শূন্যতায় পূর্ণতা
' সে কি আজ আসবে? '
ত্রিশ মিনিট অপেক্ষার পর এর উত্তর জানতে খুব ইচ্ছে হলো হৃদিতার। অপেক্ষার প্রহরটা এই প্রথমবার হলে হয়তো এতো ভাবত না, কিন্তু সে প্রায়ই এটা করে। অপেক্ষায় রাখে হৃদিতাকে। হৃদিতার মনে প্রশ্ন, ' বার বার কেন তাকেই অপেক্ষা করতে হবে? ' তার যেমন ব্যস্ততা আছে, হৃদিতারও তেমনি ব্যস্ততা রয়েছে। কিন্তু সে বুঝে না। ' আজকে একটা বিশেষ দিন। আজকের দিনেই তার মুখে হৃদিতা ' ভালোবাসি ' শব্দটি শুনেছিল।
হৃদিতা ঘড়ি দেখল - চারটা পাঁচ।
কাটায় কাটায় সাড়ে তিনটার সময় তাদের আসার করার কথা ছিল, হৃদিতা তাই এসেছে । কিন্তু সেই মানুষটার খোঁজ নেই। বিশ বছরের একটা মেয়ের পক্ষে একা একা অপেক্ষা করা কি যে যন্ত্রণার তা কজনই বা জানে? পার্কের কিছু ছেলেমেয়ে খানিকটা কৌতূহল, খানিকটা করুণা, খানিকটা তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকাচ্ছে। হৃদিতার অসহ্য লাগছে। সে আবার ঘড়ি দেখল, আরো তিন মিনিট পার হয়েছে। সে কি আজ আসবে? হৃদিতা অস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নীচু করে মাটিতে তাকাল।
দুই মিনিটের মাথায় নিলয় তড়িঘড়ি করে এসে হৃদিতার গা ঘেঁষে বসল। বেঞ্চিটা ছোট, গা ঘেঁষে বসা ছাড়া উপায় নেই। নিলয় রোদে একদম ঘেমে গেছে। গায়ের সাদা শার্টটা ভিজে একাকার! এখানে একটু ছায়া আছে। বেঞ্চিটা একটা বৃক্ষের নিচে। হৃদিতা উপস্থিতি টের পেল। রাগে গা রি রি করতে লাগল। আজকে ধৈর্যের বাধ ভাঙতে চলেছে। যেই কিছু কথা শুনাতে মুখ খুলবে অমনি নিলয় হাতে থাকা রক্ত বর্ণের গোলাপের তোরাটা হৃদিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ' Hold it. ' হৃদিতা ব্রু কুচকে ফুলের তোরাটির দিকে তাকাল। হাতে নিতেই নিলয় টাইটা ঢিলা করে বেঞ্চির দুই দিকে দুই বাহু মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করল, ' শান্তি। ' কথাটা বলতে দেরি হৃদিতা হাতের ফুলগুলো সজোরে মাটিতে ফেলতে দেরি করল না। সাথে সাথে শান্তি নামক বস্তুটাও উধাও হয়ে গেল। সযত্নে আনা ফুলগুলো মাটিতে পড়া দেখে নিলয় কড়া গলায় বলল, ' How dare you? Are you mad, girl? আপনার সাহস কি করে হয় এটা করার? '
এতক্ষণ হৃদিতা মাথা নিচু করে রাগে ফুসাচ্ছিল। রাগটা প্রকাশ করতে এখন যেই না মুখ খুলবে অমনি মস্তিষ্ক কিছু একটার সংকেত দিল। কণ্ঠস্বরটা ভিন্ন ঠেকছে। কথা বলার ভঙ্গিও আলাদা। শেষ বাক্যটিতে " আপনি " শব্দটার প্রয়োগ রয়েছে, যা আনভীর কখনোই করে না। হৃদিতা মুখ তুলে নিলয়ের দিকে তাকাল। মুখ দেখেই ভ্যাবাচেকা খেল। এ তো আনভীর না, যার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল সে। হৃদিতা কি বলবে বুঝতে পারল না। মাথা নিচু করে রইল। নিলয় বলল, ' চুপ করে আছেন কেন বলুন এটা কেন ফেললেন? ' হৃদিতা আমতা আমতা করে বলল, ' আমি... আমি আসলে বুঝতে... দুঃখিত... আমি আসলে বুঝতে পারি নি। আমি আপনার জায়গায় অন্য কাউকে ভেবেছিলাম। '
