অপমৃত্যু নাকি দুর্ঘটনা
Winner of the Month based on Judges panel vote (June, 2024)
পাখির কিচির-মিচিরে এক সোনালি সকালে নিদ্রা ভঙ্গ হলো মিমের। জানালা ঠিকরে হালকা মিষ্টি রৌদ্রের আলোকছটা তার কপোল স্পর্শ করে গেলো। ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাড়ে আটটা বাজতে চললো। মিমকে সকাল দশটায় ক্লাসে যেতে হবে। মিম সরকারি মুসলিম স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্রী। দ্বাদশ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা সন্নিকটে। তাই প্রতিটা ক্লাসই তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মা সুলতানা বেগম মিমকে তৈরি হতে তাড়া দিচ্ছেন------
" মিম, তাড়াতাড়ি তৈরী হও। তোমার ক্লাসের সময় হয়ে গেলো যে। "
মিম দ্রুত তৈরী হতে হতে মাকে আশ্বাস দিয়ে বলে যে, "এইতো মা, আমি তৈরী। বই পত্র গোছানো হয়ে গেছে। এখন খেতে দাও। "
সুলতানা বেগম মেয়ের জন্য নাস্তা তৈরী করে খাবার টেবিলে রাখলেন। মিম চটজলদি নাস্তা করে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
ওদিকে মিমের দুই বছর বয়সী ছোট ভাই মিহির অনবরত কেঁদেই চলেছে। বেশ খিদে লেগেছে হয়তো। দাদী মিহিরকে কোলে নিয়ে কান্না সামলানোর চেষ্টা করে চলেছেন। মা রান্নাঘরে ছোট মিহিরের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত।
ময়মনসিংহ শহরের গোলাপজান রোডের এক পাশে চারতলা বাড়ি।সেই বাড়ির দুইতলায় মিমরা ভাড়া থাকে। সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ। জননিরব হলেও যান্ত্রিক কোলাহল আর পাখির কলতানে সব সময়ই মুখরিত থাকে।
মিমের বাবা শহীদুল হক একটা NGO তে কর্মরত। মা-বাবা-ভাই-দাদী মিলে মিমদের ছোট সুন্দর সুখী পরিবার। কিন্ত এই সুখ-আনন্দের রেশ বেশীদিন রইলো না । এতো আনন্দের মাঝে যে বিপদের অশনিসংকেত বেজে উঠবে তা কেউ ক্ষুণাক্ষরেও টের পায় নি।
বেশ ক'দিন ধরেই বৈদ্যুতিক লাইনে সমস্যা হচ্ছে মিমদের বাসায়। বৈদ্যুতিক শকটে প্লাগ দিতে গেলে বিদ্যুৎ তাড়িত হয়। ভোল্টেজও উঠা নামা করে। শহীদুল হক বাড়ীওয়ালাকে বিষয়টা জানালেন। বাড়ীওয়ালা আশ্বাস দিলেন যে, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি ডেকে এনে ঠিক করে দিবেন। কিন্ত বিদ্যুৎ মিস্ত্রির কোন খবর নাই। বৈদ্যুতিক ত্রুটির মাঝেই ভয়-সংশয় নিয়ে কেটে গেলো বেশ কিছুদিন। শহীদুল হক বাড়ীওয়ালাকে বিদ্যুতের সমস্যার কথা মনে করিয়ে দিলে বাড়ীওয়ালা বিদ্যুতের কাটাওয়াটে সমস্যা থাকতে পারে বলে উড়িয়ে দিলেন।
বিল্ডিং সংশ্লিষ্ট বাসার আর্থিংয়ের তারটা হঠ্যাৎ মেইন লাইন থেকে আলগা হয়ে খুলে যায় এবং প্রায় গেটের সামনে ঝুলে থাকে। বাড়িওয়ালা বিষয়টা দেখেও কোনো দৃষ্টিপাত করেন না। অন্য ভাড়াটিয়াও বিষয়টা এড়িয়ে চলেন। যদিও তারা সবাই জানে, আর্থিংয়ের তার এভাবে গেটে ঝুলে থাকাটা অনিরাপদ।
শ্রাবন মাসে মেঘলা হাওয়ার উন্মাদনায় বর্ষণমুখর দিন। আর্থিংয়ের তারটা গেটের মধ্যে তখনও ঝুলছে। তাই গেটের সামনে দিয়ে যাতায়াতই অনেক বিপজ্জনক।
বৃষ্টিস্নাত দিন থাকায় কাউকে খুব একটা বের হতে হচ্ছে না। কিন্ত মিমকে কলেজে যেতেই হবে। সে অনেক সন্তর্পণে গেট খুলে সকাল সকাল কলেজে রওনা দিলো। সামনে নির্বাচনী পরীক্ষা।বিকেলে কোচিং এর ক্লাস। তাই বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাবে। দিনটা অন্যান্য দিনের মতোই ছিলো। সকাল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে।
সুলতানা বেগমের মনে কেন যেন কু-গাইছে। কোনো বিপদ হবে না তো ! শহীদুল হক বেলা থাকতে থাকতে কর্মস্থল থেকে বাড়ী ফিরে আসলেন। দুপুরের খাবার খেলেন পরিবারের সাথে। বিকেল পাঁচটা বাজে। সুলতানা বেগমের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। মিম কখন বাসায় ফিরবে ? মিমকে বারবার কল দিয়ে যাচ্ছেন। সুলতানা বেগমের অস্থিরতা দেখে শহীদুল হক আশ্বস্ত করে বললেন ,"চিন্তা করো না তো। মিমের সামনে পরীক্ষা।তাই কোচিংয়ে হয়তো বেশীক্ষণ ক্লাস হচ্ছে। ক্লাস শেষ হয়ে এসে পড়বে। বেশী দেরী হলে আমি কোচিং এ গিয়ে নিয়ে আসবো--কেমন ।এবার একটু শান্ত হও। "
শহীদুল হকের কথায় মিমের মা কিছুটা শান্ত হলেন।
তবুও মায়ের মন বলে কথা। একটু চিন্তা তো করতেই হয়। একে তো বর্ষণমুখর দিন,তার উপর রিক্সা না পাওয়া আরেক বিপত্তি। তাই মিমকে অনেকখানি পথ হেঁটে আসতে হয়েছে। এজন্য বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা। বাইরে মৃদু আলোয় জ্বলছে স্ট্রীট লাইট। মেঘলা আবহাওয়ার কারণে চারপাশটা কেমন যেন ঘোলাটে। মিম তার ফোনের ফ্লাশলাইট অন করলো।
ফোন স্ক্রীনে চোখ রাখতেই দেখলো মায়ের অনেকগুলো মিসডকল। মিম মনে মনে ভাবলো, বাড়ীতে কোনো বিপদ হলো না তো!
