বেকার জীবনের কারাগার থেকে বলছি
অনেকদিন পর রাজীবের সাথে দেখা হবে অদ্বিতির। ভার্সিটি লাইফ শেষ হওয়ার পর তো আর দেখা হয় নায় দুজনের। দেখা করার কথা বিকেল চারটায়। কিন্তু জ্যামের শহরে ট্যক্সিতেই অদ্বিতির বেজে গেছে পাঁচটা। রাজীব কি দাঁড়াবে! তার তো আবার একটা টিউশন আছে এই সময়ে।
ঠিক! রাজীব দাঁড়ায় নি। গাছের নিচটা ফাঁকা। কেউ নেই—তাও গিয়ে বসল অদ্বিতি। হঠাৎই চোখে পড়ল নীল রঙের ডায়রিটা। কোন এক জন্মদিনে রাজীবকে সে দিয়েছিল। হয় তো তাড়াহুড়োয় ফেলে রেখে গেছে। আধখোলা ডায়রিটার একটা পাতা ভাঁজ করা। সেখানে রাজীবীয় ভঙ্গিতে লেখা আছে কিছু কথা। আনমনেই পড়তে শুরু করে অদ্বিতি।
নাহ এভাবে আর পারছি না। রোজ রোজ অপমানিত হওয়ারও একটা সীমা থাকা উচিত। আজকে সবার সামনে বলে দিল," ইউ ব্লাডি ইডিয়ট। তোমার মত এমন হাজার হাজার ছেলে ঘুরে বেড়ায়। তোমার চেয়েও কোয়ালিফাইড ছেলে আছে। যাও বাজারে বসে চায়ের দোকান দাও। কিছু খেতে পারবে।" আমাদের বাসার সামনে বসা থাকা কুকুরটাকেও বোধহয় এভাবে কেউ বলে না। খুব বেশি হলে একটা তাড়া দেয়। এভাবে ধরে ধরে কেউ বলে না বোধহয়। তাই ঠিক করলাম এ জীবন থেকে ছুটি চাই।
সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। ছাদের একটা কোণায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাবলাম ঝাঁপ দিব। কিন্তু জীবনের প্রতি লোভটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। এই তো সেদিনও বাড়ি থেকে আসার পথে বৃষ্টি হচ্ছিল। মা ডেকে বলল," ওই মুড়ির টিনটা খুল তো বাবা।" খুলে দেখলাম এক হাজার টাকার বেশ ক'টি নোট। মা বলল," যা লাগবে নিয়ে যা। তোর জন্যই রেখেছি।" সেদিন সামলাতে পারেনি নিজেকে। বিদায়বেলায় মাকে বলতে পারি নি, "মা এসো আমার ব্যস্ত শহরে"। বৃষ্টির জল আর চোখের জল মিলেমিশে একাকার।
এই তো সেদিনই বাবা এসেছিল আমার শহরে। ঘুরে দেখলাম এই ব্যস্ত শহরের যান্ত্রিকতা। আমার থাকার জায়গা দেখে বাবার চোখে জল চলে এল। বুঝেছি তাও বললাম,"জল কেন তোমার চোখে বাবা?" অসহায় বাবার একটাই উত্তর," চোখে কি যেন পড়েছে রে বাবা!" বিদায় বেলায় বাবা হাতে পাঁচশ টাকার একটা নোট গুজে দিয়ে বলল, " কিছু আনতে পারি নি রে তোর জন্য। এটা রেখে দে, কিছু কিনে খাস।" বাবার পকেটে থাকা একমাত্র সম্বল সেই টাকাটা হাতে ধরে বললাম," তুমি যাবে কিভাবে বাবা?" সাহসী বাবার উত্তর," আরে ধুর! আরো টাকা আছে রে বুক পকেটে!"
উফফ! এত ভালোবাসা। এই ভালোবাসাগুলোয় তো আমাকে লোভী বানিয়ে দেয়। এই বন্দি কারাগার থেকে বেরোতে দেয় না। তাই তো ছুটি চাইলেই তো ছুটি মিলে না। খালি আশায় থাকি। একটা চাকরি হাতে আয়েশ করে সবার সাথে এক প্লেট ভাত-মাছ-তরকারি খাচ্ছি।
ডায়রির পাতাটা অজানা এক জলে ভিজে যাচ্ছে। কি জানি, আকাশের লুকিয়ে রাখা কান্না নাকি অদ্বিতির না বলা একটা আক্ষেপ!
বেকার জীবনের কারাগার থেকে বলছি || মোঃ তাসদীকুল হক
জন্ম ২০০২ সালে পদ্মা নদীর পাড়ে রেশমের জন্য খ্যাত রাজশাহী নগরীতে। স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে তিনি এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত। তিনি বর্তমানে লেখালেখির কাজের সাথে জড়িত।