মুভি রিভিউ: ওরা ১১ জন

  • Reviewer: Abu Talha
  • Category: Movie Review
  • Published on: Sunday, Aug 22, 2021

মুভিঃ ওরা ১১ জন
পরিচালকঃ চাষী নজরুল ইসলাম
প্রযোজনাঃ মাসুদ পারভেজ
সুরকারঃ খোন্দকার নুরুল আলম
চিত্রগ্রাহকঃ আবদুস সামাদ
সম্পাদকঃ বশির হোসেন
পরিবেশকঃ স্টার ফিল্মস্ ডিসট্রিবিউটার্স
মুক্তিঃ ১৩ আগস্ট ১৯৭২
আইডিএম রেটিংঃ ৮.৯/১০
পারসোনাল রেটিংঃ ৯/১০


 মুভি সংক্ষেপঃ

'ওরা ১১ জন' ১৯৭২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। ১৯৭১ এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম চলচ্চিত্র এটি। এতে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, শাবানা, হাসান ইমাম, আলতাফ, নতূন সহ আরো অনেকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তুলে ধরা কালোত্তীর্ণ একটি সিনেমা 'ওরা ১১জন'।


অভিনয়ঃ

খসরু (খসরু)

রাজ্জাক (পারভেজ) 

শাবানা (মিতা)

নূতন (শীলা)

কেয়া (কেয়া)

সৈয়দ হাসান ইমাম (ডাঃ চৌধুরী)

এটিএম শামসুজ্জামান (বেগার আলী রাজাকার)

খলিলউল্লাহ খান (পাকিস্তানি সেনা অফিসার)


কাহিনীসংক্ষেপঃ 

ছবির শুরুতে দেখা যায়, এক যুবক গ্রামবাংলার অপার সৌন্দর্য দেখছে মুগ্ধ চোখে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবকটি বাড়িতে এসেছে মাকে দেখতে। আবহসংগীতে ভেসে আসছে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’। সিনেমার অন্যতম চরিত্র মুক্তিযোদ্ধা খসরুর বোন, মেডিকেল ছাত্রী মিতার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শাবানা। যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতে। সেখানেই পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধর্ষিত হতে হয় তাকে। ধর্ষণের গ্লানি বয়েও শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাতেই নিয়োজিত থাকে সে। ওই একই গ্রামে বাস করে কেয়া। খসরুর অধীনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে গোপনে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয় সে। অস্ত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেয়া যখন জানতে পারে তার নিজের বাবাই গ্রামের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, তখন চোখে জল এলেও বাবাকে গুলি করে মেরে ফেলতে দ্বিধা করে না সে। সেবিকা ও যোদ্ধা এই দুই চরিত্রের পাশাপাশি নিপিড়িতা, নিগৃহিতার চরিত্রেও নারীকে দেখিয়েছেন পরিচালক। খসরুর বাগদত্তা শীলাকে (নূতন) যেমন দেখা যায় যুদ্ধ শেষে বন্দিশিবির থেকে মুমুর্ষ অবস্থায় খসরুর কোলে লুটিয়ে পড়ে প্রাণত্যাগ করতে। স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জনের ইতিহাসই যেন এক নিমেষে উঠে আসে দৃশ্যটির মাধ্যমে। সেইসঙ্গে বীরাঙ্গনাদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার বিষয়টিও সিনেমার শেষের অংশে তুলে ধরেছেন নির্মাতা। দীর্ঘদিন পাকিস্তানিদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে পারভেজ ফিরে এসে যখন জানতে পারে, তার প্রেমিকা মিতার সম্ভ্রমহানীর কথা, তখন ঘৃণায় দূরে ঠেলে দেওয়ার পরিবর্তে ভালোবাসা দিয়ে প্রেয়সীকে বুকে টেনে নেয় সে। এসব গল্প নিয়েই আগাতে থাকে বাংলা চলচ্চিত্রের কালজয়ী সিনেমা 'ওরা ১১জন' মুভির কাহিনীপট। ছবির বেশিরভাগ অংশ জুড়েই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমন, সম্মুখ যুদ্ধ ও ব্যক্তিগত নৈপুন্য দেখানো হয়েছে। ছবি শেষ হয় পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ আর মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়োল্লাসের মধ্য দিয়ে।

চরিত্র বিশ্লেষণঃ

পারভেজের চরিত্রে সিনেমাটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা নায়করাজ রাজ্জাকের অভিনয় ছিল এককথায় অনবদ্য। রাজ্জাক, শাবানার পাশাপাশি পার্শ্ব-চরিত্রগুলোতে নিজেদের কুশলতার পরিচয় রেখেছেন আলতাফ, হাসান ইমাম, রওশন জামিল, সুমিতা দেবী, মিনারা জামান, এ টি এম শামসুজ্জামানের মতো অভিনয়শিল্পীরা। বিশেষ করে সন্তানকে একবার দেখবার আশায় পথ চেয়ে থাকা গেরিলার চরিত্রে আলতাফ, যুদ্ধে নিজের বড় ছেলেকে হারিয়ে ছোট ছেলেকেও মুক্তিবাহিনির হাতে সঁপে দেওয়া মায়ের চরিত্রে রওশন জামিল আর স্বার্থান্বেষী, কাপুরুষ রাজাকারের চরিত্রে এ টি এম শামসুজ্জামানের অভিনয় মনে রাখার মতো।

