পরিচয়_মালিনী নাকি মিসেস শফিক
আজ সাত বছর পর আবারো পা রাখছি আমার ফেলে আসা মেয়েবেলার সেই সবুজ নিমপাতা আর সজনের ডালে ঘেরা গোলাপি তিনতলা বাড়িতে। পাড়াতে ঢুকতেই কেমন জানি একটা কৃত্রিমতার গন্ধ! আমার চেনা সেই বুড়ো-পেট মোটা আমগাছটা আর নেই। সেখানে মাথা চাড়া দিয়েছে নয় কি দশ তলার একটা আধুনিক ভবন। গোলাপি বাড়ি আজও আছে ঠিকই কিন্তু চারপাশের কৃত্রিমতায় কেমন জানি ফিকে হয়ে গেছে তার জৌলস। সেই সাথে গোলাপি রঙেও কেমন একটা কালচে ছোপ পড়েছে। সবই সময়ের সাথে এগিয়ে চলা।সেই বাস্তবতা মেনেই মায়ের হাত ধরে আবার কোন এক সোনালি বিকেলে হালকা শীতের মিষ্টি কুয়াশায় আমার ফিরে আসা।
এসেই একটা দীর্ঘশ্বাস। ছোট শিশু যেমন মায়ের আঁচলের গন্ধ শুঁকেই বুঝে নেয়, ঠিক তেমনি আমারও মনে হল এই পাড়া, এই জায়গা আমার খুব চেনা।পাড়াতে ঢুকতেই আগে একটা বিশাল দাড়িওয়ালা বটগাছ স্বাগত জানাত। সময়ের বিবর্তনে আজ শুধুই স্মৃতি।
কিছুদূর হেঁটে গেলেই ছিল এক চাচামিয়ার দোকান। টিনের ঝাপ দেওয়া ঠুনকো এক দোকান। তাও তার দোকানের ওই ভাজা বিস্কুট ছাড়া আমাদের কারো চায়ের আসর জমতই না। সে পাড়ার ছেলেই হোক বা বিকেলবেলা সুখ-দুঃখের গল্প বাটতে বের হওয়া আন্টিরাই হোক! পাড়ার পুরুষরা অবশ্য এ দোকানে ভিড় জমাত না। তাদের জন্য ছিল আলাদা এক দোকান। কতদিন পাশের বাসার মিনার সাথে গিয়েছি চাচার দোকানে। সেই সময় টিফিনের টাকা জমিয়ে আমি আর মিনা মিলে একটা চুলে বাধার ফিতে কিনেছিলাম। সেই ফিতে মিনার কাছেই থেকে গিয়েছিল। কিন্তু সেই মিনা আজ কোথায়? জানি না! হয়তো এমনি কোন এক বিকেলে মিনাও এসেছিল,হয়তো চুলে ফিতে বেঁধে, হয়তো অপেক্ষাও করেছিল আমার জন্য! আমিই ছিলাম না বোধহয়!
পাশের বাড়ির রিতা ভাবির সাথে আবার আমার মায়ের সেই খাতির ছিল। তাদের বাসার সাথে আমার বাসা ছিল গালে গাল লাগানোর মত। আর মাঝ দিয়ে ছিল চিকন সুপারি গাছের সারি। বাপ রে! ঝড়ের সময় গাছগুলো এমন করে বেঁকে যেত, মনে হত এখনি ভেঙে পড়বে। তবে সবচেয়ে বিরক্ত লাগত যখন ভাবি একটা লাঠিতে পুটলি বেঁধে আমাদের খাওয়ার জন্য নিমফল গুলো পাঠাত। রোজ সকালে সবাইকে এক গ্লাস করে নিমফল ভেজানো পানি দিত মা। বাপ রে! কি ভীষণ তেতো স্বাদ! এখনও মনে পড়লে গা গুলায়।
এসব ভাবতে ভাবতেই মাকে নিয়ে এসে পড়েছি গোলাপি বাড়িতে। এখনো তিনতলায় আছে বাড়িটা, আধুনিকতার তান্ডব এখনো আছড়ে পড়ে নি এখানে। মা অবশ্য বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলেই এসেছিল। বাড়িওয়ালা দিদা আবার মাকে খুব ভালবাসত। একসময় সাথী ছিল দুজনে। কলিং বেলটা বাজাতেই একটা ছোট ছেলে উঁকি মারল। এরপর লাঠিতে ভর দিয়ে বের হয়ে এল সেই দিদা। আমাকে আর মাকে দেখেই খুশিতে ডগমগ! আজকে নাকি পাকন পিঠা বানিয়েছে আমাদের খাওয়াবে বলে। আর তিন তলাটা ভাড়া নেই বেশ কিছুদিন হল,ফাঁকাই পড়ে আছে। সেখানেই থাকব আমি, মা আর সেই বাড়িওয়ালা দিদা। দুই সাথী স্মরণ করবে তাদের সংসারের ফাঁকে হারিয়ে যাওয়া সেই মেয়েবেলাগুলো।
গল্পের আসরে বসে কিভাবে যেন সময় গুলো পেরিয়ে গেল।সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে, হালকা কুয়াশা যেন তার গভীরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘুমাতে যাব, ঠিক সেই সময় দিদা হাত ধরে বলল, "কথায় কথায় অনেক বেলা গড়িয়েছে। বিয়েশাদি কি আর করা হয়েছে? "হালকা হেসে মাথা নেড়ে না বলে দিলাম।"
তাহলে কেমন আছে? "কিভাবে চলছে দিনকাল?" দিদা, একটা স্কুলে চাকরি নিয়েছিলাম। এখনো ওখানেই আছি।" "মনে পড়ে তার কথা?" বুঝিয়ে বলতে হয় না কার কথা আমায় জিজ্ঞেস করছে। "মনে করা এখনো উচিত?"