' কাকে? '
' আনভীরকে। '
' স্পেশাল কেউ? '
হৃদিতা নিলয়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, ' হু, অনেক। '
নিলয় কিছু বলল না, চুপ করে রইল। হৃদিতা ফুলের তোরাটা মাটি থেকে উঠিয়ে নিলয়ের হাতে দিয়ে মুচকি হেসে বলল, ' আপনিও বুঝি বিশেষ কারো জন্যে ফুলগুলো এনেছেন? '
নিলয় স্বহাস্য মুখে বলল, ' হ্যাঁ, ওই সামনে কতগুলো ছেলে - মেয়ে দেখছেন তারা আমার বন্ধু। তাদের মধ্যেই একজনের আজকে জন্মদিন আর তার জন্যই এই ফুলগুলো। '
' তারা হয়তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।'
' হ্যাঁ, আমি এখন আসি। ভালো থাকবেন। '
হৃদিতা সৌজন্যমূলক হেসে মাথা নাড়ায়। হঠাৎই নিলয়ের ফোনটা বেজে ওঠে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠে কেউ বলে, ' কি রে কই তুই? '
' পেছনে তাকা। '
নিলয় হাত নেড়ে বন্ধুদের উপস্থিতির জানান দিয়ে ফোনে কথা বলতে বলতেই হৃদিতাকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। নিলয় চলে যাওয়ার সাথে সাথেই হৃদিতা ধপাস করে বেঞ্চিটাতে বসে পড়ে। কয়েকবার আনভীরকে ফোনও দেয়। প্রত্যেকবারই ওপাশ থেকে এক মেয়েলি কণ্ঠ বল ওঠে, ' দুঃখিত, কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে এই মুহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না...'
দু' দিন হয়ে গেল আনভীরের কোনো খোঁজ নেই, লাপাত্তা। হৃদিতা অনেক চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করার কিন্তু ফলাফল শুণ্য। ফোনটাও বন্ধ। হৃদিতার দুশ্চিন্তা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। হঠাৎ আনভীরের কি হলো, আগে তো কখনো এমনটি করেনি তাহলে আজ কেন? বারবার এক অজানা ভয় হৃদয় কূলে প্রচণ্ড বেগে আঁচড়ে পড়ছে।
শত চিন্তার ভিড়ে অকস্মাৎ কলিং বেলটা টুং শব্দ তুলে বেজে ওঠল। হৃদিতা গুটি গুটি পায়ে গিয়ে দরজা খুলতেই কম বয়সী এক ডেলিভারী বয় বলে ওঠে , ' হৃদিতা আহমেদ আছেন? '
' জ্বী, বলুন। '
ডেলিভারী বয় একটা পার্সেল হৃদিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল , ' ম্যাম আপনার জন্য একটা পার্সেল আছে। কান্ডলি এখানে একটা সাইন করে দিন। '
হৃদিতা ভ্রু কুচকে ছেলেটার দিকে তাকায়। বলল, ' আমার নামে পার্সেল কে পাঠিয়েছে? '
' আনভীর রহমান। '
হৃদিতা কেঁপে ওঠে। কৌতুহলবশত হোক বা ছেলেটির তাড়ায় হোক তাৎক্ষণিক সাইন করে পার্সেলটা হাতে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দ্রুত নিজের ঘরে চলে আসে। পার্সেলটা খুলতেই একটা ছোট্ট বক্স, চিঠি আর নীল রংয়ের একটা ইনভিটেশন কার্ড দেখতে পায়। সবকিছু ফেলে চিঠিটার ভাঁজ ভাঙতেই গোটা গোটা অক্ষরের কিছু লেখা দেখতে পায়। ছোটখাট একটা চিঠি, সুদীর্ঘ নয়। হাত কাঁপছে, বুক ধুকপুক করছে তবুও চিঠিটা আকড়ে ধরে আছে। চিঠিতে কি আছে তাকে জানতে হবে, হবেই !
