একজন মৃন্ময়ী কিংবা আমেনার গল্প
মাথার উপর বিন্দু বিন্দু তারার মতো সার্জিক্যাল লাইট। চারপাশে মাস্ক-গাউন পরা ডাক্তার। সুখন উদ্দিন ডাকে, "আমেনা! ও আমেনা""
অন্ধকার কোন হতে একটি ফর্সা হাত বের হয়ে সুখনের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। বড় মোলায়েম, সুখনের মনে হয়। তবে পরক্ষণেই সে চোখ বড় বড় করে বলে, "তুমি! তুমি তো..." অথচ বাক্যটি শেষ করবার আগেই সুখনের চোখ বুজে আসে। অন্ধকারে বসে থাকা নারীমূর্তিটি নিঃশব্দে তার হাত সরিয়ে আনে। ফিসফিসিয়ে, যেন নিজেকেই উত্তর দেয়, "হ, আমি আমেনা না।"
ওর নামটা যেন কী? ওর ঠিক মাথায় আসে না। প্রতিদিন ওকে অসংখ্যবার অসংখ্য মানুষ হতে হয়। এত মানুষ সাজতে গিয়ে নিজের নাম ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।
তবে এই লাইনে তার একটা নাম আছে। বিউটি।
প্রথম যেদিন সে এই লাইনে যোগ দিয়েছিল, ওর বয়স পনেরো-ষোলো। মালিক শাহাবুদ্দিন তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "নাম কী?"
সে নাম বলেছিল।
শাহাবুদ্দিন তার নাকের ময়লা কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে, বল বানাতে বানাতে বলেছিলেন, "এই নাম ভুইলা যা। তোর নাম আইজ থেইকা বিউটি।"
বিউটি কথা রেখেছে। নিজ নাম ভুলে গেছে।
বিউটির মতো মেয়েদের একটাই কাজ। হাত ধরে বসে থাকা। মৃত্যু পথযাত্রী, যাদের কেউ নেই বা মৃত্যুর সময় যাদের পাশে কেউ থাকে না। স্বল্পসময়ের জন্য তাদের আপনজন হয়ে তাদের পাশে থাকা।
অথচ প্রায় প্রতিবারই কেন যেন ওরা বুঝে যায় বিউটি ওদের আপন লোক না। অনেকে তো হাতটা ঘৃণায় ছুড়ে ফেলে দেয়। ওরা কী ভাবে? এই প্রবল একাকীত্বের দায় ওরা কাকে দেয়? বিউটির খুব জানতে ইচ্ছে করে।
অবশ্য মাঝেমধ্যে কেউ কেউ বুঝতে পারে না। ওই তো সেদিন একটা ছেলের কথা মনে পড়ে। প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় বিষ খায়। স্টোমাক ওয়াশ করিয়েও কাজ হয়নি। শেষমুহুর্তে বিউটিকে ডাকা হয়।
ছেলেটা অদ্ভুত সুপুরুষ ছিল। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় এমন। বিউটি তার হাত ধরতেই সে বলে, "মৃন্ময়ী! মৃন্ময়ী তুমি এসেছ? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মৃন্ময়ী। আবার ভালোও লাগছে। কতদিন পর তুমি আমার হাত ধরলে বলোতো?"
ছেলেটা আজও জানতে পারেনি মৃন্ময়ী সেদিন আসেনি।
হাসপাতালগুলো বিউটিদের মতোন মেয়েদের সামান্য কিছু পয়সা দেয়। এতেই সংসার চালাতে হয়।
বিউটির স্বামী বোরহান আলী তেমন কিছু করে না। সংসারে তার মন নেই। তার যাবতীয় আহ্লাদ জুয়ার ছকে।
সময়-পরিবেশের ধার না ধেরে সে প্রায় সারাদিনই জুয়ার আসরে মেতে থাকে। তার অর্থের উৎস বিউটি। টাকা ফুরালেই সে বিউটির স্মরণাপন্ন হয়। আর যদি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে ওকে মারধর করে।
আজ সকালেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওদের সন্তান রইস মিয়া উঠানে খেলছিল। বোরহানের লুডোর গুটি একটা সে খেলার ছলে মুখে দিতেই, সে তাকে মারতে শুরু করলো। রইসের বয়স দুই। অতটুকু শিশুর মার সহ্য হওয়ার কথা নয়। তাই তার কান্না কোনো বাধ মানলো না বরং রাগী স্রোতের মতো বেয়ে চললো।
বিউটি তড়িঘড়ি করে রইস কে কোলে তুলে নিল।
"আরে করেন কী? আমার পোলারে মারেন ক্যা?"
