রঙ্গমঞ্চ
১৮ বছর সংসার করার পর অনুভব করলাম জীবনের তাল কেটে গিয়েছে। কোথায় যেন আমার আমিটাকে আর খুঁজে পাচ্ছিনা। ভার্সিটি লাইফে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো দুরন্ত মেয়েটা ঘরকুনো হয়ে গিয়েছে। আর রাশেদ? সেও কি আগের মতো আছে? আমার মস্তিষ্ক চিৎকার করে বলে উঠে, 'নেই, নেই, নেই!' কিন্তু ঐ যে মন। বাঁধনহারা, ছন্নছাড়া, বাস্তবতা বিমুখ হতচ্ছাড়া মন কিছু বুঝতে চায় না। রাশেদের সাথে আমার বনিবনা হচ্ছেনা আজ কিছু মাস যাবতই। ছেলে-মেয়ে, সংসার সামলিয়ে নিজেকে আর সময় দিতে পারিনা। রাশেদের কাছে আমি বুড়ি, মোটা, কুৎসিত এক মানবী। অথচ তার চোখে একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রমণী ছিলাম আমি। আজ সন্ধ্যায় সে পাঁচ তারকা হোটেলে দাওয়াত খেতে গিয়েছে। আমারও যাওয়ার কথা ছিলো। ওর মতো ফিট, সুদর্শন মানুষটার পাশে নাকি আমাকে মানায় না। তাই অভিমানে আর যাইনি। পুরুষেরা কি এত বেইমান হয়! না, সব পুরুষ বেইমান হয় না। আম্মা, ব্রেন স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে পড়েছিলেন। আম্মাকে ঔষুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে গোসল করানো সব আব্বা করতেন। আম্মা যখন ছলছল নয়নে আব্বার দিকে তাকিয়ে থাকতেন তখন আব্বা হেসে বলতেন,
"আমাদের জন্য তো অনেক করেছো বুশরার মা। এবার না হয় আমাদের করার পালা।"
তারপর জানালার পাশটায় দাঁড়িয়ে দুজনে ভোরের সূর্য উদয় দেখতেন। আম্মা হুইলচেয়ারে বসে অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আর আব্বা দেখতেন আম্মাকে। আম্মা মা'রা যাওয়ার মাস দুয়েকের মাথায় আব্বাও চলে যান আমাকে এতিম করে। পাশের বাড়ির কবির ভাই। মনোরমা ভাবী আজ আট টা মাস যাবত ক্যান্সারে ভুগছেন। কোমড় সমান চুলগুলো আর নেই। শরীরটা একেবারে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। প্রায়শই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি ভাবীকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন ভাই। মানুষটার চোখে মুখে কোনো বিরক্তি নেই।
রাশেদের পরিবর্তনের পিছনে অবশ্য কারণ আছে। খবর তো টুকটাক আমার কানে আসে। অফিসে হাঁটুর বয়সী এক কলিগের সাথে তার ভাব রয়েছে। তার এক বন্ধু আমাকে জানিয়েছেন বিষয়টা। এই নিয়ে আমাদের কথা কাটাকাটিও হয়েছে। তবুও বারবার সে ঐ মেয়েটার কাছেই ফিরে যাচ্ছে। আমি ঐ মেয়েটার সাথেও কথা বলেছি। কিছু কিছু মেয়ে যে এতটা বেয়াদব আর বেপরোয়া হয় আমার জানা ছিলোনা। মেয়েটার ভাষ্যমতে,
"আপনি পারলে আপনার হাসবেন্ড কে আঁচলে বেঁধে রাখুন। আপনার কাছে খুশি থাকলে তো আর আমার কাছে আসেনা।"
সত্যিই এই কথার পর আর কোনো কথা থাকেনা। তবে মন চেয়েছিলো তার এবং রাশেদের গালে দুটো থাপ্পড় দেই। মানুষ কি চাইলেই আর সব করতে পারে! ছেলের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বন্ধুদের সাথে ফার্মগেট থাকছে। এতে করে নাকি তার পড়াশোনা বেশি হবে। তাই আর মানা করিনি। মেয়েটার পরীক্ষা শেষ। দাদার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে।