প্রিয় হৃদি,
কিভাবে শুরু করব জানিনা! লিখতে বুক কাঁপছে, হাতটা অবশ হয়ে আসছে কিন্তু বাস্তবতাটাকে যে কলম আঁচড়ে তুলে ধরতেই হবে! কেননা আর যে বেশি সময় নেই। হৃদি, আজকের পর থেকে হয়তো তোমাকে ' হৃদি ' বলে ডাকার অধিকারটাও আমি হারাব। কিন্তু কি করব বল আমি যে অন্বয়ের শিকলে বন্দি! আমি জানি তুমি সেদিন আমার জন্য অনেকটা সময় ধরে অপেক্ষা করেছিলে কিন্তু আমি যাই নি। হয়তো বা ফোনের উপর ফোনও করেছ ; কেন যাই নি তা জানার চেষ্টায় অবকাশটুকুও রাখনি! অনেক অভিমান জমেছে তাই না? কি ভাবছ বড্ড খারাপ আমি? তাহলে আমি বলব তুমি ঠিকই ভেবেছ। জানো হৃদি সেদিন আমি তোমার কাছে যাওয়ার জন্য ঠিকই রেডি হয়েছিলাম তোমার পছন্দের কালো পাঞ্জাবিটাও পড়েছিলাম। কিন্তু যেই না বাড়ি থেকে বের হব দেখলাম ছোট ফুফু, ফুফা আর ফুফাতো বোন অয়নাও এসেছে। তখন কেন জানি মনে হচ্ছিলো কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে। কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে কি জানো সেদিন আমার ভাবনা সঠিক ছিল। বাবা বললেন, ' আজকে অয়নার সাথে তোমার আকদ। ' কথাটা শুনে আমার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। আমি ইতোমধ্যে অনেকবারই তোমার কথা বাবা - মাকে বলেছিলাম সেদিনও বলতে ভুলি নি। কিন্তু আমার প্রস্তাবে মা কটাক্ষ করে বললেন, ' আর একটি বার যদি তুমি ওই মেয়ের কথা বল তাহলে আমার মাথা খাও ; নচেৎ তুমি জেনে রাখ এই পৃথিবীতে তোমার বাবা মা আর বেঁচে নেই। ' বলেই মা কেঁদে দিলেন। তুমি তো জানই আমি তাদের একমাত্র সন্তান। এই পৃথিবীতে আমার কাছে তারাই আগে। আর তুমিই তো সবসময় বলতে মা - বাবাকে কখনো কষ্ট না দিতে। আমি নিরুপায় হয়ে সেদিন বিয়েতে মত দিয়ে দেই। কিন্তু তুমি হয়তো ভাবছো আমি এগুলো চিঠিতে কেন লিখছি? মা আমার কাছ থেকে আমার ফোনটা নিয়ে গেছেন আর থাকলেই বা কি হতো এই কথাগুলো আমি কোন মুখে তোমাকে বলতাম? সরাসরি বলার সাহস নেই আমার। খুব ইচ্ছে ছিল তোমার মামির সংসার থেকে তোমাকে আমার সংসারে বউ করে আনার কিন্তু আমার সেই স্বপ্ন বল ইচ্ছা বল কোনোটাই পূরণ হওয়ার নয়। হৃদি আমি চলে যাচ্ছি তোমার জীবন থেকে। তোমাকে লাল টুকটুকে বউ করে নিয়ে যেতে পারলাম আমার ঘরে! জানি তুমি অনেক কষ্ট পাচ্ছ আমিও পাচ্ছি। জান, মানুষ আনন্দ ভুলে যায় কিন্তু কষ্টগুলো কখনোই ভুলে না। আমরা না হয় একে অপরের কষ্ট হয়েই রয়ে যাব। ভেঙে পড় না। তুমি তো কতো ম্যাচিওর, কত বুঝ, কত স্ট্রং, কত কিছু সহ্য করতে পার। তোমার কিন্তু ভেঙে পড়লে একদমই চলবে না! তোমার সদ্য ফোটা গোলাপ ফুল অনেক পছন্দ , সেটা কিন্তু পরদিনই মরে যায়। কিন্তু মৃত গোলাপ ফুল অমূল্য, পুরনো পাতার ভাজে এক টুকরো হৃদয়ের মতো থেকে যায়। আমি তোমার লাল টুকটুকে গোলাপ হতে পারলাম না হৃদি, কিন্তু আমায় শুকনো গোলাপের মতোই গুছিয়ে রেখ তোমার মনে বা আনমনে। পারলে ক্ষমা করে দিও আমায়।
আনভীর
