প্রেম
এক
ডিসেম্বর মাস। শীতের সকাল, বেশ শীত পড়েছে, সকাল থেকে অনেক রোগী দেখছি। এতো ভীড়--- বর্হিবিভাগে আমি আর রিমি রোগী দেখছি। দুজনে এতো রোগীর চাপ সামলানো মুশকিল হয়ে যায়। সকালের দিকটাতেই রোগীর চাপ বেশি থাকে। নয়টা থেকে শুরু করি---- এগারোটার দিকে একটু ব্রেক নেই, হালকা নাস্তা করে আবার টানা একটা পর্যন্ত রোগী দেখি। আমি নাস্তা সেরে তড়িঘড়ি করে হসপিতালের সামনে লাগানো ফুল গাছ গুলোতে পানি দেই। গাছ আমার একমাত্র ভালোবাসা---- এতো প্রিয় গাছ গুলো।
দুই
আমি মিতু। গাইনোকলজিস্ট। এম.বি.এস. শেষ করে একটা মফস্বলের সরকরি হসপিতালে জয়েন করেছি। আমি সবসময় হাসি খুশি থাকি--- আমার মধ্যে প্রচন্ড ছেলে মানুষি--- কলিগদের সাথে হাসি মুখে কথা বলি, আড্ডা দেই। আজও রোগী দেখার ফাকে নাস্তা সেরে নতুন লাগানো ফুল গাছ গুলোতে পানি দিচ্ছি। এখানকার সবাই চিনে আমাকে। সবাই সম্মান করে। ফার্মাসিটিকেল কোম্পানির রিপ্রেজনটিপরা সালাম দিয়ে রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ায়। সেদিন একটু রোগী কম ছিলো। গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিলাম--খেয়াল করলাম একটা সাতাশ আটাশ বছর বয়সী ছেলে আমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। ছেলাটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে রিপ্রেজেনটেটিভ। একে তো কখনো দেখি নি। নতুন মনে হয়। চোখ দুটো কেমন বড় বড় মায়াকাড়া। আমি কেটলিতে করে পানি নিয়ে যাচ্ছি ছেলেটা কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। আমি একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। এই ছেলের চোখ মায়াময়। কিন্তু ছেলেটা শিউর আমাকে চেনে না। আমাকে দেখে বোঝার উপায় নেই আমি ডাক্তার।
তিন
আচ্ছা এতো সুন্দর মায়া কাড়া একটা মেয়ে হেলেদুলে এসে এই এগারোটার সময় গাছে পানি দিচ্ছে কে এই মেয়ে। কুয়াশা কাটিয়ে সবে রোদ উঁকি দিয়েছে, গাছে পানি দিচ্ছে মেয়েটি নিশ্চয় কোন ডাক্তার না, মালি হবে, হয়ত বা। মেয়েটা এতো সুন্দর -- আমি প্রেমে পড়ে গেলাম এক দেখাতেই। আমি কায়দা করে মেয়েটার পাশ দিয়ে গেলাম। মেয়েটা আমার দিকে হালকা তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো--- আমার বলতে ইচ্ছে করল, আপনি এতো সুন্দর কেনো?
