আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ও স্মরণীয় ভ্রমণ কাহিনী
পাহাড়ে বেড়ানোর মজাই আলাদা। পাহাড়ের মাঝে লুকিয়ে রয়েছে অপার সৌন্দর্য। পাহাড়ের প্রতি বাঁকে বাঁকে যেন লুকিয়ে আছে অসংখ্য রহস্য। তাই শীতকালের ছুটিতে বাবা-মায়ের সাথে বেরিয়ে পড়লাম পাহাড় ভ্রমণে।আমার মায়ের স্কুল জীবনের বন্ধু দীপা আন্টির আমন্ত্রণে আমরা দার্জিলিং ভ্রমণে গিয়েছিলাম।আজ সেই গল্পই উপস্থাপন করব।
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে,৯ তারিখ প্লেনে করে ইন্ডিয়ার কলকাতায় গেলাম। সেখানে বাবার রুটিন চেকআপ শেষ করলাম। তারপর দীপা আন্টি অনুরোধ করল ময়নাগুড়িতে আন্টির বাসায় একদিন থাকতে। সেই উদ্দেশ্যে ১১ তারিখ রাতে উত্তরবঙ্গ ট্রেনে করে রওনা হলাম। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টার ভ্রমণ করার পর ময়নাগুড়ি পৌঁছালাম। একটু কষ্ট হয়েছিল কিন্তু এটা ভেবে আনন্দ লাগছিল যে আমরা অবশেষে দার্জিলিং যাচ্ছি। দীপা আন্টি গাড়ি করে আমাদের স্টেশন থেকে নিতে এসেছিল। আন্টিদের সাথে আমরা গরুমাড়া ফরেস্ট(ডুয়ারস)-এ গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে চা বাগানে বেশ কিছু ছবি তুললাম। পথে যেতে যেতে তিস্তা নদীর দেখা মিলল। গাড়ি থেকে নেমে তিস্তা নদীর অপার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম ও বেশ কিছু ছবি তুললাম। তারপর লাওয়াছাড়া রিসোর্টে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য নামলাম। খাওয়া শেষে রিসোর্টের আশপাশ ঘুরে দেখলাম,ছবি তুললাম। তারপর বাড়িতে ফিরে গেলাম।আন্টি আমাদের খুব আপ্যায়ন করেছিলেন। তারপর সেখান থেকে দার্জিলিং যাওয়ার সব ব্যবস্থা করা হলো। আনন্দে সেই রাত আর কাটছিল না।
১২ তারিখ,ভোর ৫টায়।হালকা নাস্তা খেয়ে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে রেডি হয়ে পড়লাম দার্জিলিং যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ভোর ৫ঃ৩০ টার দিকে যাত্রা শুরু করলাম আমি, বাবা, মা,আন্টি ও আংকেলের সাথে। পথে যেতে যেতে আবারও তিস্তা নদীর দেখা মিলল। গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লাম। নদীর তীরে বেশ বাতাস হচ্ছিল,চারিদিকে পাহাড়- পর্বত,পাহাড়ি ফুল সবকিছু মিলে যেন এক মনোরম পরিবেশ। কিছু মুহূর্ত ক্যামেরায় ধারণ করলাম।তারপর আবারও গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়ির জানালাটা একটু নামিয়ে দিলাম। সেখানকার রাস্তাগুলো খুবই উঁচু-নিচু। যত উপরে যাচ্ছি ততই বায়ুচাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, হালকা হালকা ঠান্ডা অনুভব হওয়া শুরু করল, গা কাটা দিত শুরু করল। আমি আমার জীবনে কখনোই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখিনি,তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার প্রবল ইচ্ছা ছিল। যখন দার্জিলিং এর প্রায় কাছাকাছি,দেখা মিলল কাঞ্চনজঙ্ঘার! আমার অনুভূতি মুখে বলে বা লিখে প্রকাশ করার মত নয়। মনে হচ্ছিল,কাঞ্চনজঙ্ঘাটা যদি ধরে পকেটে করে নিয়ে যেতে পারতাম!