পুনশ্চ : ইতোমধ্যে হয়তো বিয়ের কার্ডটা দেখেছ। শেষবারের মতো চাইব বিয়েতে এসো প্লিজ। ছোট্ট বক্সটাতে একটা আংটি আছে ভেবেছিলাম নিজ হাতে পড়িয়ে দিব কিন্তু বোধহয় সেটা সম্ভব না কিন্তু আমার স্মৃতি হিসাবে এটা রেখে দিও।
হৃদির চোখ অশ্রুসিক্ত। নীল চিঠিটার মসৃণ পৃষ্ঠে কি দেখে যেন তার চোখ পলক হারিয়েছে, নীচের ঠোঁটে দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরেছে, কষ্টে মুখ হয়েছে লাল।চোখ থেকে ফোটা ফোটা রহস্য টুপটাপ করে চিঠির ওপর পড়ে একটি অংশ ভিজিয়ে দিচ্ছে । নিস্তব্ধে কান্নারত দেহটা বারবার কেঁপে উঠছে। হৃদি কান্না আটকানোর জন্যে মুখে ওড়নার পারটা চেপে ধরতেই গাল বেয়ে অজস্র অশ্রুবৃষ্টি টপটপ করে পড়তে লাগল। অশ্রুপূর্ণ চোখ খুলে কাঁপতে থাকা বাম হাতে বিরাজমান চিঠিটা বিছানার এক পাশে রেখে ছোট্ট লাল বক্সটা খুলতেই সোনালী রংয়ের একটা আংটি দেখতে পায়। হৃদিতা আংটিটাও চিঠিটার পাশে রেখে দেয়। আনভীরের পাঠানো তিনটা জিনিসের মধ্যে বাকি থাকে নীল রংয়ের বিয়ের কার্ডটা। খুলতেই আনভীরের নামের পাশে অন্য কারো নাম দেখেই চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। এই নামটার জায়গায় তো হৃদিতার নাম থাকার কথা ছিল। কিন্তু কেন হলো না? সবাই কেন হৃদিতাকে ছেড়ে চলে যায়। কেন সে বেশিদিন প্রিয় মানুষগুলোকে আঁকড়ে বাঁচতে পারে না! কান্নার বিকট শব্দে হৃদিতার মামি সুজলা দৌড়ে হৃদিতার কাছে আসে। হৃদিতার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি থমকে যান। হৃদিতার শ্বেতবর্ণ মুখ কান্না করার ফলে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। সুজলা বিচলিত হয়ে হৃদিতার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ' কি রে মা, কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন? ' মায়ের মতো মামিকে পেয়ে হৃদিতার কান্নার বাঁধ ভেঙে গেল। মামিকে জড়িয়ে ধরে হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল, ' মামি, আজকেও ভাগ্য আমার সাথে পরিহাস করল! কেন , সবসময় আমিই কেন টোপ হব ? সেই দশ বছর কালে এক এক্সিডেন্টে বাবা - মাকে হারিয়েছি। সেই থেকে তোমাদের এই অভাবের সংসারে থেকে অহেতুক ঝামেলা হয়ে আছি। আর এখন যেই একজনকে নিজের সবটা উজার করে ভালোবেসেছিলাম সেও আমাকে ছেড়ে চলে গেল। সে বলেছে আমি অনেক ম্যাচিওর, অনেক বুঝি , অনেক স্ট্রং, অনেক কিছু সহ্য করতে পারি। আমার ভেঙে পড়লে একদমই চলবে না। জানো তাকে সামনে পেলে খুব করে বলতাম, চিৎকার করে বলতাম, চাই না আমি প্রতিবার ম্যাচিওরিটির বোঝা বইতে, চাই না সবসময় সবারটা বুঝতে, চাই না সমস্ত দুঃখ - কষ্ট - না পাওয়াগুলোকে হাসি মুখে মেনে নিতে। ভালো লাগে না সবসময় স্ট্রং হয়ে থাকতে, একদম ভালো লাগে না। শ্বাস আটকে আসে। কষ্ট আমারও হয়, ব্যাথা আমিও অনুভব করি। ভেঙে পড়ি ; হাউমাউ করে কান্না করতে আমারও ইচ্ছে করে...'