চার
দুপুর সাড়ে বারটা । আমি কলিগের সাথে বসে আছি। হুট করে সেই মেয়েটা সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। কলিগ দাড়িয়ে মেয়েটাকে সালাম দিলো। সিনিয়ার কলিগ যেহেতু দাঁড়িয়েছে আমিও দাঁড়িয়ে পড়েছি। কলিগ বলল, ম্যাম কেমন আছেন? আমি তো থ। এই মেয়ে মালি নয়, ডাক্তার। সর্বনাস, আমার চোখ দেখেই ম্যাম বুঝে ফেলছে পুরো বিষয়টা। ঘন্টাখানেক আগে আমি ম্যামের সাথে কি করেছি। ম্যাম আমার দিকে তাকালো। কলিগ বলল, ম্যাম, আমার নতুন কলিগ, আজই জয়েন করেছে। আমার মাথা ঘুরতেছে---- এইটা আমি কি করেছি। ম্যাম হেসে আমার দিকে তাকিয়ে, আচ্ছা বলেই চলে গেল।
পাঁচ
আমি সত্যিই প্রেমে পড়েছি। আমি ম্যামের প্রেমে পড়ি নাই, প্রেমে পড়েছিলাম ঐ মালীর। তবুও আমি রোজ গিয়ে বসে থাকতাম হাসপাতালের সামনে । শীতের সকালে ম্যাম কখনো চাদর জড়িয়ে, কখনো লাল, নীল, হলুদ সোয়েটার পড়ে গাছে পানি দিতো, আমি তাই দেখতাম অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে। আমি লবিতে হাঁটতে হাঁটতে অহেতুক ম্যামের চেম্বারে গিয়ে দাঁড়াতাম প্রায়ই। ম্যাম আমার দিকে একবার তাকালেই চলে আসতাম। ম্যাম যখন তার অন্যান্য কলিগ মেয়ে ডাক্তারদের সাথে আমার সামনে দিয়ে যেতো-অন্য রকম হয়ে যেতো। নিশ্চুপ--- গম্ভীর মুখের ম্যাম হাসি, খুশি চঞ্চল হয়ে যেতো। জোড়ে জোড়ে হেসে কথা বলত। আড় চোখে খুব সূক্ষ্ম ভাবে আমার দিকে তাকাতো। আমি ম্যামের প্রেমে পাগলের মতো হয়ে গেলাম। কিন্তু কোনভাবেই মুখে কিছু বলা হলো না।
ছয়
প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমার স্বর্গ। কারন এই সময় টাতে ম্যামের সাথে আমার দেখা হয়। ম্যামের চেম্বারে গিয়ে অহেতুক উকি মেরে আসি, ম্যাম গাছে পানি দিতে আসলে একটু দূর থেকে ম্যামকে দেখি। কখনো সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করি -- কেমন আছেন ম্যাম?
ম্যাম, হাসিমুখে উত্তর দেয়, হুম ভালো, আপনি কেমন আছেন?
জ্বি ম্যাম ভালো।
ম্যাম আপনার গোলাপ ফুলের গাছ গুলো অনেক সুন্দর হয়েছে।
ম্যাম বলে, হবে না কেন-- দেখেন না, রোজ রোজ কত যত্ন করি।
সাত
গত সাত দিন ধরে গাছে পানি দেই, কিন্তু সেই ছেলেটাকে আর দেখি না। আমার মন থেকে কেন জানি হাসি মিলিয়ে গেছে। আমি কখন যে ছেলেটার কথার আর চোখের প্রেমে পড়ে গেছি তা বলতে পারব না। হয়ত প্রথমদিনই--- ছেলেটা যখন তার মায়াকাড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো তখই তার প্রেমে পড়েছি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। সাতদিন হয়--- কেউ আর অহেতুক এসে উঁকি মারে না আমার চেম্বারে। কেউ আর তাকায় না ঐ ভাবে। আমার গাছ গুলোর খোঁজও নেয় না। আমার কেন জানি ভেতরে ভেতরে কান্না পেতে লাগল। আমি কেনো এই ছেলের প্রেমে পড়লাম। অবশেষে ছেলেটার কলিগ তুষার ভাই ভিজিট করতে আসলে বলেই বসলাম, আচ্ছা আপনার কলিগটাকে তো দেখি না।
তুষার ভাই বিনয়ের সাথে বলল, ম্যাম, রেহান ভাইয়ের তো নতুন একটা জব হয়েছে, উনি তো জব রিজাইন দিয়ে চলে গেছেন। এই কথা শুনে আমার বুকের ভেতর ধক্ করে উঠল।
তুষার ভাই বের হতেই আমি আর কাউকে ভিজিট দিলাম না। চেম্বারের দরজা বন্ধ করে, চুপচাপ থাকলাম। চোখের জল মুছতে মুছতে মনে মনে ভাবলাম, একবার অন্তত বলে যেতে পারত। চোখের ভাষা তো কখনো মিথ্যা হয় না।
আট
রোগী দেখে এগারোটার দিকে চুপচাপ নাস্তা করছি। এমন সময় দারোয়ান আমজাদ এসে বলল, ম্যাম আপনার নামে পার্সেল এসেছে। বাইরে এসে দেখেন কি--!
