শুধু গরিব বলেই
আর দশটা স্বাভাবিক জুমার দিনের মতই আজও গেছিলাম নামায পড়তে। জুমার নামায বলে কথা।গোসল করে একদম ধোয়া কড়কড়ে সাদা পাঞ্জাবি। আসলে বাবাই আমাদের এই জিনিসটা শিখিয়েছেন।শুক্রবার দিনে গোসল করে চুল আঁচড়িয়ে আতর মেখে একদম পরিপাটি হয়ে জুমার নামাযে যেতে হবে।
তবে আজকের দিনটা বিশেষ ছিল।কারণ বাবা আমার সাথে আজ মসজিদে গিয়ে নামায পড়বে।ভয়ের কারণ নেই!বাবাও নামায পড়ে।তবে বাবার কাজের জায়গায়।অনেকেই জিজ্ঞেস করে,"কি কাজ করে রে?"অনেকেই লজ্জা পেতে পারে।কিন্তু আমার কেন জানি ঠিক লজ্জা লাগে না। বেশ বুক ফুলিয়েই বলি,"আব্বা জুতা সেলাই করে। ছেলে মেয়ে সকল বয়সের মানুষের। আমাদের গ্রামের বাজারে একটা ছোট দোকান আছে।সেখানেই সেলাই করে।হয়তো বড় বড় দোকানের ব্রান্ডের মত ওত চকচকে হয় না।কিন্তু বেশ মজবুত হয়।আমাদের গ্রামে আব্বার জুতার অনেক নাম।তবে আজকাল মানুষজন শহরের বড়বড় দোকান থেকে জুতা কিনে আনে দেখে আব্বার জুতার কদর কিছুটা কমে গেছে।কিন্তু আজ থেকে দশ বছর আগেও আমাদের গ্রামে ভালো জুতা একমাত্র আব্বার দোকানেই পাওয়া যেত।"
আজকে আব্বাকে নিয়ে আগে ভাগেই নামাযে গিয়ে বসলাম।একদম সামনের সারির দিকে।খুতবা শুনে নামায শেষে বের হলাম।নিজের পায়ের স্যান্ডেলটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।তাই এদিক সেদিক দেখছিলাম।হঠাৎ দেখি খুব জটলা হচ্ছে।মনে হচ্ছে কাকে যেন মারছে।ঠিক বুঝলাম না।নিজের স্যান্ডেলটা পেয়ে গেলাম।পাশে ফিরে দেখি বাবা নেই। এইটাই সুযোগ। এক দৌড়ে জটলা দেখতে গেলাম।
কিন্তু গিয়ে যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। দেখলাম বাবার কানটা কে যেন বেশ শক্ত করে ধরে আছে।আর বাবা মাটিতে ধুলার মধ্যে বসে অনেক অনুনয় করে কি যেন বোঝানোর চেষ্টা করছে।মাথাটা ঠিক কাজ করছিল না কিছু সময়ের জন্য।"আচ্ছা,আমি কি ঠিক দেখছি?নাকি স্বপ্ন।হয়তো ঘুম ভেঙ্গে দেখব স্বপ্ন দেখছি।তারপর একটা সস্তির নিশ্বাস ফেলব। ভাবতে ভাবতেইআমার পাশের লোকটা আমার বাবার নাম ধরে ডাকল। তখন বুঝেই নিলাম এটা স্বপ্ন নয়,বাস্তব।কিন্তু কি হয়েছে?