আমাকে শফিক ভালবেসেই বিয়ে করেছিল। বন্ধুত্ব থেকেই ভালোবাসা অতঃপর প্রণয়। বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া চুকিয়ে চাকরি করব বলে খুঁজছি। নিজ শহরেই থাকব বলে এখানেই চাকরি খুঁজছিলাম। কিন্তু ওই যে! পাড়ার মানুষের এক কথা --বিয়ে করছ কবে? তাই বাধ্য হয়েই ছেলে খুঁজতে নেমে পড়া। কোন এক রাতে শফিকের মেসেজ এল আমার ফোনে, "কাল একটু দেখা করা যায়? একটু সিরিয়াস কথা বলব?" আজ যতটা শান্ত তখন ঠিক ততটাই অশান্ত ছিলাম। কত হাসি-মজা করে উড়িয়ে দিলাম। তবে পরদিন ঠিকই দেখা করতে গেছিলাম। এখনো মনে আছে সে কাঁপা হাতে চায়ের কাপ ধরে বলেছিল, "তোর জামাইটা বাইরের কেউ না হয়ে নিজেদের মধ্যে হলে কেমন হয়?" একটু ভাবতে হয়েছিল আমাকে কথার অর্থ বুঝতে। শেষে যখন বুঝলাম তখন না ভেবেই বলেছিলাম, "বলে দেখ না আমার পরিবারে! যদি রাজি হয়ে যায়!"
পরিবার পর্যায়ে আলোচনা চলল। আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমি মালিনী থেকে মিসেস শফিক হয়ে গেলাম। বেশ ভালোই চলছিল আমাদের সংসার। শফিক ঢাকায় চলে গেল চাকরি পেয়ে। আর আমি নিজ শহরে বাবা-মায়ের ঘরেই থেকে গেলাম। চোখের পলকে যেন দুইটা বছর কেটে গেল। হঠাৎ একদিন শরীরে ব্যথাহীন ফোলা অংশ দেখে ডাক্তারের কাছে গেলাম পরীক্ষার জন্য। রিপোর্ট যেদিন আসল নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নাই। আমার শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। সুন্দর জগৎ হঠাৎ করেই অসুন্দর লাগতে শুরু হয়। বুকে সাহস আর চোখে আশা নিয়ে ফোন করেছিলাম শফিককে। সেদিন বিরামহীন একঘন্টার ফোনালাপে দীর্ঘশ্বাস আর থেমে থেমে কান্না ছাড়া কিছুই শোনা যায় নি।
কিছুদিন পর বাবা-মাকে জানালাম আমার ক্যান্সারের বিষয়টা। শফিকের বাড়ির লোকও জানল। ঠিক হল পরের মাসের শুরুতেই চিকিৎসা নিতে বিদেশ যাব। গেছিলামও। সাথে শফিক ছিল। দীর্ঘ দুইমাসের থেরাপি যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে আমায়। তবে ভাগ্য সহায় ছিল। ক্যান্সারের স্টেজ ছিল-১। একদম শুরুর দিক। আমার দেহের সে অংশটুকু কেটে ফেলে কেমোথেরাপি দেওয়া হবে। তাতেই সুস্থ হয়ে উঠব আমি। অপারেশন আর থেরাপির একমাস অতিবাহিত হয়েছে কেবল। শফিক দেশে গেল কিছু জিনিস নিয়ে আসতে। সেদিন কেন জানি খুব কেঁদেছিলাম ওকে জড়িয়ে ধরে। ওকে বলেছিলাম, "তুমি ফিরে এসো। তোমার অপেক্ষায় আমি থাকব। আমি যুদ্ধ জয় করেই ফিরতে চাই।"
একসপ্তাহ পার হয়ে গেল। ওপার থেকে কেউ খোঁজ নেয় না। বাবা-মা খুব অল্প কথায় শেষ করে আলাপ। জিজ্ঞেস করলে কথার প্যাঁচে হারিয়ে যাই আমি। ভাবলাম সপ্তাহ পার হল। নিশ্চয় ফিরে আসবে। কিন্তু অবাক করে দিয়ে আসল আমার বাবা। বাবাকে দেখেই আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল, "শফিকের কি হয়েছে বাবা?" বাবা শুধুই কাঁদে। বলে না কিছুই। শেষে তাও কিছু বলেছে। আর তাতে আমার