রাতের অতিথি
কুরবানীর ঈদের তখনও আর দুই-তিন বাকী। ঈদের আগে বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনে শিকড়ের টানে বাড়ি ফেরা মানুষের অনেক ভিড় থাকে। তাই ঈদযাত্রাকে নির্বিগ্ন করার জন্য ঠিক করলাম, ঈদের তিন দিন আগেই দেশের বাড়িতে চলে যাবো। কিশোরগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্য বাস ছাড়ার সময়সূচী সকাল ১০.০০ টায়। তাই আগের দিন রাত থাকতেই কাপড়চোপড়সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঠিক করে কাজ এগিয়ে রাখছিলাম। পরিবার-পরিজনদের সাথে ঈদ করবো, এটা ভেবেই মনে একটা ভালোলাগা কাজ করছিলো। আমরা সবাই নিজ নিজ ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত ছিলাম। হঠ্যাৎ কানে বাজলো, দরজার ঠক্ ঠক্ আওয়াজ। আমি কী ভুল শুনলাম! দরজার জোড়ে জোড়ে কে যেন কড়া নাড়লো। রাত সাড়ে নয়টায় কে হতে পারে?
আবারও দরজায় কড়া। এভাবে থেমে থেমে বার বার দরজায় কড়া। আমরা সবাই প্রায় চিন্তায় পড়ে গেলাম। অজ্ঞাত স্বরকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলাম, "দরজায় কে?"সাড়া না পাওয়ায় আবার জিজ্ঞাস করলাম। কিন্ত তখনও কোনো প্রতুত্তর পেলাম না। কেবল দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দ।
কী আপদ! সাড়া না দিলে বুঝা মুশকিল যে, দরজার অন্যপাশে কে? তাছাড়া ঈদের আগে এতো রাতে চোর-ডাকাতও আসতে পারে! আমাদের সবার মধ্যেই আতঙ্ক বিরাজ করছিলো। তবে আমার বাবা সাহস করে দরজার কাছে গেলেন। আমি, আম্মু অনতিদূরে বাবার পিছনে দাঁড়ালাম। বাবা দরজার কাছে গিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলেন, "কে?" এবারও জবাব পেলাম দরজায় ঠক্ ঠক্ আওয়াজে। বাবা দরজা খোলার ব্যাপারে জিজ্ঞাসু চোখে আমাদের দিকে তাকালেন। আমি আর আম্মু মনে ভয় আর বিস্ময় রেখে সায় দিলাম।
বাবা দরজা খুললেন। দরজা খোলার পর দেখলাম, দরজার পাশে ঠেস দিয়ে জীর্ণ-শীর্ণ শরীর আর মলিন বস্ত্রে এক বৃদ্ধ। তার হাতে একটা লাঠি আর কাঁধে একটা ঝোলা। বয়সের ভারে এতোটাই ন্যুয়ে পড়লো যে, কথা বলারও শক্তি নেই তার। দেখে মনে হলো ,কয়েকদিন কোনো খাবার পেটে পরে নি তার। তাই ভেবে, আম্মু পাতিলে রাখা ভাত ,মাংসের তরকারি আর ডাল একটা প্লেটে করে বৃদ্ধ লোকটিকে খেতে দিলো। দেখলাম, কতোটা তৃপ্তি সহকারে খাবার খাচ্ছে বৃদ্ধ লোকটি। আহারে, এই বৃদ্ধ বয়সে কেউ তার পাশে নেই!
বৃদ্ধের গায়ে অর্ধ-ছেড়া মলিন বস্ত্র দেখে মায়া হলো। বাবার খেয়ালে এলো, বাবার পুরোনো দু'টো পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি আছে। পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি দু'টো বৃদ্ধ লোকটিকে দেওয়া যায়। তাই আলমারি থেকে পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি বের করলাম। বৃদ্ধ লোকটি ততক্ষণে খাওয়া শেষ করলো। পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি পলিব্যাগে করে বৃদ্ধ লোকটিকে দিলাম। এবার তার চোখেমুখে তৃপ্তির আনন্দ দেখা গেলো। সেই আনন্দে কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ থেকে দু-এক ফোঁটা অশ্রুধারা গড়িয়ে গেলো। বৃদ্ধ লোকটি দু'হাত উর্ধ্বে তুললো। হয়তো আমাদের ধন্যবাদ জনালো।
তারপর কাঁধের ঝোলাটি নিয়ে লাঠিতে ভর করে উঠে দাঁড়ালো। লাঠিতে ভর করে এগুতে লাগলো। একসময় বৃদ্ধ লোকটি প্রস্থান করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। লোকটির জন্য মায়া হলো। আমরা পরিবার-পরিজনদের সাথে ঈদ করবো। আর এই বৃদ্ধ লোকটির কী হবে? কেউ যে তার পাশে নেই। তবুও আমাদের যতটুকু সামর্থ্য ততটুকু বৃদ্ধ লোকটির জন্য করেছি। বাকিটুকু আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিলাম। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম, আল্লাহ যেন বৃদ্ধ লোকটির মঙ্গল কামনা করেন।
রাতের অতিথি ।। সাবরিনা তাহ্সিন
একজন বই প্রেমিক। তিনি বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। পেশায় তিনি একজন কনটেন্ট রাইটার। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের জন্য তার অন্যরকম ভালোলাগা ও ভালোবাসা। লেখালেখি, ছবি আঁকা, রচনা প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে অনেক পুরষ্কার প্রাপ্তি ঘটেছে। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই তিনি বই নিয়ে বসে যান, এছাড়াও অনলাইন পত্র-পত্রিকা ,ম্যাগাজিনেও লেখালেখি করা হয়। হুমায়ূন আহমেদ তার প্রিয় লেখক। বই পড়ার পাশাপাশি তিনি কবিতা, ছোট গল্প এবং মনোমুগ্ধকর বইয়ের রিভিউ দিয়ে থাকেন।