মানুষ
স্নাতকে ভর্তি হওয়ার পরপরই একটা হিন্দু মেয়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠার ব্যাপারটা আমার আরেক নতুন বন্ধু হাবিবের চোখ এড়ায়নি। হাবিবের সাথে আমার বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা দিনকে দিন বাড়তেই থাকে। একটা সময় আমরা একে অপরের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অবলীলায় আলোচনা করতে থাকি কোনোরকম দ্বিধাবোধ ছাড়াই। এই আস্পর্ধা থেকেই হোস্টেলে একদিন সে আমাকে বলে বসলো, "বন্ধু, হিন্দু মেয়েদের সাথে প্রেম করার মজাই কিন্তু অন্যরকম।"
আমি উৎসুক চাহনিতে বললাম, "সেটা কেমন?"
হাবিব উত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল। আমি ফের জিজ্ঞেস করতেই সে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকালো। তার আড়চোখের তীর্যক ভঙ্গিমা আমি সইতে পারলাম না। খপ করে ধরে ফেললাম ওর হাত।
শুরু করলাম___
স্কুল ক্যাম্পাসের দ্বিতীয় তলায় আমাদের ক্লাসরুম। আমি তখন সবে ক্লাস সেভেন-এ উঠেছি। সকালে পিটি শেষ করে উৎফুল্ল সহপাঠীরা হই হুল্লোড় করে সিঁড়ি বেয়ে নিচ তলা থেকে উপরে উঠছে। সিঁড়িঘর থেকে উঠলে বাঁয়ে প্রথমেই আমাদের ক্লাসরুম। আমি ক্লাসরুমের সামনে রেলিং ধরে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি একা, চুপচাপ। এমন সময় হঠাৎ আমার মাথার মধ্যে একটা চক্কর দিয়ে উঠলো। মনে হলো আমি পড়ে যাচ্ছি। কাত হয়ে এলো শরীর। চোখ দিয়ে যা দেখা যায় সবই ঝাপসা। নিজেকে খানিকটা সামলে নিতেই দেখলাম সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকা আমার সহপাঠীরা একে অপরের শরীরের উপর হুড়মুড়িয়ে পড়ছে। স্কুলের সামনে মাঠ থেকে শিক্ষকরা চিৎকার করে অবিরত সবাইকে যার যার স্থানে শান্ত ও চুপচাপ থাকার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! দৌড়াদৌড়ি, দাপাদাপি দ্বিগুণভাবে বেড়ে গেল। আমার শরীরের উপর এসে হুমড়ে পড়লো একটা মেয়ে। মেয়েটাকে আমি চিনি। আমার সহপাঠিনী কপালকুণ্ডলা।
নামটা শুনেই একটু নড়েচড়ে বসলো হাবিব। ভ্রু উঁচিয়ে বলল, "কিহ, এ তো বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের চরিত্র!" ব্যাপারটা আসলে উপন্যাসের না, বরং হিন্দু মেয়ের প্রসঙ্গ থেকে সরে আমার স্কুল জীবনের ঘটনা অপ্রাসঙ্গিক ভেবে এতক্ষণ সে একটু অমনোযোগী ছিল। ফের নারী চরিত্র আলোচনায় আসায় বেচারা আগ্রহের সাথে শুধাল, "তারপর কী হলো বন্ধু?"