বাঁচার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছিল। যার জন্য যুদ্ধ করে ফিরে আসা, সেই আর আমার হয়ে নেই। আসলে দেশে ফেরার পর ঢাকায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পায় শফিক। প্রথমে তেমন কিছু সমস্যাবোধ না করলেও সেই রাতেই শরীরে খিঁচুনি দেখা দেয়। জ্ঞানও হারিয়ে ফেলে সে। হাসপাতালে নিলে ডাক্তার জানায় মাথায় রক্তক্ষরণ তীব্র হয়েছিল। হয়তো তার স্মৃতিশক্তি চলেও যেতে পারে বা আজীবনের জন্য পঙ্গুও হতে পারে। সবাইকে অবাক করে সেই কথাটাই সত্যি হল। শফিক আর আমার শফিক হয়ে রইল না। এই ব্যথা আজও বুকে চাপা নিয়ে বেরাচ্ছি। সবাই জানে আমি মিসেস শফিক। কিন্তু আমি জানি আমি আসলে মালিনী ছাড়া কেউ নই।
কেমোথেরাপিতে আমার দেহের সব চুল ঝরে পড়ল। ব্লাডপ্রেসারটাও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ল। তবু শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক কষ্ট আমাকে ভেঙে ফেলল। ফিরে আসলাম দেশে। শফিককে আনা হয়েছিল আমাদের এই গোলাপি বাসার তিনতলায়। হয়তো কোন স্মৃতি জাগতে পারে। সব চেষ্টা ব্যর্থ হয় যখন আমায় দেখে তার মাথার যন্ত্রণা আরো বাড়তে শুরু করল। ডাক্তার আমায় তার সাথে মাঝে মাঝে দেখা করতে বলল।সেই থেকে শুরু। নিজের ভঙ্গুর শরীরকে মানুষের সামনে ঢেকে এগিয়ে চলা। আমাদের গোলাপি বাসায় এসে উঠল শফিকের পরিবার। এখানেই সে নাকি ভালো বোধ করছে। আমরা ছাড়লাম পাড়া। মাঝে মাঝে তাকে আমাদের ভার্সিটি জীবনের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতাম। কিন্তু আমি মালিনীই থেকে গেলাম। শফিকের জন্য ভারতের এক ডাক্তার বেশ ভালো হতে পারে--এই আশায় তার পরিবার গত মাসেই বাসাটা ছেড়ে দিয়ে ইন্ডিয়া গেল। শফিক তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাই তার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকবে তার পরিবার। সেটা ছয়মাসও হতে পারে আবার একবছরও হতে পারে।
এত লম্বা কাহিনী আমার ভাবতে পাঁচ-দশ মিনিট সময় লেগেছে। এই সময় জিনিসটা বড়ই অদ্ভুত!সে যেমন কষ্ট দিতে জানে তেমনি আবার লাঘব করতেও জানে। সেই বাড়িওয়ালা দিদা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ঝুল লেগে থাকা ঘরের একটা কোণে। হয়তো টেবিলের পেছনে ঢাকা ছিল সে জায়গা। সেখানে বাচ্চাদের মত করে একটা শব্দ বারংবার লেখা--তা হল "মালিনী"। আটকাতে পারলাম না আর নিজেকে। শব্দ করে কেঁদে ফেললাম। একটা আচমকা বাতাস আমার মাথায় জড়িয়ে ধরা ওড়নার আবরণ ফেলে দিল। একসময়ের সুকেশিনী মালিনী আজ কেশহীন মিসেস শফিক হওয়ার পরিচয়কে খুঁজে ফিরছি।
পরিচয়_মালিনী নাকি মিসেস শফিক || মুহাঃ তাসদীকুল হক
জন্ম ২০০২ সালে পদ্মা নদীর পাড়ে রেশমের জন্য খ্যাত রাজশাহী নগরীতে। স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে তিনি এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত। তিনি বর্তমানে লেখালেখির কাজের সাথে জড়িত।