে।পাশে তিথিকে দেখতে না পেয়ে আফসানা বেগমের বুক ডুকরে উঠে।আফসানা বেগম আশেপাশের রুমে তন্নতন্ন করে তিথির খোঁজ করেন।
স্ত্রীর এই আতঙ্কগ্রস্থ অবস্থা দেখে রেজাউল হক জিজ্ঞেস করেন ," কী হয়েছে ? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন ?"
আফসানা বেগম আতঙ্কের সাথে জবাব দেয়, " তিথি আমার সাথে শুয়েছিলো।মাঝে আমার একটু চোখ লেগে যায়।গোলাগুলির শব্দে ঘুম থেকে উঠে দেখি তিথি কোথাও নেই।আমাকে বলেছিলো ,ছাদে গিয়ে আকাশ দেখবে।ছাদে যায় নি তো? "
রেজাউল হক জবাব দেন ," কী বলছো তুমি ?এখন চারপাশের অবস্থা ভয়াবহ।যে কোনো রকম বিপদ ঘটতে পারে।চলো ছাদে যাই।"
আফসানা ,রেজাউল দ্রুত তিনতলার ছাদে ছুটে যায়।আফসানা ,রেজাউল হক ছুটে যায় বাচ্চাদের কাছে।অন্যান্য বাচ্চাদের ধরে ধরে ছাদ থেকে চলে যেতে বলে।রেজাউল হক তিথিকে কোলে নিয়ে যখনই ছাদ থেকে যেতে উদ্যত হলেন ,তখনই এক ঘাতক বুলেটের আঘাতে তিথির কপাল ঝাঁঝড়া করে দেয়।তিথির নিথর দেহ রেজাউল হকের বুকে ঢলে পড়ে।সবকিছু যেন থমথমে ও নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে।আফসানা বেগম শোকে পাথর হয়ে পড়েন।যা কিছু ঘটে গেলো ,তা কী সত্যি ? তিথির কপাল বেয়ে তখনও শোণিত ধারা অঝোড়ে প্রবাহিত হতে থাকে। রেজাউল হকের শার্ট রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠে।ছাদের মেঝে ছোপ ছোপ রক্তে একাকার হয়ে পড়ে।একমাত্র ফুলের মতো মেয়ের এমন অনাকাঙ্খিত মৃত্যুতে আফসানা-রেজাউল দম্পতি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তাদের কান্নায় এক শোকাবহ -বিষাদঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ৩৬ দিনের জুলাই-আন্দোলনে স্বৈরাচার পতনের মাধ্যমে বিজয়ের নতুন সূর্য উদিত হয়।
চারদিকে বিজয়ের আনন্দ থাকলেও, এই আন্দোলন অনেকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, অনেককে পঙ্গু করে দিয়েছে আর তিথির মতো নিষ্পাপ, নিরীহ ফুলের মতো অনেক শিশু অকালে ঝরে গেছে।স্বৈরাচার পতনে দ্বিতীয়বার বিজয় অর্জিত হলেও সেই অকালমৃত্যুর রক্তঝরা দিনগুলোর কথা সবার কাছে চির অম্লান হয়ে থাকবে।
অকালে ঝরে পড়া ফুলের গল্প || সাবরিনা তাহ্সিন
একজন বই প্রেমিক। তিনি বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। পেশায় তিনি একজন কনটেন্ট রাইটার। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের জন্য তার অন্যরকম ভালোলাগা ও ভালোবাসা। লেখালেখি, ছবি আঁকা, রচনা প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে অনেক পুরষ্কার প্রাপ্তি ঘটেছে। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই তিনি বই নিয়ে বসে যান, এছাড়াও অনলাইন পত্র-পত্রিকা ,ম্যাগাজিনেও লেখালেখি করা হয়। হুমায়ূন আহমেদ তার প্রিয় লেখক। বই পড়ার পাশাপাশি তিনি কবিতা, ছোট গল্প এবং মনোমুগ্ধকর বইয়ের রিভিউ দিয়ে থাকেন।
This post of CC is sponsored by- Print World