কর্মফল
আজকে কমপক্ষে ১০ টা বাচ্চা কিডন্যাপ করতেই হবে, না হয় বস রেগে যাবে, বলাবলি করছিলো একদল লোক,৫-৭ হবে মোট। এরা গ্রুপে নতুন।
মি.রেহমান সাহেবের বিরাট ব্যাবসা, একমাত্র কন্যা জুঁহি এবার ক্লাস থ্রিতে পড়ে। রেহমান সাহেবের স্ত্রী মাটির মানুষ। এত লাক্সারি জীবন উনার পছন্দ নই বলেই আর শহরে থাকা হয় না উনার । মায়ের সাথে মেয়েকে নিয়ে গ্রামেই থাকেন।যদিও রেহমান সাহেব যাবতীয় সব খরচ বহন করে। উনার মেয়ে গ্রামের এক স্কুলে পড়ে। জুঁহি বেশ ভালোই থাকে মা আর নানুর সাথে। বিভিন্ন বন্ধে অবশ্য বাবার সাথে দেখা হয় তার,বাবা অন্তঃপ্রান তার।দেখা হলেই গলা জড়িয়ে রাজ্যের আলাপ জুড়ে দেয় সে। রেহমান সাহেবের দুনিয়া একদিকে আর মেয়ে আরেকদিকে। এত টাকা রেহমান সাহেবের, তবে উপার্জনের উপায় জানেন না উনার স্ত্রী, সন্তান। সেই যাইহোক মেয়েকে নিয়ে বেশ সুখী এই দম্পতি।
কিডন্যাপিং টা সহজ কোথায় হয় বল তো? শহরের বাচ্চাগুলো তো একেকটা ফার্মের মুরগী,বাপ মায়ের সাথে স্কুল যায়। গ্রুপের একজন বলে উঠলো,শহর থেকে দূরে একটা গ্রাম আছে,ছোট গ্রাম,সেখানে একবার যাওয়া যায় নাকি?
সে যাওয়া যায়,কিন্তু এক গ্রাম থেকে নাহয় একটা বাচ্চা তুলবো ,বাকি নয়টা??
সে দেখা যাবে নে,আগে একটা তো তুলি। এভাবেই নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চলছিলো এদের।
এরা মূলত একটা পাচারচক্রের সাথে কাজ। এই চক্রটা বাচ্চাদের কিডন্যাপ করে অর্গান বিক্রির মতো ঘৃন্য কাজের সাথে যুক্ত।
যথারীতি জুঁহি স্কুল ছুটির পরে বন্ধুদের সাথেই বাড়ি ফিরে আসে হাসি আনন্দে মেতে। জুঁহির নিত্যদিনের কাজ বাসায় গিয়ে মাত্র বাবাকে ফোন করে স্কুলের কাহিনি বলতে হবে। কিডন্যাপিং দলের দুজন পৌঁছে গেলো সেই গ্রামে আর সেই স্কুলের সামনে যেখানে জুঁহি পড়ে। কিছুটা পথ আসার পরে, ৩ মিনিটের রাস্তা জুঁহিকে একা আসতে হয়। কিছু বুঝার আগের পিছন থেকে জুঁহির মুখ চেপে গাড়িতে তুলে নেয় ওই জানোয়ার দুটো। এরপর আর কিছু মনে নেই ছোট জুঁহির। সে তো তাদের চেহেরাও দেখেনি।
বাড়ি আসতে দেরি হচ্ছে দেখে,রেহমান সাহেবের স্ত্রী স্কুল, রাস্তা,জুঁহির বন্ধুদের বাড়ি সবখানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো জুঁহি বাড়ির দিকেই এসেছে। ওইদিকে মেয়ের ফোনের অপেক্ষায় বসে ছিল রেহমান সাহেব। একটা সময় জানাজানি হলো জুঁহিকে পাওয়া যাচ্ছে না। চারদিকে খোঁজাখোজি চলছিলো। মিসেস রেহমানের অবস্থাও বিশেষ ভালো না,মেয়ের শোকে প্রেশার আপ- ডাউন করছে। রেহমান সাহেব হন্য হয়ে মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। থানা পুলিশ, মাইকিং কিছুতেই কমতি নেই। ১৯ ঘন্টা কেটে গেলো জুঁহির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
ততক্ষনে বাকি নয় জন বাচ্চা নিয়ে চলে এসেছে বাকিরা।
একদিকে মেয়ের জন্য পাগলের মতো ছোটাছুটি করছেন রেহমান সাহেব, অন্যদিকে ব্যাবসার কাজে টানা ফোন আসছে। রেহমান সাহেব মূলত এই পাচারচক্রের মূল হোতা। বাচ্চাগুলো এভাবে বেশিক্ষণ রাখা নিরাপদ নই,কখন পুলিশ খবর পেয়ে যায়,আবার রেহমান সাহেব ও কল ধরছে না দেখে, অন্যরা সিদ্ধান্ত নেয়,দেরি করা ঠিক হবে না।