বাসায় এখন আমি একা। সাতটা বাজে বোধহয়। আজ সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম।
রাস্তায় হাঁটছি। ছেলে-মেয়ের পরীক্ষার সময় সব প্রেশার থাকে মায়ের উপর। সত্যি বলতে শ্বাস নেওয়ার সময়টাও আমি পাইনি৷ পাশে পৌর পার্ক। খোলা মাঠ। মাঠের পাশে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগানো। ফুচকা বিক্রি হচ্ছে। কত তরুণ তরুণী! এক প্লেট ফুচকা খেলাম। অনেক দিন ফুচকা খাওয়া হয় না। বাসা থেকে মাত্র দশ মিনিটের দূরত্ব। আগে কত আসা হতো। ওমেন্স ওয়ার্ল্ড বিউটি পার্লার। ইংরেজিতে বড় বড় করে লেখা। আমার বান্ধবী স্মরণীর পার্লার এটা। সন্ধ্যায় রাশেদের বলা তীক্ষ্ণ বাক্যগুলো শোনার পর অনুভব করলাম আমাকে স্বার্থপর হতে হবে। নিজেকে ভালো রাখতে হবে। অন্যের জন্য নয় নিজের জন্য নিজেকে ভালো রাখতে হবে। স্মরণী আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছে বটে! অনেক গল্প করলাম। পেডিকিউর, মেনিকিউর করলাম। বাহ্! এত সুন্দর করে সময় কাটানো যায় আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। বাসায় ফিরার পর থেকেই দেখি রাশেদের মন খারাপ। কারণটাও আমি কিঞ্চিৎ জানি।
দুদিন যাবতই কালো মেঘের মতো হয়ে আছে রাশেদের মুখখানা। হঠাৎ হঠাৎ গর্জেও উঠছে অবশ্য। আজ আবার আমাকে সাহায্যও করেছে। খালা আসেন নি। থালাবাসনগুলো পড়েছিলো। ভেবেছিলাম পরে মাজবো। কিন্তু দেখি রাশেদই মেজে রেখেছে। বিয়ের পরে নতুন সংসারের সময়ও সে একই কাজ করতো। যত যাই করুক। অনেক ভুগিয়েছে, কাঁদিয়েছে আমাকে। এবার ও মজা বুঝুক।
বাসে উঠে বসে আছি। ভোরবেলা। রাতের কথাগুলো ভেবে হাসবো নাকি আফসোস করবো বুঝতে পারছিনা। রাশেদের কলিগ তমাল ভাই কল দিয়েছিলেন। উনি বেশ মজার মানুষ। বললেন,
"শুনছেন ভাবী। রাশেদ কে ছ্যাঁকা দিয়ে তার ছোট গার্লফ্রেন্ড বিয়ে করে নিয়েছে। বেচারা ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে আছে। কত টাকা খরচ করেছিলো মেয়েটার পিছনে। আহারে! কি বলেছে জানেন ভাবী?"
"কি বলেছে?"
"তোমার মতো বুড়োরা হলে সুগার ড্যাডি। টাকার বিনিময়ে তোমার সাথে সময় কাটানো যায় কিন্তু বিয়ে করা যায় না।"
আজ আমি স্কুল লাইফের বান্ধবীদের সাথে সিলেটে ট্যুরে যাচ্ছি। রাশেদকে একটি চিরকুট লিখে এসেছি।
ছ্যাঁকা খেয়েছে। এখন একা কিছুদিন সময় কাটানো দরকার তার। টুং করে মেসেজ আসলো।
"আই এম সরি বুশরা। ভুল করেছি। ক্ষমা করে দিও। সাবধানে যেও।"
আমি অবশ্য রিপ্লাই দেইনি। থাকুক একা কিছুদিন। জীবন নামক রঙ্গমঞ্চ সত্যি অদ্ভুত!
রঙ্গমঞ্চ || আনিকা রাইশা হৃদি
আনিকা রাইশা হৃদি একজন লেখক, যিনি বাস্তবিক জীবনের নানা দিক নিয়ে লেখালেখি করতে ভালোবাসেন। তার লেখায় জীবনের বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতাগুলো গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়, যা পাঠকদের সাথে সহজেই সংযোগ স্থাপন করতে পারে।