তারপর অবশেষে দার্জিলিং-এ পৌঁছালাম। সেখানে বাংলোতে উঠলাম। আংকেলের বন্ধু সেখানে সরকারী চাকরি করতো বলে একটু ডিসকাউন্ট পেয়েছিলাম। আমাদের রুম এ গিয়েই দেখি জানালা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য। ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে নিলাম। তারপর শীতের কাপড় পরে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম জ্যুওলোজিক্যাল পার্কে। সেখানকার একটি বিশেষত্ব হলো সেখানে সব ধরণের প্রাণী প্রায় বন্দিমুক্ত অবস্থা রয়েছে। তাদের চলাফেরার জন্য একটি নির্দিষ্ট এরিয়া রয়েছে,তারা কাউকে আক্রমণ করে না। সেখানে ভিন্ন ধরণের প্রাণী রয়েছে। যেমন-বাঘ,ভালুক,শিয়াল,বানর,নেকড়ে ইত্যাদি। বাঘ,ভালুক দের সাথে আমি ছবিও তুলেছি। এরেকটু সামনে যেতেই,সেখানে অবস্থিত মিউজিয়াম। যেখানে এভারেস্ট বিজয়ীদের ছবি আছে,তাদের বিজয়ের গল্প উল্লেখিত আছে। সেখানে মাউন্টেন এভারেস্ট,কে টু এবং কাঞ্চনজংঘার ডেমো ছিলো। সেখানে একটি এক্সপেরিয়েন্স রাইটিং ডাইরি ছিল যেখানে আমি আমার অভিজ্ঞতা লিখেছি।
হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে গেলাম রক গার্ডেন যাবার উদ্দেশ্যে।পাহাড় বেয়ে বেয়ে চিকন হয়ে সে রাস্তাগুলো অনেক উপরে চলে গিয়েছে(৬.২মাইল)! তাই পুরোটুকু যেতে পারিনি। এই উদ্যানে ফুল বাগানের পাশাপাশি বিভিন্ন উচ্চতায় পাহাড়ের গা ঘেঁষে বসার স্থান তৈরি হয়েছে। এখানে একটি ছোট হ্রদও আছে। এখানে রয়েছে একটি ঝর্ণা। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর! আরেকটু সামনে যেতেই বিশাল চা বাগান,প্রায় হাঁটা পথ। চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন,হালকা বাতাস,এক চিলতে রোদ,দূরের কোন এক জায়গায় অরিজিত সিং এর “me phir bhi tumko chahunga” গানটি শোনা যাচ্ছিল! এই সময় আমার অনুভূতি বলে প্রকাশ করার মত নয়! দার্জিলিং-এর ঐতিহ্যবাহী চা,যার স্বাদই আলাদা। সেখানকার দোকান থেকে নিজের ও পরিবার-আত্মীয় স্বজনদের জন্য চা কিনলাম। বিকেল হয়ে আসল,বাংলোতে ফিরে গেলাম,নামায পড়লাম। সন্ধ্যা ৭টা বাজে। Mall-এ গিয়ে অনেক শপিং করলাম। পরিবার,বন্ধু-বান্ধব,শিক্ষকদের জন্যও উপহার কিনলাম। সেখানে একদল ছেলেমেয়ে দলবেঁধে গান গাইছিল। দীপা আন্টি সেখানে নেচেছিল। তারপর সেদিনের জন্য বাংলো তে ফিরে গেলাম ও রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
তারপরের দিন সকালে চলে গেলাম জাপানিজ টেম্পলে,যেটি বৌদ্ধদের মন্দির। এটি দার্জিলিং শহর থেকে ১০ মিনিটের দূরে জালাপাহাড়ে অবস্থিত। সেখানে আমরা বেশিক্ষণ অবস্থান না করে চলে গেলাম ‘Tenzing Rock’-এ। A very adventuring place! এখানে সাধারণত পাহাড় ট্রেনিং হিসেবে বড় পাথরখণ্ডে চড়ে অভিযাত্রীরা অনুশীলন করেন। পর্যটকদেরও অনুমতি আছে।তাই আমি,বাবা আর আংকেল প্রস্তুত হলাম। কোমরে দড়ি বেঁধে আরেকটি দড়ি ধরে পাথরের শরীর বেয়ে উঠতে হয়। আমরা তিনজন কোমরে দড়ি বেঁধে উঠতে শুরু করলাম। একটু ভয় লেগেছিল প্রথমে যে আমি পারব কিনা,অর্ধেক অতিক্রম করার পর মনে সাহস পেলাম যে,না আমি পারব। চূড়ায় উঠার সময় গা একটু কাঁপে বটে,মনে হয় শূন্যে দাঁড়িয়ে আছি এবং নিচের সবকিছু খুবই ক্ষুদ্র লাগছিল,নিচে মেঘ দেখতে পাচ্ছিলাম। এবার চিন্তা হলো নামতে পারব কিনা,সাহসের সাথে নামতে পেরেছিলাম। সব মিলে এটি ছিল একটি অসাধারণ স্বর্গীয় অনুভূতি। চূড়ায় বসে পাহাড় ও শহরটি দেখার মজাই আলাদা। সেখানে ঠাণ্ডায় হাত বরফ হয়ে যাচ্ছিল,তাই কাঠের টুকরা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাখেন অনেকে,সেখানে আমরা আগুনের উত্তাপ নিয়েছিলাম।