পুলিশের কল আসলো, আশা দিলো রেহমান সাহেবকে,সমস্ত রাস্তায় পুলিশ চেকপোস্ট দেওয়া হয়েছে, চিন্তার কারণ নেই। একটু আশা পেয়ে গ্যাং মেম্বারসদের কল ব্যাক করলেন উনি,জানালেন এক্ষুনি আসছেন। ওইদিকে জুঁহির মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ, ডাক্তার এসে দেখে গেছে তিনবার। রেহমান সাহেব ছুটলেন তার গোপন ব্যাবসার উদ্দেশ্য, মাথায় চিন্তা, মেয়েটাকে কখন ঘরে ফিরবে,কখন বুকে জড়িয়ে আদর করবেন,কখনো সে তার কথার ফুলঝুড়ি নিয়ে বসবে। রেহমান সাহেবের হাতে এখনো ছোট্ট জুহির ছবি ধরা।
হাঁফাতে হাঁফাতে গোপন আস্তানায় ঢুকলেন রেহমান সাহেব,উচ্চস্বরে বললেন একটা কাজ কি তোরা আমাকে ছাড়া করতে পারিস না? আমার ছোট্ট মেয়েটাকে পাচ্ছি না সকাল থেকে, বলেই কান্নায় ভেঙে পরলেন উনি।হঠাৎ রেহমান সাহেবের চোখ পরলো ঘরের কোনে মেয়ের মিকিমাউস আঁকা ওয়াটার বোতলের উপর। এইতো গত সপ্তাহে মেয়ে বায়না করে এটা নিয়েছিল। হঠাৎ বুক টা মোঁচড় দিয়ে উঠলো। দৌঁড়ে গিয়ে বোতল টা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এটা কার? কেউ একজন উত্তর দিলো হবে এদের মধ্যে কোন এক বাচ্চার। রেহমান সাহেব যেন পাগলের মতো ছুটে গেলেন ভিতরের ঘরে। চাদর উলটে উলটে দেখছিলেন প্রতিটি বাচ্চার মুখ।
এটা কি দেখছেন উনি? ক্ষতবিক্ষত ছোট্ট ময়না পাখি টি, নিথর হয়ে পরে আছে অন্ধকার ঘরের ধুলো জমা এক কোণে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না ,চোখে একবিন্দু জল নেই,পাথর হয়ে বসে রইলেন উনি। এই অবস্থায় উনাকে দেখে বাকিরা বুঝতে পারছিলো না কি হয়েছে।
রেহমান সাহেব ছোট্ট জুঁহির নিথর শরীর টা বুকে জড়িয়ে পাগলের মতো ছুটে বের হয়ে গেলেন। জুঁহিকে বারবার চুমু দিতে দিতে বলছিলো,আজকে কি কি হলো রে মা স্কুলে? টিফিন কি নিলি আজ?
আবার হাসছিলো, ততক্ষণে রাস্তায় জড়ো হয়ে গেছে অনেক মানুষ, ওমন ভয়ানক দৃশ্য সবার টনক নাড়িয়ে দিয়েছে,পুলিশ এসেছে। ঘটনা এখন পরিষ্কার কি থেকে কি হয়েছে, কে এর সাথে জড়িত, জুঁহিরই বা কি হয়েছে? সময় এগিয়ে গেলো ৫ বছর, আজ রেহমান সাহেব পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন। উনার স্ত্রী হয়েছে মেয়ের মৃত্যুর পরেই স্ট্রোক করেছেন। রেহমান সাহেব এখন চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন,তবে অবস্থার কোনো উন্নতি নেই।
কর্মফল || অন্বিতা ঘোষ রেইনী
অন্বিতা ঘোষ রেইনী চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোটবেলায় মায়ের অনুপ্রেরণায় তার লেখালেখির হাতেখড়ি হয়। যদিও আত্মবিশ্বাসের অভাব তাকে কখনো কখনো নিজের লেখা প্রকাশ করতে সংকোচে ফেলেছে, তবুও পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের উৎসাহ তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। তাদের বিশ্বাস আর সাহস জুগিয়েই তিনি লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্বিতা মনে করেন, চর্চার মাধ্যমে তিনি আরও ভালো লেখতে পারবেন এবং একদিন নিজের লেখাগুলোকে গর্বের সাথে প্রকাশ করবেন।