আগন্তু বউদি
Winner of the Monthly Event based on Editors' Choice (31.05.22)
সোনাকাঠি বাজারে সেদিন এক মাঝবয়েসি বউদির পাল্লায় পড়েছিলাম। মানুষটার মধ্যে কেমন যেন উশখুশে একটা ভাব। খুবই অস্থির দেখাচ্ছিল তাকে। ঘনঘন চোখের পলক ফেলা, এদিক ওদিক মাথা ঘোরানো এসব দেখে আমি প্রথমে ঘাবড়ে গেছিলাম।
বাজারের মধ্যে মানুষ জমজম করছে। এত মানুষের ভীড়ে তিনি কেন আমাকেই চুপিচুপি ইশারায় কাছে ডাকলেন বুঝলাম না। তিনি কোনোরকম পরিচয় পর্ব এবং দ্বিধাবোধ ছাড়াই আমার হাতটা টেনে চারটা আঙুলের ভাঁজে সযত্নে পাঁচ'শ টাকার একখানা চকচকে নোট গুঁজে দিতে দিতে বললেন, "সোজা গিয়ে ডাইনে মোড়ে একটা সারের দোকান আছে। আমাকে একটা ধানের পোকা মারার বিষ এনে দেন তো।"
টাকাটা হাতে নিয়ে হা করে দাঁড়িয়ে আছি। বউদি আমার অবস্থা অবলোকন করে আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে হাত নিয়ে আঙ্গুলি ইশারায় বললেন, "এই সোজা যতদূর দেখা যায়, সামনে একটা মোড় আছে। ঠিক ওই মোড়েই সারের দোকান। যান না প্লিজ!"
এতক্ষণ হা করে ছিলাম। এবার মুখের সাটার লাগিয়ে চললাম মোড়ের সেই সারের দোকানের দিকে। কিছুদূর এগিয়ে থেমে গেলাম। ফিরে গিয়ে বউদিকে জিজ্ঞেস করলাম, "তা আপনি গেলে সমস্যা কী?"
"আমি যেতে পারলে কি আর খোশামোদ করতাম দাদা? আর দেখুন আমি একজন মহিলা মানুষ..."
মানুষটার কথা ততটা গায়ে মাখতে গেলাম না৷ আপাদমস্তক না ভেবে ফের শুরু করলাম যাত্রা। কিন্তু এই না ভেবে কাজ করাটা আমার আজন্ম এক অপারগতা। উপস্থিত বুদ্ধির একেবারে শূন্য পর্যায়ে আছে মস্তিষ্ক। এটা সারের দোকানে দোকানির কথায় টের পেলাম। তিনি বললেন, "কী বিষ?"
বললাম,
"ধানের পোকা মারা বিষ।"
"কী পোকা?"
আমি আর উত্তর দিতে পারলাম না। দৌড়ে এলাম বউদির কাছে। বললাম, "কিন্তু বউদি, কোন পোকার বিষ?"
বউদি বললেন, "ধানের পোকার বিষ!"
আমি বিরক্ত হলাম বউদির উপর। বললাম, "আমি অনেক ব্যস্ত, আমাকে ছাড়ুন না!"
তিনি আমাকে ছাড়েননি। মায়াবী চোখের এই নারীর অনুনয় বিনয় না শুনে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। ফের যেতে হলো কীটনাশকের দোকানে। দোকানি এবার আমাকে সতর্ক করা শুরু করলো। বলল, "ভাই, আপনাকে কি এক বউদি পাঠিয়েছে? ফর্সা করে গায়ের রং?"
আমি মাথা নাড়ালাম। উনি বললেন, "বউদি আগে এসছিল। ফিরিয়ে দিয়েছি আমি। উনি বিষের নাম বলতে পারছেন না। আর আমরা এমন ব্যক্তির কাছে বিষ বিক্রি করতে পারি না। এরা অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারে।"
এবার আমি জ্ঞাত হলাম। ভয় পেলাম বউদিকে ভেবে। বয়স হয়েছে তবুও কেমন টসটসে চামড়ার টাটকা একজন মানুষ ধানের বিষ অন্যকাজে লাগাবে তার মানে তো বিপদজনক কথা। হয়তো বিষ পান করবে। কিন্তু কেন। আর মরতে চাইলে বিষ পান করেই কেন মরতে হবে।
দোকান থেকে বউদির কাছে ফিরে যেতে যেতে ভাবছিলাম বৃত্তান্ত শুনব। কিন্তু হায়! বউদি তো সেখানে নাই। কোথায় গেল?
