পরাণচুল্লি
পরাণচুল্লি- বইয়ের নাম হিসেবে বেশ আগ্রহ জাগানিয়া! পরাণের গহীন ভেতরের দোদুল্যমান জীবনের কথা বলে পাঠকনন্দিত মোহিত কামাল স্যারের এই অনন্য সাহিত্যকীর্তি। কি এমন আছে বইটিতে?
একজন সন্তান তার নিত্যকার জীবনাচরণের রৌদ্রময় দিনগুলোতে ছায়ালো গুবাক তরুর মতোই পাশে পায় তার বাবাকে। সেই স্নেহার্দ্র পিতার অকালপ্রয়াণে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয় উপন্যাসের মূল চরিত্র রোমানা মিতুর, পুরোটা সময় জুড়ে যে চরিত্র প্রাণোচ্ছলতায় ভরপুর ' মিতু ' নামে। আসন্ন পরীক্ষার ফর্ম ফিলিং এর দুঃশ্চিন্তার পাশাপাশি কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় একটা গোটা পরিবারের ভবিষ্যতের ভাবনা। এই দুঃখ রথের সারথি হয়ে ওঠেন ওবায়েদ আঙ্কেল। মিতুকে ধার দেয়া হয় আঠারো হাজার টাকা।
কিন্তু শর্ত একটাই- এ ঋণদাতার পরিচয় মিতু গোপন রাখবে। কিন্তু কেন?
সময়ের পরিক্রমায় এই গুপ্ত দেনার খবর চার কান হয়। চরিত্রে কালিমা লেপে দিতে দুবার ভাবে না মিতুরই এককালীন বন্ধুমহল। নিতান্তই কানাঘুষো যখন চরমে ওঠে, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে নানাবিধ মুখরোচক তথ্য। মিতুর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তাকে কোণঠাসা করার চক্রান্ত চলতে থাকে অহর্নিশ। হুমকির চৌকাঠে হোঁচট খেতে থাকে মিতুর নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার প্রচেষ্টা, তাকে ঘিরে প্রয়াত বাবার স্বপ্ন। একমাত্র যাচাইয়ের অভাবে এভাবে পথে বসে হাজারো মিতুদের স্বপ্নরথ। সেই স্বপ্নরথের তাজি ঘোড়ায় চেপে মিতু কি পৌঁছাতে পারবে সফলতার শিখরে, নাকি এখানেই থেমে যাবে তার জয়যাত্রার গল্প? জানতে হলে পড়ে দেখতে পারেন বইখোরের দল, মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারার ক্রমগতি বুঝবার জন্যে এটি হতে পারে পাঠকের প্রথম পছন্দ।
ব্যক্তিগত মতামত:
মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই বিপদ তার পায়ে পায়ে আসে। কারণ মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, বিপদের গন্ধ টের পেলে সে ঘাবড়ে না গিয়ে প্রমাণ করে, "বুদ্ধি যার, বল তার"। ঠিক তেমনি উপন্যাসের পরতে পরতে আমাদের রোমানা মিতুও প্রমাণ করেছে, এভাবেও ফিরে আসা যায়। হিতৈষী বন্ধুদের নিয়ে যেমন উচ্ছাসের ভেলায় ভেসে যাওয়া বিজয়ের প্রতিচ্ছবি আছে এখানে, তেমনি আছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পার হবার পন্থা। সহমর্মী সিনিয়রদের সাথে সম্পর্কের সাদাকালো ও রঙিন উভয় পিঠেরই দেখা পাবেন এতে। সমাপ্তিরেখা টানাপ্রসঙ্গে লেখক সূচিত করেছেন এমন এক রহস্যের যার উদঘাঠন পাঠককে চমকে দেবে এবং উন্মুখ করবে পরাণচুল্লির অম্লমধুর জগতে পুনঃপ্রবেশ করতে। মায়াডোরে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা মানবজমিনে উত্থান পতনের এ এক জীবনঘনিষ্ঠ দলিল, ভাবার্থে সাবলীল।
বই থেকে প্রিয় কয়েকটি লাইন:
শোনো, ফাইনালি আমি অনুমোদন না দিলে তো তুমি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে না। তো নেতাদের প্রাথমিক বাছাইয়ে কীভাবে সুযোগ নিলে? কীভাবে অনুমোদন বাগালে? বিছানায় শুয়েছো? হেসে ফেললো মিতু। এই হাসির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলো তার ভেতরের অন্য রকম শক্তি। সেই শক্তিতে জ্বলে উঠেও ক্ষুব্ধ হলো না। বললো, বাহ! উত্তরটা তো আপনার বা আপনাদের জানা আছে। যেভাবে আপনারা বাগিয়েছেন, শুয়ে-বসে! আমিও সেভাবে না হয় বাগিয়ে নেব! অসুবিধা আছে? কথা আছে না, আগের লাঙল যেভাবে যায় সেভাবেই পরের লাঙল পথ খুঁড়ে এগোয়! জানেন না?