হৃদিতার ব্যাথায় ব্যথিত হয়ে সুজলা আর চোখের পানি আটকে ধরে রাখতে পারল না। হৃদিতাকে তেমন সুনজরে না দেখলেও তিনি আজ নির্বিণ্ন। যতই হোক মায়ের মন। হৃদিতার মাথায় , পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে আবেগি কন্ঠে বলল, ' মারে ঝড়ের পর আকাশ নীরব থাকে। কাদিস না, ধৈর্য্য ধর। মহান আল্লাহ ঠিকই তোর জন্য ভালো কিছু ভেবে রেখেছেন। ভেঙে পড়িস না। জীবনে হার জিত আছেই। এমন একজন নিশ্চয়ই আসবে যে কখনো তোর কাছ থেকে হারিয়ে যাবে না। '
পুরো বাড়ি মানুষে গিজগিজ করছে। যেখানে চোখ যায় সেখানেই মানুষ। আজ আনভীরের বিয়ে। হৃদিতা এক কোনায় একলা দাঁড়িয়ে আছে। পরনে হালকা গোলাপি শাড়ি, কৃষ্ণ বর্ণ কেশ বাতাসে দোল খাচ্ছে। মুখে প্রসাধনীর ছিটেফোটাও নেই, তবুও অতি সাধারণের আবরণে , অসাধারণ লাগছে। হৃদিতার অপলক দৃষ্টি, প্রিয় মানুষটিকে প্রাণভরে দেখছে। হয়তো এটাই শেষ দেখা, হৃদিতা হয়তো আর কখনোই নিজ থেকে আনভীরের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে না। আজকেও হয়তো আসত না কিন্তু চিঠিতে আনভীর উল্লেখ করেছে হৃদিতাকে আসতেই হবে। যতই হোক প্রিয় মানুষটির শেষ আবদার বলে কথা, সে কি না রেখে পারে! হৃদিতা গুটিগুটি পায়ে আনভীরের কাছে এগিয়ে গেল। আনভীরে মুখে হাসি নেই, মুখ ভার। কাউকে হয়তো খুঁজচ্ছে। বারবার সদর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো হৃদিতার পথ চেয়ে বসে আছে। অপরদিকে অয়নাকে দেখে খুব খুশি খুশি মনে হচ্ছে। কি সুন্দর হেসে হেসে সবার সাথে কথা বলছে। হৃদিতা অয়নার সামনে গিয়ে দাড়াল। মিষ্টি হেসে বলল, ' দেখি ভাই তোমার হাতটা। '
এমন আবদারে অয়না উত্সুক চোখে তাকাল। হৃদিতার হাসি দেখে আর কিছু ভাবল না। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ' কেন বল তো? '
হৃদিতা পার্স ব্যাগ থেকে একটা আংটি বের করে অয়নাকে পড়িয়ে দিয়ে বলল, ' এটা যত্ন করে রেখ কেউ একজন আমাকে ভালোবাসে দিয়েছিল কিন্তু আমার রাখার ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনটাই নেই তাই আমি এটা তোমাকে দিলাম। যত্ন করে রেখ কিন্তু, ক্যামন? '
' খুব সুন্দর তো, অবশ্যই রাখব। কিন্তু তোমাকে তো চিনতে পারলাম না। '
হৃদিতা আনভীরে দিকে তাকাল। আনভীরের উদাসীন দৃষ্টি। হৃদিতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আনভীর বলল, ' আমার ফ্রেন্ড। তুমি এখানে বস আমি একটু কথা বলে আসি। '
' আচ্ছা। '
আনভীর হৃদিতার দিকে তাকাল। নরম কন্ঠে বলল, ' একটু সাইডে আসবে? '
' হু। '
হৃদিতা আর আনভীর এক জায়গায় গত পাঁচ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে । কেউ কোনো কথা বলছে না। শুধু একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘক্ষণের নীরবতা ভেঙে আনভীর বলল, ' আংটিটা তো আমি তোমাকে দিয়েছিলাম। শেষ স্মৃতি চিহ্ন হিসেবেও কি নিজের কাছে রাখা যেত না? '