আমি মনে মনে আশ্চর্য হলাম---- কে আবার পার্সেল পাঠাবে। আর কি এমন পার্সেল যে আমাকে বাইরে গিয়ে দেখতে হবে। দ্রুত খাবার রেখেই বাইরে বের হয়ে অবাক। এতো অবাক আর খুশি কখনো আমি হই নি। দুই ভ্যান শুধু হরেক রকম ফুলের গাছ। আমি খুশিতে হতবাক। এতো ভালো কে আমাকে বোঝে। কে জানে এতোটা আমাকে। গাছ আমার কত প্রিয়। আমি ভ্যানওয়ালাকে বললাম, কে পাঠিয়েছে এগুলো---- ভ্যানওয়ালা একটা খাম আমার হাতে ধরিয়ে দিলো---- খাম ছিড়তেই বেরিয়ে এলো চিঠি------ এই আধুনিক যুগে চিঠি----- আমি পুরো ইমোশনাল হয়ে গেলাম। চিঠিতে চোখ বোলাতে বোলাতে আরো আবেগী হয়ে পড়লাম। চোখের কোণে জল চলে আসল----চিঠিতে লেখা-প্রিয়, ম্যাম, " কেমন আছেন? আশা করি ভালো আছেন। জানেন তো ম্যাম, আমি একদম ভালো নেই। যে মানুষটা সব সময় আপনার আগে পিছে ঘুর ঘুর করত সেই আমি আজকে দূরে। বিশ্বাস করেন, প্রতিটা সময় আপনার কথা মনে পড়ে। আসলে আপনাকে প্রথম দেখাতেই আমি আপনার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। ফুল গাছ গুলোর মাঝে মনে হচ্ছিল আপনি একটা ফুলপরী। কুয়াশা ভেদ করে আলো যেমন উঁকি মারে, তমনি আমার মনের আকাশের কুয়াশা ভেদ করে আপনি উঁকি দিয়েছেন আলোর মতো করে আমার জীবনে। বার মনে হচ্ছিল --- এতো সুন্দর একটা মানুষ হয় কি করে। আপনি এতো সুন্দর কেনো ম্যাম। আসলে আমি ভেবেছিলাম আপনি মালি পরে দেখি বড় একজন ডাক্তার । আর এখানেই হলো সমস্যা ---- আমি আপনাকে কোনভাবেই বলতে পারছিলাম না ---- আপনাকে আমার অনেক ভালো লাগে। আপনাকে আমি ভালোবাসি ম্যাম।তখনই ডিশিসান নেই --এই জব ছেড়ে নতুন জব যখন নিবো, তখন বলব আপনাকে ভালোবাসার কথা। এই জব আমার এমনিতেই ভালো লাগে না। অনেক জবের এপ্লাই করাই ছিলো---- হয়েও গেলো একটা জব---- ম্যাম, এই যে ম্যাম---- শুনছেন---আপনাকে অনেক অনেক মিস করি । আপনাকে না দেখতে পেয়ে অনেক কষ্ট হয় আমার। আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি। আপনার প্রিয় গাছ গুলোর মতো আমাকে একটু ভালোবাসবেন, ম্যাম?"
আমার চোখে জল এসে গেলো। কোন রকমে সামলিয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে গাছ গুলোতে হাত বোলাতে লাগলাম------
কল্পনায় দেখলাম--- দুটো মায়াময় চোখ আমার দিকে পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম ভালোবাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে।
প্রেম || লেখক: রমজান
তিনি একজন গল্পকার। জীবনযুদ্ধে কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময়ে যতটুকু সময় পান তার মধ্যে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি ছোটগল্প থেকে শুরু করে কবিতাও তিনি রচনা করেন। তার লেখা গল্পগুলো সর্বদাই আমাদের মনোমুগ্ধ করে তোলে।