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলো। সবাই যার যার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াল। উঠলো না কেবল কপাালকুণ্ডলা। আমার হাঁটুর উপর উবু হয়ে নিস্তেজ পড়ে আছে মেয়েটি। বাঁধন খুলে যাওয়ায় তার এলোকেশের আলতো পরশে ঢেকে যাচ্ছিল আমার চোখমুখ। সবাই দেখে ফেললে কী হবে এই ভয়ে আমি উত্তেজনায় থরথর কাঁপছি। এমন সময় দুজন বান্ধবী ছুটে এলো আমার কাছে। কপালকুণ্ডলাকে টেনে তুলল তারা। কিন্তু সে অজ্ঞান। যতক্ষণে তার জ্ঞান ফিরলো ততক্ষণে শিক্ষকদেরকে চারপাশে গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেছে ছাত্রছাত্রীরা।
ভূমিকম্পে প্রায় চার ইঞ্চি পরিমাণ নিচে ডেবে গেছে স্কুল বিল্ডিং। সবাই এই বিষয়টা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
সেদিন দ্রুতই স্কুল ছুটি হয়ে গেল। কপালকুণ্ডলাকে আমি সেদিন আর দেখতে পাইনি। কিন্তু সেদিন থেকে যেকোনো জায়গায়, যেকোনো কাজে, যেকোনো সময় তাকে দেখতাম। তার সেই চুলের গন্ধ আমাকে তার দিকে টানতো প্রতিনিয়ত। কিন্তু খুব বেশিদিন মানুষটার আশপাশ ঘুরে চুলের গন্ধ নেওয়া কিংবা চোখে চোখ রাখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। অষ্টম শ্রেণিতে পরীক্ষা দিয়েই মেয়েটি আমাদের সবাইকে ছেড়ে অন্য একটা স্কুলে চলে গিয়েছিল। কেন গিয়েছিল তা আর খোঁজ নেওয়া হয়নি।
মেয়েটির হঠাৎ প্রস্থানে আমার বুকের ভেতরটা আক্রোশে ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমার কান্না দেখে বন্ধুরা বলেছিল, "তুই প্রেমে পড়েছিস কিন্তু আমাদের জানাস নাই।"
কারোর চুলের পরশ কিংবা চোখের চাহনির প্রতি মারাত্মকভাবে আসক্ত হওয়াকে যদি প্রেম বলা যায় তাহলে বলব, আমি সহস্র বার কপালকুণ্ডলার প্রেমে পড়েছিলাম। কিন্তু সমস্যা ছিল, কপালকুণ্ডলা তো হিন্দু আর আমি মুসলমান। প্রেমের সম্পর্ক যদিও বা গড়ে উঠতে পারে কিন্তু বিয়ে? অসম্ভব! তাতে আবার আমার বাবা-মা তথাপি পরিবার কট্টর মুসলমান। তারা ধর্মের জায়গায় ভীষণ স্পর্শকাতর, অনড়। হিন্দুরা যে পাত্রে খায় আমাদের সে পাত্রে খাওয়াও নিষেধ। এমনকি হিন্দুদের হাতে তৈরি খাবারও খাওয়ার ব্যাপারে আমাদের পরিবারে বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু একদিন সব ব্যবধান ঘুচে গেল।
হাবিব আরও মনোযোগী হলো। হাতে থাকা ফোনটা চার্জে বসিয়ে চেয়ারটা আরও এগিয়ে নিয়ে আসলো আমার টেবিলের দিকে। কৌতুহলী চোখে বলল, "সে কী বন্ধু! কীভাবে হলো?" আমি তার চোখ থেকে চোখ নামিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে আবার শুরু করলাম।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গ্রামের বাজারে বাবা আমাকেই পাঠাতেন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনাকাটা করতে। এরকম একটা ছুটির দিনে সকাল থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি। বাজারে যাওয়ার সময় থলিতে কিছু খেজুর দিয়ে দিলেন মা। বললেন, "বর্ষায় ভ্যান তো পাবি না বাবা, হেঁটে যেতে হবে এই পথ। খেজুর খেতে খেতে যা।"
ছাতা মাথায় বাজারে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই বেড়ে গেল বৃষ্টির গতি। মুষলধারায় বৃষ্টি। ছাতা নিয়েও এই বৃষ্টি থেকে নিজেকে সামলানো অসম্ভব। তাই একটা ছোট করিডরে এসে দাঁড়াতে হলো। আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাশে এসে দাঁড়ালেন আরেকটি পুরুষ। উচ্চতা আমার চেয়ে কম হলেও বয়সে তিনি বাবার সমতুল্যই হবেন। তিনি আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, "তোমার নাম কী বাবা?" মুখ থেকে খেজুরের আঁটি ফেলে জবাব দিলাম, "রহমত গাজী"। এরপর আমি কী খাচ্ছি সেটা তিনি জানতে চাইলেন। থলে থেকে চার পাঁচটা খেজুর বের করে ব্যক্তিটির দিকে এগিয়ে দিলাম। তিনি বিনা সঙ্কোচে সেগুলো নিলেন। খাওয়া শুরু করলেন এবং খেজুরের গুণাগুণ নিয়ে প্রশংসা করতেও ভুললেন না।
ব্যাপারটা এখানেই চুকে যাবে ভেবেছিলাম। কিন্তু না। এই বাজারেই বর্ষাহীন অন্য একটা দিনে তিনি আমার হাত ধরে একদিন মিনতির স্বরে বললেন, "আমার সাথে একটু যেতে হয় যে বাপ!"