' যেই মানুষটাকে আমার পাশে শোভা পায় না, সে মানুষটার দেয়া কোনো কিছুই আমার জীবনে শোভা পাওয়ার কথা না! '
হৃদিতার নয়ন অশ্রুসিক্ত। চোখ থেকে একফোঁটা অম্বু কপোল গড়িয়ে চিবুকে ঠেকলো। লুকিয়ে রাখার অদম্য চেষ্টায় নিয়োজিত সে। আনভীরও কিছু বলছে না। ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না , শব্দগুলো আজ বিলীন। অনুভূতি প্রকাশের বেলায় শব্দের সংকীর্ণতা খুবই বাজে! ক্ষণিকের ব্যবধানে পুনরায় পিনপতন নীরব শুরু হলো। শোনা যাচ্ছে শুধু মানব - মানবীর শ্বাস - প্রঃশ্বাসের শব্দ। কোনো এক নিঃশব্দতার ঘোর আটকে রেখেছে তাদের দীর্ঘশ্বাসগুলো তাই কথা হয়ে ফুটতে চাইলেই কথাগুলো অভিব্যক্ত হচ্ছে না। আনভীর হৃদিতার মুখপানে তাকাল। দ্বিতীয়বারের মতো আবার আনভীরের কন্ঠস্বর শুনা গেল। সংকীর্ণ গলায় বলল, ' আমাদের কি এরপর আর কোনোদিন কোনো কথা হবে না? '
হৃদিতা ভরাট গলায় বলল্, ' হয়তো হবে, হয়তো হবে না। তাতে কি আসে যায়? আলাদা রাস্তা কখনো এক হয়ে যায়? গন্তব্য যখন আলাদা করেছই তবে এর তীব্র দহনগুলোও আলাদা হোক। তুমি করতে থাক সুখের খোঁজ, আমি করতে থাকি দীর্ঘশ্বাসের খোঁজ! পৃথক পাহাড় কখনো এক হয় না , এক হতে নেই। ভালো থেকো বলব না - সে তো সামাজিকতা। যেমন থাকার তেমনি থেকো। সহধর্মীনিকে মন উজাড় করে ভালোবেসো, কখনো কষ্ট দিও না। আসি। '
আনভীরের চোখ ছলছল করছে । ' ছেলেদের কাদতে নেই ' এই যুক্তিতে মন খুলে কান্নাও করতে পারছে না। সেও তো হৃদিতাকে ততটুকুই ভালোবাসে, যতটা হৃদিতা ভালোবাসে আনভীরকে। হৃদিতা শাড়ির আঁচলে চোখ - মুখ মুছে নিল। আনভীরের মুখটা দৃষ্টি বদ্ধ করে সেখান থেকে চলে এলো।
রাতের বেলা। হৃদিতা ঘড়ি দেখল - ০৭:৩৫ । দশ মিনিট দাড়িয়ে থাকার পর হৃদিতার মনে হলো এই মুহুর্তে এখানে কোনো যাতায়াতের মাধ্যম পাওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত নিল কিছু দূর হেঁটে রিক্সা স্ট্যান্ড থেকে রিক্সায় করে বাড়িতে ফিরবে। পা বাড়াতেই মনে হলো কেউ পেছন থেকে ডাকছে। একজন মানুষ অচেনা কাউকে ডাকলে যেই ভাবে ডাকে ঠিক সেই ভাবে। হৃদিতা থমকে দাড়াল। পেছনে তাকাতেই কিছুটা অবাক হলো। নিলয় দাড়িয়ে আছে। পরনে সোনালী কারুকার্যের কালো পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীতে অন্য রকম লাগছে। অন্য রকম বলতে ভারী সুন্দর লাগছে। কালো হৃদিতার প্রিয় রং। কিন্তু এই রংটা প্রিয় মানুষটার সংস্পর্শে আরো প্রিয় হয়ে ওঠত। হৃদিতার ভাবমূর্তির পরিবর্তন হলো না। নিলয় জিজ্ঞেস করল, ' মনে হচ্ছে চিনতে পারেননি। '
' উহু, পেরেছি। '
' যাক, ভালো। তা এখানে কেন? নাকি আমি এখানে যেই কারণে আপনিও ঠিক একই কারণে? '
' বিয়েতে এসেছি।'
নিলয় মুচকি হাসল। বলল, ' আমিও তো। তা আপনি কোন পক্ষ? '
প্রশ্নটার উত্তর দিতে হৃদিতার বুকটা কেঁপে ওঠল। শ্বাসরোধ হতে লাগল। হিম কন্ঠে বলল, ' বর পক্ষ। '
' আমি কনে পক্ষ। আপনি কি বাড়ি যাচ্ছেন? '
' হু।'