নামকরনঃ 

মুক্তিযুদ্ধের ১১ জন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়েই মূলত এই চলচ্চিত্রের গল্প। এই নামের পেছনে কারণ আছে। মুক্তিযুদ্ধে ১১ দফা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ছিল, আর ছিল বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা। তাই ছবির শুরুতেই যখন ওরা ১১ জন নামটি পর্দায় ভেসে ওঠে, তখন কামানের ছয়টি গোলা ছোড়া হয়।


বিশেষত্বঃ

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতার ডাক দেন, এই ছবির গল্পে সেই ঐতিহাসিক ভাষনের কিছু অংশ দেখানো হয়েছে। এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খসরু, মুরাদ, হেলাল ও নান্টু। এমনকি যুদ্ধের দৃশ্য দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল সত্যিকারের গোলাবারুদ। 


অর্জনঃ

১৯৭২ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে মুভিটি। দুঃখের বিষয় এরপর আর কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি।


গান সমূহঃ 

সিনেমাটিতে মোট ৩টি গান রয়েছে। সংগীত পরিচালনা করেছেন খোন্দকার নুরুল আলম।

—ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।

আমায় একটি খুদিরাম দাও বলে।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলা স্বাধীনতা আনলে যারা। 


সিনেমার ভালো দিকঃ 

যুদ্ধের মতো করুণ এবং জটিল একটি বিষয়ের উপস্থাপনেও দর্শকেরা যাতে হাঁপিয়ে না ওঠে, সেদিকে দৃষ্টি ছিল পরিচালকের। সিনেমাটিক রিলিফ হিসেবেই তাই হয়তো তিনি বার বার অবতারণা করেছেন হাস্যরসের। জনতার ধাওয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যের পানিতে পড়ে যাওয়া কিংবা, ঝোপের আড়ালে গরুর শব্দ শুনেই মুক্তিবাহিনি ভেবে রাজাকারদের ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার দৃশ্যগুলো তাই প্রশংসার দাবিই রাখে। ত্রিশ লাখ শহীদের এই যুদ্ধে পাকিস্তানের নৃশংস গণহত্যার করুণ ইতিহাস উঠে আসে ওরা ১১ জন সিনেমায়। এর মধ্যেই বাঙ্গালির আত্মত্যাগ, অন্যায়ের বিরূদ্ধে মাথা নত না করা, গেরিলা যোদ্ধাদের বীরত্ব সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। 

সমালোচনাঃ

সিনেমাটিতে বেশ কজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা অভিনয় করেছেন। বস্তুত এ বিষয়টিই একাধারে এ ছবিটির অন্যতম শক্তি ও দূর্বলতার জায়গা। তাই যুদ্ধের ময়দানে তাদের কার্যকলাপ ও গোলাগুলি প্রতিটি বিষয়ই ছিলো বেশ বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তব। কিন্তু অভিনেতা হিসেবে তাদের সংলাপ করার দূর্বলতা ও প্রয়োজন অনুপাতে আবেগ ও এক্সপ্রেশনের অভাব কিছুটা দৃষ্টিকটু ছিলো। প্রায় দু’ঘন্টার এ ছবির মধ্যভাগে এসে কাহিনী কিছুটা মন্থর হয়ে আসে। এছাড়া গল্পের ভেতর আরো কিছুটা উত্তেজনা বা ক্লাইমেক্স সৃষ্টির যথেষ্ট সুযোগ ছিলো।

প্রতিক্রিয়াঃ

সিনেমা দীর্ঘ হলেও, এর গল্পকাঠামো, সংলাপ আর বক্তব্যের কারণেই ওরা ১১ জন’ শেষ পর্যন্ত দেখার দাবি রাখে। ত্রুটিমুক্ত না হলেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন এক ধারার পথিকৃত হিসেবে এই সিনেমা  সবসময়ই থাকবে উচ্চাসনে। মূলত সাদা-কালো এ ছবিতে ক্যামেরার কিছু কাজ ছিলো এক কথায় অসাধারণ। সারি বেঁধে সৈন্যদের ছুটে চলা। চোখ-বাঁধা, উলঙ্গ নারীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার দৃশ্যগুলোর উপস্থাপন ছিলো শিল্পিত। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম এবং পূর্ণাঙ্গ এই চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের স্মৃতিও তাই চির অম্নান হয়েই থাকবে সিনেমাপ্রেমীদের মনে।

ধন্যবাদ সবাইকে।


মুভি রিভিউ: ওরা ১১ জন || Abu Talha


Abu Talha is a student of Uttara University. He's from Dewanganj, Jamalpur.