ভ্যান গাড়িটাকে মৌমাছির চাকের মতো ঘিরে আছে তরুণ-তরুণীদের দল। বিরামবিহীনভাবে দু হাতে কাজ করে যাচ্ছেন ষাটোর্ধ্ব ফুচকা দাদু। নিশ্চয়ই কোনও জাদু আছে তার ফুচকাতে। মনে এলো জ্যোতি ভাইয়ার কথা। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল বিশ্বকবির এক গুরুত্বপূর্ণ কথা- ' সম্পর্ক যদি ভাবনার সাথে মিশে যায় তা ভাঙা মুশকিল। আর যদি স্বার্থের সাথে মিশে যায়, তাহলে তা ঠেকানো মুশকিল।
চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ঘুরে ঘুরে তা উড়ে যাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে শূন্যে। আর নতুন বাবার খবর শুনে মিতুর মনে হলো বুকের ভেতর থেকেও গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কুণ্ডলি পাকাচ্ছে কেবল, উড়ে যাচ্ছে না। মনে হলো পরাণচুল্লিতে আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। তেজস্ক্রিয়তা নয়, বিষক্রিয়ায় নীল হয়ে উঠছে পুরো দেহ। শক্ত করে সে জড়িয়ে ধরল মাহরিমাকে। তারপর তাকাক জ্যোতির মুখের দিকে। দেখল সেই মুখে বসে আছে এক অচেনা বাজিকরের মুখ। সে-ই ওড়াচ্ছে বিষমাখানো পতাকা পরানের গহীন ভিতর।
বই পরিচিতি :-
বই: পরাণচুল্লি
লেখক: মোহিত কামাল
প্রকাশনী: বিদ্যাপ্রকাশ
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
জনরা: সমকালীন উপন্যাস
মুদ্রিত মূল্য: ৫০০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৯২
পরাণচুল্লি || তাসফিয়া ইসলাম লাবণ্য
তাসফিয়া ইসলাম লাবণ্য একজন উদীয়মান লেখক, ১৯৯৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর যার জন্ম। সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি ষষ্ঠ শ্রেণির শেষ থেকেই। এরপর আর থেমে থাকেনি তাঁর কলম। কবিতা তাঁর রক্তে নেশার মতো প্রবহমান। কবিতাকে বুঝতে হয়, বুকের ভেতর সবাই কবিতা পোষে, কিন্তু তার শব্দ শুনতে পায় খুব বেশি সরল স্বভাবের মানুষেরা। লেখকের শতভাগ বিশ্বাস তিনি একজন সাদা মনের মানুষ। পাঠকের মনোজগতে ছাপ ফেলার স্বপ্নই তাঁর লেখালেখির অনুপ্রেরণা। বর্তমানে তিনি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত। কবির প্রার্থনায় তার পুরো পাঠকসমাজ এবং বেলাশেষে তাঁর ছায়াসঙ্গী কবিতাগুলো।