অজানা বেলা
“আমরা কি জিন্দা আছি রে?”
জমিলা ইট কনক্রিটে চাঁপা দশায় মেয়ে সালেহাকে জিজ্ঞেস করে।
শহরে রিকটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে বৃহস্পতিবার রাতে। মারা গেছেন ২০ লাখের ওপর মানুষ। জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। এখানে-ওখানে লাশ আর ভবনে ভবনে আটকে পড়া আহতদের বাঁচার আঁকুতি।
জমিলা-সালেহার বাসা মিরপুর রূপনগরে। মা, মেয়ে দুজনই গার্মেন্টে কাজ করেন। থাকেন একরুমের সাবলেট ঘরে। ওভারটাইম শেষে ঘরে ফিরেছিল ওরা প্রতিদিনের মতো। রাতের খাবার খেয়ে মেঝেতে পাতা তোষকে ঘুমায় মা, মেয়ে। এর মধ্যে গভীর রাতে ঘটে যায় দুর্যোগ।
শহর ঢাকাকে এখন চেনার উপায় নেই। অল্প কিছু বাড়ি বাদে পুরো শহর যেন মাটির নিচে দেবে গেছে। বেশিরভাগ রাস্তা বন্ধ। গ্যাস ও ইলেক্ট্রিক লাইনের বিস্ফোরণে এখানে ওখানে আগুন জ্বলছে। তা নেভানোর ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির তীব্র সাইরেন ও কিছু হেলিকপ্টারের ওড়াওড়ি ছাড়া শহর এখন নিস্তব্ধ। মৃত্যুপুরীর আরেক নাম এ সময়ের ঢাকা।
আন্তর্জাতিক উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছেছেন বিভিন্ন দেশ থেকে। কিন্তু তারা কী করবেন? এর মধ্যে মানুষের মৃতদেহ পঁচে গলে মহামারীতে রূপ নেওয়া শঙ্কা করছেন অনেকে।
এত কিছু জানা নেই জমিলা-সালেহা মা, মেয়ের। সালেহা মায়ের কথার উত্তরে শুধু গোঁঙায়। এই এতটুকুই জিন্দা থাকার অবশেষ। তাদের ওপর যে দেয়ালসহ পিলার পড়েছে তাতে তিল পরিমাণ নড়ার সামর্থ্য নেই কারও। গাঢ় অন্ধকারের এক জগৎ। পেশাব-পায়খানা সেখানেই। ইচ্ছা করে কেঁদে খোদার কাছে মৃত্যু চাওয়া। ক্ষত-বিক্ষত শরীরে অনাহারে গলায়ও নেই সে স্বর।
সালেহার মনে পড়ে নানাবাড়ির স্মৃতি। ছোটবেলায় এক রাতে লুকোচুরি খেলার সময় সে অন্ধকার ধানের গোলার ভেতরটায় লুকিয়েছিল। কেউ তাকে খুঁজে পায়নি। এরপর এক সময় সে বেরিয়ে আসে। খেলা ততক্ষণে শেষ।
ঐ রাতে তুমুল জোছনা ছিল গ্রামে। বাড়ির দরজায় বড়রা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে যাত্রাপালা দেখছিল। সালেহার বাবা বরকত আলী জীবিত তখন। গঞ্জে তার ছিল পাইকারি দোকান। সালেহার দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি একই গ্রামে। ব্যবসায়ী বরকতের সঙ্গে নিজের মেয়ে জমিলার বিয়ে ঠিক করেন তার নানা। সালেহার জন্মের ১০ বছরের মাথায় হঠাৎ এক দুপুরে বুকে ব্যথা ওঠে বরকতের। গঞ্জের লোকেরা উপজেলা সদরের হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু বাঁচানো যায় না তাকে। তার মা জমিলা বিধবা হন। তখনও তারা নানাবাড়িতে। এখানেও বাধ সাধে প্রকৃতি। প্রবল নদী ভাঙনে পুরো গ্রামটিই বিলীন হয়। জামিলা, সালেহা ঢাকায় আসে। গৃহস্থ জীবনের ইতি ঘটে। রাজধানীতে তাদের পরিচয় হয়ে ওঠে পোশাক শ্রমিক।
জমিলার ঘাঁড়ে পিলারের রড ঢুকেছে মনে হয়। গত দুদিনে তা সম্ভবত কণ্ঠনালী ছুঁয়েছে। সে টের পাচ্ছে তার শ্বাস-প্রশ্বাস আর কথায় রক্ত ঝরছে। মৃত্যুর যত কারণ আছে তার সবই এখানে হাজির। তবু দমটুকু আছে আটকে পড়া মানুষ দুজনের। মৃত্যু তো যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু কিছু যন্ত্রণা অতিক্রম করে মৃত্যুকেও। ভূমিকম্পে আটকে পড়া মানুষগুলোর অবস্থা এখন তাই।
একটু আগে তন্দ্রায় জমিলা তার মাকে দেখেছে। ছোটবেলায় জমিলার মাথার চুলে উকুঁন হতো। সেগুলো তাড়াতে বাড়িতে আনা হয় এক বেঁদেনীকে। বেঁদে নারী দাবি করেন যতগুলো উকুঁন পাওয়া যাবে, তত সের চাল তার পারিশ্রমিক। মা তাতে রাজি হন। দুপুর নাগাদ সব উকুঁন মাথা থেকে বের করে চাল নিয়ে নৌকার দিকে যান বেঁদেনী। এরপর মা নিজ হাতে সাবান ডলে গোসল করান শিশু জমিলাকে। জমিলা এমন স্মৃতি এখন মনে হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পেল না। মাথা পোকামুক্ত করা আর এ দশা থেকে উদ্ধার পাওয়া ভিন্ন। জীবন সায়াহ্নে শৈশব মনে পড়ে। জমিলার মনে হয় তাই ঘটছে। সে না থাকলে বাপ মরা মেয়ে সালেহার কী হবে? সব বিবেচনায় জমিলা যৌথ মৃত্যু কামনা করে। তাদের মা, মেয়ের যেন এক সাথে মরণ হয়।
তা ঘটলে ২০ লাখের বেশি মৃত্যুর সঙ্গে আরও দুজন সংখ্যা মাত্র যোগ হবে। কিন্তু শহর কি মুক্তি পাবে? আবার গড়ে উঠবে ঢাকা? এই নিকষ আঁধারের অজানা বেলা এ প্রশ্নের উত্তর জানে না।
অজানা বেলা || হাসান শাওন
হাসান শাওনের নানাবাড়ি ও দাদাবাড়ি বরিশাল। জন্ম, বেড়ে ওঠা তার ঢাকার মিরপুরে। পড়েছেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বাঙলা কলেজ, বাংলাদেশ সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন ইনিস্টিটিউটে। ২০০৫ সাল থেকে তিনি লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেছেন সমকাল, বণিক বার্তা, ক্যানভাস ম্যাগাজিন ও আজকের পত্রিকা ও দৃকনিউজে।
২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর হাসান শাওনের প্রথম বই ‘হুমায়ূনকে নিয়ে’ প্রকাশিত হয়।