এক যে ছিল রাজা
আমরা অনেক সময় ভাবী যে, আমাদের জীবনটা সিনেমার মত হলে কেমন হত! বিশেষ করে যেসব সিনেমার একটি সুন্দর সমাপ্তি ঘটে সেসব সিনেমার মত জীবনটা হলে মন্দ হত না। তবে কখনো কখনো একজন ব্যক্তির জীবন সিনেমার চেয়েও বেশি নাটকীয় আর রোমাঞ্চকর হতে পারে। এতই রোমাঞ্চকর যে, শেষটাও যেন একটি সমাধানে অপারগ ধাঁধা হয়ে রয়ে যায়। তাই নিয়ে তৈরি হয় সিনেমা। তেমনি রোমাঞ্চপূর্ণ এক জীবন ছিল ভাওয়াল রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ রায়ের। ভাওয়াল রাজবাড়ি,বর্তমানে বাংলাদেশের গাজীপুরে অবস্থিত। ভাওয়াল রাজবাড়ি প্রায় ৫৭৯ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং প্রায় ৫ লাখ প্রজা বাস করত। তিন ভাই মিলে এই জমিদারী দেখাশোনা করত। রমেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন তিন ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। এই রমেন্দ্রনারায়ণ রায়ের জীবনকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়েছে একটি সিনেমা। যার নাম 'এক যে ছিল রাজা'।
চলচ্চিত্র: এক যে ছিল রাজা
রচনা, পরিচালনা: সৃজিত মুখার্জি
ধরণ: ভাওয়াল রাজার জীবনের ট্র্যাজেডির উপর নির্মিত, রহস্য ও থ্রিলার
শ্রেষ্ঠাংশে: যিশু সেনগুপ্ত, জয়া আহসান, অর্নিবাণ ভট্টাচার্য, অঞ্জন দত্ত, অপর্ণা সেন, রুদ্রনীল ঘোষ, রাজনন্দিনী পাল প্রমুখ।
দেশ : ভারত
ভাষা : বাংলা
দৈর্ঘ্য : ১৪৭ মিনিট
মুক্তি: ১২ই অক্টোবর, ২০১৮
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৩/১০
ব্যক্তিগত রেটিং: ৯/১০
কাহিনিসংক্ষেপ: ভাওয়াল রাজবাড়ি, যা বিক্রমপুর স্টেট হিসেবেও পরিচিত তার মেজকুমার মহেন্দ্রকুমার চৌধুরী প্রজা অন্তঃপ্রাণ। প্রজারা তাকে খুবই ভালোবাসে। একমাত্র সৎগুণ প্রজা বাৎসল্য ছাড়া তার চরিত্রের অনেক নেতিবাচক দিক ছিল। তবে হয়ত রাজাদের এসব নেতিবাচক দিককে আমলে নেয়া হয় না। অধিকাংশ সময় তিনি শিকারে, আনন্দ-ফুর্তি করে, এবং নারী সংসর্গে কাটাতেন। তাঁর বেশ কয়েকজন রক্ষিতা ছিলো বলেও জানা যায়। নারী সংসর্গের কারণে তিনি একসময় যৌনরোগ সিফিলিসে আক্রান্ত হন। তখন তিনি তাদের পারিবারিক ডাক্তার অশ্বিনী দাসগুপ্ত এবং শ্যালক সত্য ব্যানার্জীর পরামর্শে হাওয়া বদল এবং চিকিৎসার জন্য স্ত্রীকে সাথে নিয়ে দার্জিলিং- এ যান। সেখানেই ১৯০৯ সালের ৭ই মে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কারণ হিসাবে বলা হয় বিলিয়ারি কলিক বা গলব্লাডারে পাথর। তাঁর শবদেহ দাহ করা হয় এবং মে মাসের ১৮ তারিখে তাঁর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পালিত হয়। পরবর্তীকালে প্রশ্ন উঠে, মে মাসের ৮ তারিখে আদৌ কী ঘটেছিলো, এবং দাহ করার দিনক্ষণ ও কার শবদেহ দাহ করা হয়েছে, তা নিয়ে। কোনো কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, ঐ সময়ে হঠাৎ শুরু হওয়া শিলাবৃষ্টি দাহকার্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। ফলে শ্মশানে চিতা প্রজ্জ্বলিত করার ঠিক আগমুহূর্তে দাহকার্য স্থগিত হয়ে যায়। শেষকৃত্যে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা শিলাবৃষ্টি হতে বাঁচার জন্য যখন অন্যত্র আশ্রয় নেন, তখন মৃতদেহ গায়েব হয়ে যায়।এরপর কেটে যায় প্রায় ১২ বছর। সবাই রাজার মৃত্যু মেনে নিলেও তার বোন মৃন্ময়ী দেবী এখনও মনে মনে বিশ্বাস করেন তার ভাই জীবিত আছেন। এত বছরে অনেককিছুই পাল্টে যায়৷ ভাওয়াল রাজবাড়ির মালিক অন্য দুই ভাইয়ের মৃত্যু ঘটে। ফলে তদানীন্তন ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশদের কোর্ট অফ ওয়ার্ডস কুমারদের বিধবা স্ত্রীদের পক্ষে এই জমিদারীর মালিকানা গ্রহণ করে। রমেন্দ্রনারায়ণের শবদেহ গায়েব হয়ে যাওয়ার গুজব আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে।