আগুনের দিন

  • লেখিকাঃ জান্নাতুল তাবাসসুম মীম
  • Category: Short Story
  • Published on: Sunday, May 22, 2022

আছরের শেষ রাকাতের সালাম ফিরিয়েই ভূমি দেখতে পায় তার বাবা মোঃ আব্দুস সালাম দরজায় দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে উপরে তাকিয়ে আছে।বাবাকে এরকম দেখতে পেয়ে মোনাজাত না করেই জায়নামাজ টা হাতে নিয়ে ভূমিকা দাঁড়িয়ে পড়ে। বাবার কাছে সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,"বাবা কিছু বলবে?"


তিনি ভূমির দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেদে উঠে,"তোর মা যে আর বেঁচে নাই রে মা" 


ভূমি এক চিৎকার দিয়ে উঠে,"আল্লাহ গো,আল্লাহ তোমার এই দুনিয়ায় ভালো মানুষ গুলোরে কেন নিয়ে যাও এত তাড়াতাড়ি, ও আল্লাহ"


ভূমি  উঠানের শুয়ে গড়াগড়ি করতে থাকে। দুচোখ খোলা অবস্থাতেও দেখতে পায় তার সামনের জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন।কাঁদতে কাঁদতেই হঠাৎ জ্ঞান হারায় সে।


ভূমির মা হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান।ভূমি জীবনে যতজন সাহসী মহিলা দেখেছে তার মধ্যে তার মা একজন।বুকে ব্যথা হওয়ার পর নিজেই হাসপাতালে রওনা হয়।যাওয়ার আগে ভূমি কে দোকানের দায়িত্ব দিয়ে যান।


ভূমির আর কিছুই মনে নেই। তার জ্ঞান ফিরে  কোরআন তিলাওয়াত এর সুমধুর আওয়াজ শুনে।।পাশের বাড়ি থেকে রাতের খাবার পেয়ে ভূমি কিছুটা খেয়ে বাকিটা বাবার জন্য রাখে।বাবাকে নাকি কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না কেউ।রাত ১১ টার দিকে ভূমি ঠিকই শুনতে পায় কেউ একজন মায়ের কবর এর ওখানে গিয়ে "আসমানি ও আসমানী"বলে হাউমাউ করে কাঁদছে।ভূমির অন্তরে শীতল ঢেউ বয়ে যায় তার বাবার কান্নার আওয়াজ শুনে।


খুব সকালে ফজর এর নামাজ শেষ করে পড়তে বসলে ভূমি তার বই এর ভাঁজে  একটা চিঠি পায়।সেখানে লিখা," আমি বুঝতে পারছি আমার এই বুকের ব্যথা সাধারণ বুকে ব্যথা নয়।তোকে যে কীভাবে বলবো বিষয়টা বুঝতে পারছি না।শোন মা তোর নাম আমি ভূমি রেখেছিলাম যাতে তোকে আমরা তোকে আকঁড়ে ধরে বাঁচতে পারি।আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া যে তুই।মা,৩ টি উপদেশ সবসময় মনে রাখবি ধৈর্য্য,কঠোর পরিশ্রম এবং সেবা।এর মাধ্যমেই জীবন কে আলোকিত করতে পারবি।ভালো থাকিস,সংসারের হাল টা শক্ত মত ধরিস।তোকে যে পারতেই হবে রে মা আর আমাকে ক্ষমা করিস।"


চিঠি টা বুকে নিয়ে ভূমি কেঁদে উঠে।এই চিঠিটা গতকাল দুপুরে তড়িঘড়ি করে লিখা হয়েছে তা সে বেশ বুঝতে পারছে।কিছুক্ষণ পর সে চোখের পানি গুলো মুছে এবং জীবনের থেকে কিছু আশা না করে নিজের ক্ষমতার কথা ভাবতে শুরু করে।


ভূমি ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী।সে কখনো মেধাবী ছিল না।টেনে টুনে পাশ করে সে ১০ম পর্যন্ত এসেছে।স্কুলের টিচাররা ধরে নিয়েছিলেন ভূমি মায়ের মৃত্যুর পর পড়াশোনা ছেড়ে দেবে।তারা এও ভেবেছিলেন সে খুব দ্রুত  বিয়ে করে অন্যত্র চলে যাবে এবং তার পাগল বাবা এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে একসময় নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে।এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম!


কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভূমি নিজের জীবন বদলে ফেলতে লাগলো।দিনরাত পড়াশোনা ও দোকান সামলানো সবকিছু এক হাতে করতে থাকলো।কাজ করতে করতে তার হাতের চামড়া শক্ত হয়ে উঠলো,হাতে পায়ের দুধে আলতা রঙ ধীরে ধীরে বেরঙিন হয়ে যেতে থাকলো,চেহারার আগের জৌলুস ফ্যাকাশে হয়ে গেল।সবাই খেয়াল করলো দিনে দিনে তার চেহারায় একটা কর্মঠ কর্মঠ ভাব চলে এসেছে। 


আসমানীর সেই ছোট্ট কাপড়ের  দোকানে এখন নিয়মিত সেলাইয়ের করে ভূমি।কাজের ফাঁকে পড়াশোনা আবার দুপুর হলেই দৌড়ে এসে রান্না করে দিয়ে যায় বাবার জন্য।ভূমি কঠোর পরিশ্রম করছে, রাত দিন তার এক হয়ে গিয়েছে।পড়াশোনা তীব্র গতিতে চলছে সেই সাথে হাতের কাজও!মানুষজন বলাবলি করতে থাকে যে এইটুকু বয়সে মেয়েটা কলুর বলদের মত খাটছে।আল্লাহ সাথে থাকলে মেয়েটা একদিন অনেক বড় হবে।


১ বছর কেটে গেল।ভূমির এসএসসি পরীক্ষা শুরু হতে আর ১৫ দিন বাকি।তাই পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য সে আদা জল খেয়ে লেগেছে।


একদিন পাশের বাড়ির রাত্রি ভূমিদের দোকানে যায়।তার উদ্দেশ্য ভূমিকে একটু সাজেশন দেয়া।দোকানে যেতেই দেখা গেলো ভূমি পড়ছে।


নানান কথাবার্তা বলার এক পর্যায়ে রাত্রী বলে উঠে,"একটা আবৃত্তি শুনবি?"মামার ফোন থেকে নিয়েছি" ভূমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও  'হ্যাঁ' সূচক মাথা নাড়ে।রাত্রি তার ফোন থেকে আবৃত্তিটি চালু করে আর বাজতে থাকে রবীন্দ্রনাথ এর সেই বিখ্যাত কবিতা"মনে পড়া" এর লাইন গুলো


"মা কে আমার পড়ে না মনে 


শুধু কখনো খেলতে গিয়ে 


হঠাৎ অকারণে 


একটা কি সুর গুনগুনিয়ে আমার কানে বাজে


মায়ের কথা মিলায় যেন 


আমার খেলার মাঝে।"

.......

 

কবিতার এই পর্যায়ে ভূমির চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে থাকে সে খুব দ্রত হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে সেই জল মুছে দাঁড়িয়ে পড়ে।রাত্রির দিকে তাকিয়ে বলে,"আপু আমি আসছি।"বলেই এক দৌড়ে বাড়িতে চলে আসে ।মায়ের আলমারি খুলে একটা পুরাতন শাড়ি বের করে, শাড়িটাকে বুকের কাছে নিয়ে সে নিরবে কাঁদতে থাকে। এই কান্নায় নেই কোনো অভিযোগ,নেই কোনো হতাশা শুধু আছে কষ্ট আর কষ্ট!