তাই মাকে ফোন দিলো। মা ফোন রিসিভ করে সংশয়ে অভিমানের সুরে মিমের কাছে জানতে চাইলেন, "কতোবার ফোন করে যাচ্ছি, ফোন ধরো নি কেন ?"
মিম ক্লান্তি মাখা কন্ঠে মাকে জানালো, "মা, চিন্তা করো না। ক্লাসে ছিলাম। ফোন সাইলেন্ট মোডে ছিলো। আর বৃষ্টির জন্য রিক্সা পেতে দেরী হয়েছে। আমি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। "
আর্থিংয়ের তারটা যেভাবে ঝুলছে, এখন তো বিপদ আরও বাড়লো। মা মিমের বাবাকে নিয়ে ত্রস্তবেগে নিচে নামলেন। মিমের দাদী অসুস্থ থাকায় নিচে আসতে পারছেন না। বাতাসে আর্থিংয়ের তার জরানো গেটে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, গেট দিয়ে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। মিম ঝোঁকের মাথায় গেটে হাত রাখলো।হাত রাখতেই বিদ্যুতায়িত হলো। সুলতানা বেগম সংশয় মিশ্রিত কন্ঠে মিমকে গেট থেকে স্বাভাবিক দূরত্ব বজায় রাখতে বললেন। ছোট মিহির মায়ের কোল থেকে নামছেই না। তাই শহীদুল হক মেয়েকে উদ্ধার করতে ছুটে গেলেন। সুলতানা হক স্বামীকে বাঁধা দিলেন এই জন্য যে, যাতে কারও কোনো ক্ষতি না হয়। সাহায্যের জন্য কাউকে ফোন করা দরকার। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে নেট নেই। একটা বড় লাঠি জাতীয় কিছু পাওয়া গেলে সন্তর্পণে তারটা গেট থেকে সরিয়ে নেওয়া যেতো। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। সুলতানা-শহীদুল দম্পতি সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি শুরু করলেন। কিন্ত এতো বড়ো বাড়ীর কোনো সদস্যদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া গেলো না। চারদিক নিরব, নিস্তব্ধ। চারপাশের সব কিছুই যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। সুলতানা বেগমদের সহযোগিতার আহাজারি যেন কারও কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না।
শহীদুল হক হাল ছাড়েন নি। মেয়েকে উদ্ধারের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মিম ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে গেছে। এতোটুকু নড়াচড়া করার ক্ষমতা তার নেই। শহীদুল হক ছাতা দিয়ে আর্থিংয়ের তারটা সরানোর অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্ত তাতে কোনো লাভ হলো না। বড় লাঠির দেখা মিললো না। ওদিকে মেঘের গর্জনে বৃষ্টির আগমনী রব ধ্বনিত হলো। তাই শহীদুল হক অনতিবিলম্বে আর্থিংয়ের তারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটে গেলো যেন, মুহূর্তের জন্য মিম, সুলতানা বেগম পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ইতিমধ্যে স্থানীয় লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। বাড়িওয়ালা সুদূরে দাঁড়িয়ে তা প্রত্যক্ষ করলেন। অ্যাম্বুল্যান্স ডাকা হলো। মিমের বাবাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলো। কিন্ত শেষ রক্ষা হলো না। বিদ্যুৎ স্পৃষ্ঠে মিমের দু'হাত দগ্ধ হয়েছে। উপরন্তু বাবার মৃত্যুসংবাদ তাকে ভীষণভাবে ব্যাথিত করলো। মিমের আর পরীক্ষা দেওয়া হলো না। পরীক্ষা দেওয়ার বদলে তার ঠাঁই হলো হাসপাতালের বিছানায়। মিমদের বাড়িতে আনন্দের পরিবর্তে শোকের মাতম। আর্তনাদ, আহাজারিতে ভারি হয়ে গেলো বাড়ীটা।
একটা সামান্য অবহেলা কতো বড়ো দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে, শহীদুল হকের অপমৃত্যু তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
অপমৃত্যু নাকি দুর্ঘটনা ।। সাবরিনা তাহ্সিন
একজন বই প্রেমিক। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের জন্য তার অন্যরকম ভালোলাগা ও ভালোবাসা। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই তিনি বই নিয়ে বসে যান। হুমায়ূন আহমেদ তার প্রিয় লেখক। বই পড়ার পাশাপাশি তিনি কবিতা, ছোট গল্প এবং মনোমুগ্ধকর বইয়ের রিভিউ দিয়ে থাকেন।