যে লোকটা বেশ তেজ দেখিয়ে বাবার কানটা ধরে রেখেছে সে বোধহয় শহরের খুব উঁচুদরের একজন মানুষ।তার জুতা জোড়া মসজিদে এসে হারিয়ে গেছে।তাই সে বাবাকে ধরেছে।কারণ তার ধারণা যে বাবাই শহুরে জুতা দেখে সেটা চুরি করেছে।আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয়,বাবার পাশে দাড়িয়ে থাকা লোকগুলো একটা কথাও বলছে না।কেউবা আবার মিটিমিটি হাসছে।মনে হচ্ছে বিনা টিকিটে বেশ ভালোই একটা যাত্রা দেখা হচ্ছে তাদের। চেনার আবরণে অচেনা মানুষগুলোকে দেখে আমার ছোট্ট হৃদয় সত্যি আজকে কষ্ট পেয়েছে।
ধীরে ধীরে আমার মাথাটা গরম হয়ে উঠছে।বুঝছি শরীরের রক্ত এখন টগবগ করে ফুলে উঠছে।যে কোন সময় তীব্র শব্দে ফেটে পড়বে। এতক্ষণ ধরে লোকটা বাবার কান ধরে রেখেছে।অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না।হতে পারি আমি ছোট! কিন্তু এত ছোট তো নয় যে, বাবাকে মার খেতে দেখব!তোলপাড় করা একটা অনুভূতি। একটু এগোতেই পেছন থেকে রবি কাকা আমার জামা ধরে টান দিয়ে বলল,"সামনে যাস না।লোকটা সুবিধার লাগছে না।"
তাও বাবা তো।সমস্ত শক্তি দিয়ে বেশ জোর দিয়েই বললাম,"যা দেখেন নি,তা অন্যের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন কেন?"লোকটা শুনতে পেয়ে বেশ ঘাবড়েই গেল।বলল,"কে রে?কার এত বড় সাহস! আমার মুখের উপর কথা বলে!" আশপাশের নীরব লোকগুলোও দেখছি কানাঘুষা শুরু করেছে নিজেদের মধ্যে।হঠাৎ করেই লোকটা ধমকে উঠে,"চুপ।সবাই একদম চুপ।ওয়েল ইউর অন বিজনেস।" সবাই চুপ মেরে গেল।এর মাঝে এক লোক চিৎকার করে বলল,"সাহেব পাওয়া গেছে,পাওয়া গেছে।"কি আজব ব্যাপার!বলার সাথে সাথেই পাওয়া গেল।সবাই ঘুরে তাকায়। বেশ পরিপাটি শহুরে কোন বাচ্চা ছেলের পায়ে দেখলাম বেশ বড় একটা সুন্দর জুতা।ছেলেটা আদুরে স্বরে বলছে,"বাবা আমি তোমার জুতাটা পড়ে একটু ওদিক ঘুরতে গেছিলাম।"
বাবাকে নিয়ে আমি চলে আসছিলাম।বাবাকে দেখে মনে হচ্ছিল বাবার বয়স একশ বছর বেড়ে গেছে।বয়সের ভাড়ে দাঁড়াতেই পারছে না।খালি চোখের ইশারায় বোঝায় দিল যেন মাকে না বলি।বেশ অভিমান করে বাবাকে বললাম,"কেন জোর দিয়ে বলতে পারলে না বাবা, যে তুমি চোর নও!তুমি চুরি কর নি!"আবার থেমে রাগে গরগর করে বললাম,"ওরা শেষে কিন্তু ক্ষমাও চায় নি বাবা।"বাবা হালকা হেসে বলল,"আরে গরিব মানুষের আবার সম্মান আছে নাকি রে পাগল?তারা তো শুধু চোর-বাটপার।তারা তো মানুষ হতে পারে না রে বোকা।এগুলা জনমের পর জনম চলে আসছে।তাই এখন দেখলে কিছু মনে হয় না আমার কাছে। তুই ছোট মানুষ,তাই তোর কাছে খারাপ লেগেছে বোধহয়।"বাবার মুখে তখনও হাসি মাখা।"শুধু গরিব বলেই কি বাবা তোমাকে".......আমি আর কথা শেষ করতে পারি নি।ভেজা চোখ অপূর্ণ কথাটা বুঝিয়ে দেয়।
শুধু গরিব বলেই || Md.Tasdiqul Haque
Md.Tasdiqul Haque loves to write short fiction!