২ মাস পর রেজাল্ট বেড়িয়েছে।দোকানেই কাজ করছিল ভূমি।তার বাবা দৌড়ে দোকানে এসে তাকে কোলে তুলে নেয়।ভূমি অবাক হয়ে বাবা কে জিজ্ঞেস করে এত খুশির কারণ কি।আব্দুল সালাম বলতে শুরু করে,"পুরো বোর্ডে তুই ১ম হয়েছিস রে মা"ভূমি স্তব্ধ হয়ে যায়।তার কাছে পুরো পৃথিবী ঘোলাটে হতে শুরু করে। মনে একটা প্রশ্ন ই ঘুরতে থাকে তার মা আজ বেঁচে থাকলে কি করতো?তিনি কি ভূমির কপালে চুমু খেতেন না?মাথায় হাত দিয়ে প্রাণ ভরে দোয়া করতেন না?

 

পুরো এলাকা জুড়ে অষ্টমঙ্গলা চলতে থাকে।ভূমির স্কুলের বড়আপা নিজে আসে তাকে সংবর্ধনা দিতে।সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি যেই  পদক টি ভূমিকে পড়িয়ে দেয় তার নাম হচ্ছে ভূমির মায়ের নাম অনুযায়ী "আসমানী স্বর্ণপদক"।তিনি এও ঘোষণা করেন এরপর থেকে যারা তার স্কুল থেকে বোর্ডে স্থান দখল করবে তাদের তিনি এই পুরস্কার দিবেন।সেদিন ভূমিদের বাড়িতে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়।যারা একসময় ভূমিকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল তারা আনন্দে ডগমগ করতে থাকে। দেড় বছর আগেও এরকম বাড়ি ভরতি লোকজন ছিল ভূমির মায়ের লাশ দেখার জন্য আর আজকে তারাই এসেছে ভূমির রেজাল্টের খুশিতে।সত্যি সময় খুব দ্রুতই বদলে যায়।সেদিন রাতে ভূমি একটুও ঘুমাতে পারেনি।তার বারবার মনে হয়েছে আজ মা বেঁচে থাকলে কতই না খুশি হতেন।২দিন পর জেলা প্রশাসক নিজে তাকে  সংবর্ধনা দেন একই সাথে তার  ভবিষ্যত লেখাপড়ার জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করেন।

 

কেটে গেলো আরও ৩টি বছর।আজ ফাহমিদা রহমান ভূমি সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ছে। তার সময়ে সে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় পুরো বাংলাদেশে দশম স্থান অধিকার করে।অজপাড়াগাঁ থেকে সে যে এতদূর এসেছে তার পেছনে তার মায়ের ৩টি উপদেশ ছিল।ভূমির সেই পাগল বাবা ইন্তেকাল করেছে মাস খানেক হলো।শেষের দিকে এসে সে মেয়ের সাফল্যে খুবই আনন্দিত ছিলেন কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাকেও চিরকালের মত যেতে হলো।ভূমির জীবনে তার মা-বাবা না থাকলেও আছে তাদের দোয়া আরও আছে পৃথিবীর বাকি মানুষের অনেক অনেক ভালোবাসা।ভবিষ্যতে ভূমি কার্ডিওলজি নিয়ে এগোতে চায়। 


সামনের বই মেলায় তার প্রথম বই বের হচ্ছে।ভূমি জীবনচরিত সেই বইটির নাম দিয়েছে "সাহসিকা"। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ভূমির মা-বাবাকে।


২য় পৃষ্ঠাতেই রয়েছে একটি ছোট উক্তি-


" মানুষের জীবনে কঠিন সময় আসাটা খুব দরকার।কঠিন সময়ের কারণেই মানুষ সাফল্য উপভোগ করতে পারে"-এপিজে আব্দুল কালাম

 


আগুনের দিন || জান্নাতুল তাবাসসুম মীম

জান্নাতুল তাবাসসুম মীম ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ১০ম শ্রেণীর একজন ছাত্রী। তিনি লিখতে পছন্দ করেন।