দার্জিলিং এর ঐতিহ্যবাহী street food হলো মোমো,থুকপা। যা খেতে খুবই সুস্বাদু,আমরা খেয়েছি।Keventers-যেখানে Ranbir Kapoor-এর Barfi movie- এর shooting হয়েছিল,সেখানে গিয়েছি। পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতম রেলস্টেশন ‘ঘুম স্টেশন’ এ গিয়েছি। তারপরের দিন গেলাম ‘রোপ ওয়ে’ তে। কেবলকার থেকে দার্জিলিং এর পাহাড়ের সৌন্দর্য ও শৈল শহরকে খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়। সেখান থেকে নেমে আমরা গরম গরম চা আর মোমো খেয়ে নিলাম। বাংলোতে যেতে যেতে একটা cold drinks খেতে খেতে চলে গেলাম। সেই রাতে ঠিক হলো আমরা ‘টাইগার হিল’ এ যাবো,যেখান থেকে সুস্পষ্টভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও সূর্যোদয় দেখা যায়। তাই ভোর ৪টার দিকে রওনা হলাম টাইগার হিলে যাবার উদ্দেশ্যে।তাপমাত্রা ছিল মাইনাস। খুবই ভিড় ছিলো। সবাই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। আমরাও অপেক্ষা করছিলাম। কখন সূর্য উঠবে! কিন্তু সূর্য একটু উঠেই আবার মেঘে ঢেকে যাচ্ছিল। অবশেষে সূর্য মামা উঁকি দিল। সূর্যের আলো যখন কাঞ্চনজঙ্ঘায় পড়ল,সে এক অপরূপ দৃশ্য যা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয় বা ক্যামেরায় ধারণ করার মতো নয়। অনেকে টেলিস্কোপ এনেছিল,আমি টেলিস্কোপে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি।
তারপর সব শেষে গন্তব্য ছিল ‘বাতাসিয়া লুপ’। সেখান থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা আরও স্বচ্ছভাবে দেখা যাচ্ছিল। সেখানে টয় ট্রেন আছে,যে ট্রেনে করে পুরো দার্জিলিং ঘুরে দেখা যায়। আমাদের হাতে সময় কম ছিল বলে টয় ট্রেনে উঠতে পারিনি। সেখানে ছিল দার্জিলিং এর Traditional costume যেটি পরিধান করে আমি, বাবা ও মা চা বাগানে ছবি তুলেছি। এবার ফেরার পালা। আমরা শিলিগুড়ি স্টেশনে ট্রেনে করে রওনা হলাম। আসার সময় বার বার কাঞ্চনজঙ্ঘা দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলাম।
দার্জিলিং ভ্রমণ আমার জীবনের সেরা ভ্রমণ কাহিনী। আমার স্মৃতিতে এই ট্যুর অম্লাম হয়ে থাকবে।
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ও স্মরণীয় ভ্রমণ কাহিনী । । সাইয়ারা নবী
সাইয়ারা নবী বর্তমানে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত একজন তরুণ ছাত্রী। তার অল্প বয়স হওয়া সত্ত্বেও, তার লেখার প্রতি গভীর আবেগ রয়েছে, বিশেষ করে তার বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে। গল্প বলার প্রতি সাইয়ারা ভালবাসা তার চারপাশের জগতের প্রতি তার কৌতূহল এবং মুগ্ধতার দ্বারা উস্কে দেয়। সম্প্রতি, দার্জিলিং-এ একটি স্মরণীয় ভ্রমণের সময়, তিনি শ্বাসরুদ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দ্বারা বিমোহিত হয়েছিলেন, যা তাকে একটি ছোট গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল - আজ পর্যন্ত তার সেরা এবং সবচেয়ে লালিত ভ্রমণ কাহিনী। তার লেখার মাধ্যমে, তিনি তার দুঃসাহসিক কাজ এবং প্রতিচ্ছবি শেয়ার করার লক্ষ্য রাখেন, তার গল্পগুলিকে হৃদয়গ্রাহী এবং প্রাণবন্ত করে তোলে।