শোনা যেতে থাকে যে, রমেন্দ্রনারায়ণকে জীবিত দেখা গেছে। বাংলার সর্বত্র লোক মারফত অনুসন্ধান চালানো হয়। বলা শুরু হয় যে, কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ বেঁচে আছেন এবং সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেছেন। রমেন্দ্রনারায়ণের বোন মৃন্ময়ী এই ব্যাপারে খোঁজ করতে শুরু করেন। অবশেষে একদিন সর্বাঙ্গে ছাইমাখা এক নাগা সন্ন্যাসীকে দেখা যায়। তার শারীরিক গঠন, চালচলন দেখে মৃন্ময়ী দেবী এবং অন্যান্য প্রজারা মনে করেন, তাদের রাজা ফিরে এসেছেন। শুরুতে সন্ন্যাসী অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে তিনিই যে রাজা মহেন্দ্রকুমার চৌধুরী তা স্বীকার করেন। এরপর শুরু হয় বিশ শতকের প্রথম ভাগের বিখ্যাত মামলা। যে মামলাটি দায়ের করেন ভাওয়াল রাজার স্ত্রী ও তার শ্যালক। মামলার উদ্দেশ্য ছিল ভাওয়াল রাজবাড়ির কর্তৃত্ব নিয়ে কিন্তু মূল প্রতিপাদ্য ছিল যে নাগা সন্ন্যাসী নিজেকে ভাওয়াল রাজা হিসেবে দাবী করছেন তিনি আসলেই রাজা কি না। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু হওয়া এই মামলা চলে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত। পক্ষে বিপক্ষে বিভিন্ন সাক্ষ্য গ্রহণ চলে এবং আদালতের তরফ থেকে মামলার রায়ও দেয়া হয় কিন্তু দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চলা এই মামলার আজ অবধি কোনো কূলকিনারা হয়নি। কেন কূলকিনারা হয়নি? ঐ সন্ন্যাসীই কি ভাওয়াল রাজা নাকি ভন্ড? কি মনে হয় আপনাদের? প্রকৃতি হয়ত কিছু রহস্য নিজের কাছেই রাখতে পছন্দ করে। ভাওয়াল রাজা সম্পর্কে জানতে এবং রহস্য উন্মোচনে মাথা খাটাতে কৌতূহলী হলে দেখতে হবে এক যে ছিল রাজা।
প্রতিক্রিয়া: আমাদের আনাচে কানাচে কত যে বিস্ময়কর কাহিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমরা সে ব্যাপারে জানি না বললেই চলে। হ্যাঁ, সবকিছু জানা সম্ভব নয় কিন্তু আমাদের দেশের ভাওয়াল রাজবাড়ির এই কাহিনি আমাদের সবার জানা উচিত। নিজ দেশের চাঞ্চল্যকর ইতিহাস জানার মত আনন্দের আর কিছু হয় না। এবার আসি সিনেমার কথায়, সৃজিত মুখার্জির সিনেমা মানেই বাকি সিনেমা থেকে একদমই ব্যতিক্রমী হবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। গল্প বলার ধরণ, সংলাপ, সকলের অভিনয় বিশেষ করে কেন্দ্রীয় চরিত্র যিশু সেনগুপ্ত অসাধারণ অভিনয় করেছেন আর জয়া আহসানের কথা নতুন করে কিছু বলার নেই। তিনি যেন চরিত্রের সাথে মিশে গিয়েছিলেন। এছাড়া বাকি সবার অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। যদি আমরা কোনো সিনেমার সমাপ্তি কেমন হবে আগে থেকেই বুঝতে পারি তাহলে আমার মনে হয় সিনেমা দেখার প্রতি আগ্রহ সেখানেই অর্ধেক শেষ হয়ে যায়। এখানেই "এক যে ছিল রাজা" আলাদা ছিল। দর্শককে হতবুদ্ধি করে কিছু প্রশ্ন জাগিয়ে সমাপ্তিটা ঘটেছে। সিনেমার গানগুলোও ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে সাহানা বাজপেয়ীর কন্ঠে "মহারাজ, একি সাজে..." রবীন্দ্রসংগীতটির সিনেমায় এরকম উপযুক্ত জায়গায় ব্যবহার অসাধারণ লেগেছে। আমি ভাওয়াল রাজার চমকপ্রদ কাহিনি জানতাম না। সিনেমাটি দেখে অনেক কিছু জেনেছি। এককথায়, 'এক যে ছিল রাজা' আমার কাছে আমার দেখা অন্যতম সেরা সিনেমা।
পুরস্কার ও সম্মাননা: ভারতের ৬৬তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (২০১৯)অনুষ্ঠানে "সেরা বাংলা ফিচার ফিল্ম" এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন কর্তৃক সেরা অভিনেতা হিসেবে যিশু সেনগুপ্ত, সেরা পরিচালক হিসেবে সৃজিত মুখার্জি এবং সেরা সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে গৈরিক সরকার পুরস্কার পান এবং একইসাথে সেরা পার্শ্ব অভিনেতা( মহিলা) বিভাগে জয়া আহসান, সেরা খলনায়ক বিভাগে অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা বিভাগে এবং সেরা স্ক্রিনপ্লে বিভাগে সৃজিত মুখার্জি মনোনীত হন।
এক যে ছিল রাজা || হালিমা আক্তার তন্বী
হালিমা আক্তার তন্বী, জন্ম ১৮ই আগস্ট, ১৯৯৯। শৈশব, কৈশোর সবই কেটেছে বলতে গেলে খুলনাতেই। ২০১৪ সালে খুলনা কলেজিয়েট গার্লস্ স্কুল থেকে এস.এস.সি এবং ২০১৬ সালে খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে অধ্যায়নরত। ছোটবেলা থেকেই প্রিয় কাজের তালিকায় রয়েছে- বই পড়া, ভালো ভালো মুভি দেখা এবং লেখালেখি। এজন্য বিভিন্ন বই সম্পর্কিত ও লেখালেখি সম্পর্কিত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা হয় এবং এজন্য অনেক পুরস্কারও পেয়েছি। আমার ইচ্ছে নিজের এই শখটাকে আরো উন্নত করা।