আমার বয়স তখন বারো কি তেরো হবে। লোকটার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। বাজারের সবচেয়ে বড় হোটেলে আমাকে ঢুকানো হলো। আমি থেমে গেলাম। তিনি পিছনে এসে আবার আমাকে ডাকলেন, "বাবা আরেকটু পথ"।
হোটেলে পাতানো টেবিলগুলোতে হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমি পৌঁছে গেলাম একেবারে শেষ সীমায় অবস্থিত ছোট একটা ঘরে। এখানে বেশ কয়েকটা উনুন, বড় বড় হাঁড়ি পাতিল এবং অন্যান্য রন্ধন সামগ্রী দেখতে পেলাম। বেশ কয়েকজন পাচিকাও রয়েছেন। লোকটি আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর হাঁড়ি থেকে গরম জিলাপি হাতে তুলে দিয়ে বললেন, "খাও"।
নিজের বসার টুল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, "বসো"। তারপর তিনি নিজের কাজে মন দিলেন। উনুন দিয়ে তখনও ধোঁয়া উড়ছে পুরোদমে। তপ্ত এই ঘরটিতে সামান্য বাতাস প্রবেশের কোনো রাস্তাও যেন নেই। গরমে একেবারে সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। লোকটা খুব বেশি কথা বলে না। কিন্তু কাজে বেশ পটু। আমার সাথে কথা বলতে যে তার একটু কষ্টই হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারলাম। তিনি বললেন, "তোমার যদি কাজ থাকে তবে আজ যাও, তবে রোজ এসো কিন্তু।"
সেই থেকে আমি প্রায়ই এই ময়রার কাছে যেতাম। না, মিষ্টির লোভে নয় বরং একটা টান থেকেই যেতাম। 'অকারণে' বলা যেতে পারে। ধীরে ধীরে তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি তাকে কাকা বলেই সম্বোধন করি। জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া নানাবিধ ঘটনা তার সাথে আমি আলোচনা করি। তিনি শুধু শোনেন এবং যে শব্দটা উচ্চারণ না করলে আমি থেমে যাই তিনি শুধু সেই শব্দটাই উচ্চারণ করেন। এভাবেই তার আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ও দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকে।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরপরই বাবার আদেশে আমাকে যেতে হলো শহরে। কোচিং করার জন্য থাকতে হলো মামার বাড়িতে। মাস তিনেক পরে ফিরে এসে আবার সেই ময়রার সাথে দেখা। আমাকে জড়িয়ে ধরে তিনি কেঁদেই ফেললেন,
"কোথায় গেছিলি বাবা? তোকে কতই না খুঁজিছি আমি!"