' চলুন, আমি নামিয়ে দিয়ে আসি। '
' না, আমি একাই যেতে পারব। '
' কোথায় যাবেন? '
' আজিমপুর। '
' আরে আমিও তো সেখানেই যাব। আর আজিমপুর এখান থেকে বেশি দূরে নয়। আমার কষ্ট হবে না তাছাড়া এই মুহুর্তে একটা রিকশায়ও পাবেন না। আমার সাথে চলুন, আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। '
হৃদিতা কিছু বলল না। নিলয় মুচকি হেসে বলল, নীরবতা সম্মতির লক্ষণ। আপনি দাঁড়ান। আমি গাড়ি বের করছি। কোথাও যাবেন না।'
নিলয় গাড়ি বের করল। হৃদিতা উঠতেই গাড়ি চালানো শুরু করল। পেছনের সিটে হৃদিতা বসে আছে। মাথা নিচু, মুখ ভার। নিলয় লুকিং গ্লাসে হৃদিতাকে দেখছে। গোলাপি শাড়িতে হৃদিতাকে মানিয়েছে। নিলয় বলল, ' আচ্ছা, আমরা তো একে অপরের নামই জানলাম না। আমার নাম নিলয়। আর আপনার? '
হৃদিতা স্পষ্ট স্বরে বলল , ' হৃদিতা। '
' খুব সুন্দর নাম। '
হৃদিতা প্রতিত্তুর করল না। নিলয় বলল, ' বিয়ের কনে আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। সেই সুবাদেই এসেছি। চারদিকে শুধু বিয়ের গন্ধ বুঝলেন। আচ্ছা আপনাদের বিয়ের দাওয়াতটা কবে পাব? কি খবর আপনার উনির ? কি যেন নাম ? হ্যাঁ, আনভীর। '
হৃদিতা মাথা তুলে লুকিং গ্লাসের দিকে তাকাল। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ' বিয়ের কার্ডে বরের নাম দেখেননি? '
' না, দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু কেন বলুন তো ? '
হৃদিতা বাইরের দিক তাকাল। নরম গলায় বলল, ' বিয়েতে বরের আসনে যে বসে ছিল সেই আনভীর। আজ তারই বিয়ে। '
হৃদিতার কথায় নিলয় বিস্মিত হলো। হৃদিতার জন্য তার খানিকটা মায়াও হলো। সে লুকিং গ্লাসের দিকে তাকাল। হৃদিতার চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। হৃদিতা কান্না করছে। লুকিং গ্লাসে হৃদিতার কান্নাভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে নিলয় বলল, ' হৃদিতা, আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? '
' গাড়িটা একটু থামাবেন, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। '
তিন মাস পর...
হৃদিতাকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। পরনে বাসন্তি রংয়ের শাড়ি, খোপায় বেলিফুলের গাজরা। সুগন্ধে ম ম করছে চারপাশ। চোখে গাঢ় কাজল। হৃদিতার মামি সুজলার ভাষ্যমতে পাত্রপক্ষের হৃদিতাকে পছন্দ হলে আজকেই আকদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে। সাজানোর সময় সুজলা অনেকটা সময় ধরে গুছিয়ে হৃদিতাকে বলেছিল, ' দেখ মা, যা হওয়ার তা হয়েছে। সব কিছু ভুলে তুই আবার নতুন করে জীবন শুরু কর। এইবার আর পাত্রপক্ষকে মিষ্টিমুখ না করার আগে বিদায় নিতে দিস না। পাত্র ভালো। বড় ডাক্তার। পাত্রপক্ষের কোনো দাবি নেই। এই যুগে যৌতুক চায় না এমন ছেলে পাওয়া দুলর্ভ। আমাদের অবস্থা তো জানিসই ; তোর মামা দু'দিন পরই রিটার্ড করবে। বুঝতে পারছিস তো ব্যাপারটা!'