আধঘন্টা ধরে বাজারের সর্বোত্রে বউদিকে খুঁজলাম। কোথাও নেই। চকচকে সেই পাঁচশ টাকার নোটটা হাতের মধ্যে দোলা করে রেখে দিয়েছি সেই কখন থেকে। একবার চেয়েও দেখিনি। পাঁচশ টাকা ফিরিয়ে দেওয়া যতটা না গুরুতর মনে হলো তার চেয়ে বড় গুরুতর বিষয় মনে হলো বউদির জীবন বৃত্তান্ত জানা। প্রয়োজন হলে সহায়তা করা। টাকা ফেরত দেওয়ার চেয়ে দুটো পরামর্শ হয়ত তার জীবনের জন্য উপকারী হতো।
বউদিকে খোঁজার সেই মুহূর্তে আমার বারবার মনে পড়লো বউদির চেহারাখানা। শ্যামলা গায়ে রঙিন শাড়ি জড়ানো বউদির সিঁথিতে ছিল সিঁদুর। হাতে বালার সাথে ছিল দু-তিন জোড়া চুড়ি। সারের দোকানে পাঠাতে আমাকে অনুরোধ করার সময় হাত নাড়াতে গিয়ে রিনিঝিনি করে বেজে উঠেছিল এইসব চুড়ি। যতটুকু বুঝতে পারছিলাম, বউদির নাকে স্বর্ণের নোলক ছিল। কানদুটো শাড়ি দিয়ে ঢাকা ছিল। সেখানেও অলঙ্কারের কোনো ঘাটতি ছিল বলে বোধ হয় না। তো যে মানুষটা নিজেকে এত সাজগোজ করে রাখতে পারে অথবা লোকে যাকে এত সাজগোজ করে রাখে সেই মানুষটার এতটা দুঃখ বা বিষণ্নতা কোথা থেকে এলো? পুরুষের চোখ ধাঁধানো এমন সুন্দরী মেয়েদের তো খাওয়া পরার অভাব থাকতে পারে না। তাহলে কী এমন দুঃখ!
এতটাই কি দুঃখ যে নিজে বাজারে এসে বিষ কিনে চুপিচুপি পৃথিবীকে বিদায় জানাবে। পৃথিবীর প্রতি এত বিষাদ কেন হঠাৎ? নিজের জীবনটাকে মৃত বানিয়ে ফেললেই কি মুক্তি? আমার তো তা মনে হয় না। আমার মনে হয়, মৃত্যু হচ্ছে মানবের এ পৃথিবীতে বিচরণের অন্তিম যাত্রার নাম। এখান থেকে ফেরাই যেহেতু অসম্ভব সেহেতু মুক্তির কথা চিন্তা করা বোকামি।
যদি এখন বউদিকে পেতাম এই বিষয়গুলো আরও ভালোভাবে তাকে বোঝাতে পারতাম। তখন হয়তো একটা জীবন বেঁচে যেত।
বউদিকে ভাবতে ভাবতে দেখলাম ঘন কালো মেঘ জমেছে আকাশের কোণে। ক্ষণিক বাদেই নামবে হয়ত বাদল। বউদিকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত লাগছিল। বেলাও পুহিয়ে এসেছে। ভাবলাম, পরে কোথাও দেখা হলে টাকাটা দিয়ে দিব। ভয় পাচ্ছিলাম তার সাথে দেখা হওয়ার আগেই বোকামিটা করে বসে কিনা!
এই ঘটনার মাস খানিকের মধ্যে বউদির সাথে আমার আর দেখা হয়নি। তারপর একদিন হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। তবে বাস্তবে নয়, পত্রিকার কাগজে। বড়ো করে ছাপা হয়েছে বউদির ছবি। তবে একা না, বউদির ছবির সাথে আরও দু'জন পুরুষের ছবি একসাথে লাগানো হয়েছে।
বউদির সেই মায়াবী চাহনি, পরিহিত সেই শাড়ি, সেই নোলক, সেই চুড়ি। ছবিতে চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলো না এইজন্য। ছবিটির অন্য দুই মানুষকে ভালো করে দেখার আগে চোখ বুলাতে হলো খবরের শিরোনামে। মোটা ফ্রন্টে লেখা, 'পরকিয়ার জের ধরে পয়ত্রিশ বছর বয়সী স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন'।
খবরের বিস্তারিত পড়ার আগেই মানিব্যাগে সযত্নে রাখা সেই পাঁচশ টাকার নোটটা টেনে ছিঁড়ে ছুড়ে ফেললাম।
আগন্তু বউদি || মুতাছিম নয়ন
মুতাছিম নয়ন সরকারি পি, সি, কলেজে (বাগেরহাট) বাংলা বিভাগে অধ্যায়নরত একজন ছাত্র। তিনি লিখতে এবং বই পড়তে পছন্দ করেন। তার বাড়ি খুলনা জেলার পাইকগাছা থানার চাঁদখালী ইউনিয়নের একটি গ্রামে।