লোকটা এই প্রথমবার আমাকে "তুই" সম্বোধন করলো। মনে হলো আমার নিজের বাবার সাথে কথা বলছি আমি। বললাম, "এই তো এসেছি আমি কাকা।"
"আহ রহমত, কাকা নয়, বাবা বলবি।"
আমি আর কিছু বললাম না। কিন্তু তিনি থামলেন না।
"আজ তোকে আমার সাথে একটু আমাদের বাড়িতে যেতে হবে বাপ।"
এমন পরম স্নেহের পর আমি আর 'না' করতে পারলাম না।
বাজার থেকে ক্রোশ খানিকের পথ। বাড়িটা ভীষণ নিরিবিলি এলাকায়। ঘরে ডেকে তিনি আমাকে বসতে দিলেন। তার স্ত্রী যখন আমার জন্য পাত্রে খাবার নিয়ে উপস্থিত হলো তখনই আমি চমকে উঠলাম। একি! বালা? বালা তো হিন্দুরা পরে। ময়রা বাবা কি তাহলে হিন্দু? পরিবার আর ধর্মের কথা ভাবতে গিয়ে ক্ষণিক সময়ের জন্য আমি একেবারে চুপসে গেলাম। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে চুপচাপ বসে রইলাম। তারপর 'কাকা' তার মাটির ঘরে টানানো ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবি নামিয়ে এনে আমার পাশে এসে বসলেন।
তারপর বললেন,
"আমার নাম গোপাল দেবনাথ। আমি একজন ময়রা। আমার সন্তান বলতে কেবল একটাই মেয়ে ছিল..."
গোপাল দেবনাথের চোখ, কণ্ঠনালী সবকিছু ভরে এলো জলে। তার স্ত্রী আঁচলে মুখ চেপে উঠে দৌঁড়ে চলে গেল বাড়ির বাইরে। আমি গোপাল কাকার বাহুডোরে আলতো স্পর্শ দিয়ে বললাম, "মেয়ে ছিল মানে? এখন নেই? কী হয়েছিল তার?"
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ময়রা কাকা জবাব দিলেন, "ব্লাড ক্যান্সার"। তারপর সে কী কান্না! গগনবিদারী চিৎকার। আমি তাকে থামানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছি অথচ ক্ষণিক বাদেই দেখলাম আমার নিজের চোখগুলো ভিজে একেবারে জবজবে। গোপাল কাকা বললেন, "তুমি আমার ছেলে হবে?" আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, "আমি তো আপনার ছেলে হয়েই আছি।" গোপাল বাবা চোখ মুছলেন। আমি তার মুখে জলের গ্লাসটা ধরলাম। ঢকঢক করে পানি পান করলেন তিনি। গোপাল বাবার স্ত্রী তথাপি মা'কে হাত ধরে ঘরে এনে বসিয়ে দিলাম। আমাকে দেওয়া খাবার সবাই ভাগাভাগি করে খেলাম। গোপাল বাবার কাছ থেকে ফটোটা নেওয়ার পরই ঘটলো আসল ঘটনা।
"কী ঘটনা?" হাবিব মুখে কৃত্রিম হাসি নিয়ে এবার জিজ্ঞেস করলো।
ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা আর কেউ-ই নয় বরং আমারই স্কুল জীবনের সহপাঠিনী কপালকুণ্ডলা!
হাবিব আমার সাথে দ্বিতীয় আর কোনো কথা বলল না। চোখ মুছতে মুছতে মলিন মুখ নিয়ে রুম থেকে দ্রুত বাইরে চলে গেল।
মানুষ || মুতাছিম নয়ন
মুতাছিম নয়ন সরকারি পি, সি, কলেজে (বাগেরহাট) বাংলা বিভাগে অধ্যায়নরত একজন ছাত্র। তিনি লিখতে এবং বই পড়তে পছন্দ করেন। তার বাড়ি খুলনা জেলার পাইকগাছা থানার চাঁদখালী ইউনিয়নের একটি গ্রামে।