সুজলার কথায় হৃদিতা শুধু মাথা নাড়িয়ে ছিল। সে এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিছুতেই আর পাত্রপক্ষকে ফেরানো যাবে না ; আনভীরের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে অনেক ভালো ভালো সম্বন্ধে মত দেয়নি তখন । কিন্তু এইবার সে নিজ সিদ্ধান্তে অটল ; নিজের জন্য না হোক এই পরিবারের প্রতিটা সদস্যদের কথা ভেবে তাকে এই বিয়েটা করতেই হবে।
একখানি সাদাসিধা মুখ, সাদাসিধা দুটি চোখ এবং সাদাসিধা একটি শাড়ি পরিহিত এক ভদ্র মহিলা হৃদিতাকে বলল, ' কি নাম তোমার, মা? ' বাক্যের শেষে মা শব্দটি হৃদিতার খুব ভালো লাগল। ভদ্র মহিলা এতো সুন্দর করে হেসে কথাটা বলেছে যে হৃদিতা আর স্বভাবসুলভ হাসি না দিয়ে থাকতে পারল না। প্রতিত্তুরে বলল, ' হৃদিতা। '
' হৃদু মা, তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি তোমার হবু শাশুড়ি। '
মুহুর্তে হৃদিতার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে ওঠল। কেন যেন মহিলার মধ্যে হৃদিতা নিজের মাকে খুজেঁ পাচ্ছে। কি চমৎকার করে হাসেন, কথাগুলো কি সুন্দর মধু মাখানো! হৃদিতা বাকিদের দিকে তাকাল। একজন সমবয়সী মেয়ে হৃদিতার দিকে হাসিমাখা চোখে তাকিয়ে আছে। তার পাশে বসা আরো একজন মহিলা। পাশে এক মধ্যবয়স্ক লোক। ব্যস এই চারজনই পাত্রপক্ষ থেকে এসেছে আর কেউ নেই, পাত্র আসে নি।
' দেখি মা তোমার ডান হাতটা ! '
হৃদিতা সুজলার দিকে তাকাল। সুজলা বলল, ' আপনারা আর কোনো প্রশ্ন করবেন না? '
ভদ্রমহিলা বলল, ' না, আর কোনো প্রশ্ন নেই। সব তো শুনেছি আপনার কাছে। '
হৃদিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ' কই হাতটা দাও। '
হৃদিতা হাত বাড়ালে ভদ্রমহিলা একটা আংটি পড়িয়ে দেয়।
' আমার ছেলেকে না দেখে বিয়ে করতে তোমার কোনো আপত্তি আছে? '
হৃদিতা সুজলার দিকে তাকাল। সুজলার কঠিন দৃষ্টি! চোখের ভাষায় বলার চেষ্টা, ' যা বলে তা মেনে নে, বল কোনো আপত্তি নেই। '
মামা - মামির আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে হৃদিতা মত দেয়। ছেলে যেমনই হোক হৃদিতাকে বিয়ে করতেই হবে। হৃদিতা বলল, ' যে মায়ের ব্যক্তিত্ব এতো চমৎকার সে মায়ের ছেলে আর যাই হোক খারাপ হবে না। '
সবার মুখে হাসি। সবার সিদ্ধান্তে ঠিক হলো আগামী সপ্তাহে হৃদিতার বিয়ে।
সকাল থেকে মানুষের আনাগোনা শুরু। আত্মীয় - স্বজনে পুরো বাড়ি মুখর। ইতোমধ্যে হৃদিতকে সাজানো হয়ে গেছে। খোপায় বকুলের গাজরা। হালকা - পাতলা গহনা সাথে লাইট কালারের শাড়ি। বরপক্ষ চলে এসেছে ; সানাই বাজছে। চারদিকে হই - হুল্লোড়। হৃদিতার বান্ধুবীরা দলে দলে এসে বলছে, 'দোস্ত, দুলাভাই দেখতে ভীষণ সুন্দর। '
হৃদিতা বসে আছে। মুখে লম্বা ঘোমটা। ঘরে আর কেউ নেই ; একা। নতুন বাড়ি; নতুন ঘর। ঘরটা অনেক সুন্দর করে সাজানো। হৃদিতার পছন্দ হলো। বালিশের ওয়ার ও বিছানার চাদর হালকা গোলাপি। গোলাপি চাদরে বেলি ফুল আর গোলাপ দিয়ে নানা রকমের নকশা করা। খাটের পাশে সাইড টেবিলে ফুলদানি ভর্তি গোলাপ। গন্ধে পুরো ঘর ম ম করছে। ঘরে মৃদু মৃদু আলো। হৃদিতার বেশ ভালোই লাগছে। এরই মাঝে দরজা খোলার আওয়াজ। দরজা বন্ধের আওয়াজও শুনতে পাওয়া গেল। ঘোমটার আড়ালে আগন্তুকে দেখার চেষ্টা করল । মুখ দেখা যাচ্ছে না। সে এগোচ্ছে। হৃদিতার সামনে বসে মৃদু স্বরে ডাকল , ' হৃদি। ' হৃদিতা কেঁপে ওঠল। ঘোমটা সরাতেই অস্পষ্ট স্বরে চমত্কৃত হয়ে বলল, ' নিলয়, আপনি! '
শূন্যতায় পূর্ণতা || অনিকা আক্তার সিনথিয়া
অনিকা আক্তার সিনথিয়া তেঘরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী। তার বাড়ি কেরাণীগঞ্জ। তিনি লিখতে পছন্দ করেন।