বোরহান ক্ষেপে থাকে। সে রাগলে তার মুখে থুতু জমে যায়। সে থুতু ছেটাতে ছেটাতে বলে, "মাগী! রাখ তোর পোলা। তুই আমারে টেকা দেস না কেন?" এবং এই বলেই সে তার চুলের মুঠি ধরে টান দিল।
বিউটির চোখ দিয়ে পানি গড়াল। সে বললো, "ছাড়েন! ছাড়েন কইলাম। পয়সা কি আকাশ থেইকা গড়ায়? সারাদিন গতর খাইটা আপনেরে আমি দিয়া দিমু? আমার পোলায় খাইব কী?"
বোরহান একটা থাপ্পড় দিয়ে বিউটিকে অপরপাশে ফেলে দেয়। চৌকির শক্ত তক্তায় আঘাত পেয়ে বিউটির মাথা দিয়ে রক্ত ঝরে।
বিউটির আব্বাজান ছিল এক স্কুলের মাস্টার। বিউটির জন্মের পরপরই নাকি মারা গেছে। ওর অবশ্য এই কথায় বিশ্বাস হয় নাই। ওর মা, বেশ্যা মাগী। বাপের ঠিক-ঠিকানা আছে?
ওর মা ও মরেছে বহুকাল হলো। ও ওর মায়ের মতো হয় নাই। আবর্জনা খেয়ে পেট ভরিয়েছে, কালে-অকালে না খেয়ে থেকেছে। তবুও বেশ্যা বনে নাই।
ওর এই লাইনে আসার কারণ বেশ্যাপাড়ার শ্যামলা দিদি। ওকে বলেছিলেন,"তুই কাজ চাস তাই তো? তোরে এক মাদারচোদের কাছে নিয়া যাব। ওই লোকটা হারামী হলেও ওর ধান্ধা ভালো। এই কামে পাপ নাই। পূণ্য করবি রে তুই। অনেক বড় পূণ্য। আমাগো মতো বেশ্যা-মাগী হবি না।"
ও ওদের মতো হয়নি ঠিকই। কিন্তু ও যা করে তা কি সত্যিই পূণ্য? ওর মনে হয় না। মানুষের শেষ সময়টায় ও আপন মানুষের ভঙ ধরে। ও মিথ্যে বলে।
অবশ্য মানুষের আসলে আপন বলতে কেউ নাই। উপরের বসে থাকা ঈশ্বর ও নিশ্চয়ই আপন না। এত কষ্ট যে দেয়। সে কী করে আপন হয়? বিউটির জানা নেই।
রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় ওর দিকে তাকিয়ে ফার্মেসির শিকদার ডাক্তার হাসলো।
শিকদার সাহেব লোকটা ভালো। রোগীদের সাথে তার ভালো সম্পর্ক। সবাইকে দেখলেই তিনি এমন অমায়িক ভঙ্গিতে হাসেন। বিউটির গোপন ইচ্ছা, শিকদার সাহেব যদি কেবল মাত্র তার জন্যই এমন করে হাসতেন, তার আর কিছু চাওয়ার থাকতো না।
সেবার তার নিউমোনিয়া হলো। কী কষ্ট! কী কষ্ট! সারারাত বমি হতো। আর বমির সাথে বের হতো সাদা সাদা কফ।
শিকদার সাহেব সারারাত তার পাশে বসে থাকলেন।
এই শিকদার সাহেবের পরিবারে তিনি ছাড়াও আর দু'জন সদস্য। তার স্ত্রী ও সন্তান। ভদ্রমহিলাও বেজায় ভালো মানুষ। অথচ উনাকে দেখলেই বিউটির হিংসে হয়। এমন একটা সংসার তারও কি হতে পারতো না?
ছিহ! ও জিভে কামড় দেয়। এসব কী ভাবছে সে?
আজ রইসের জন্য সে একটা চকোলেট কিনেছে। ছেলেটার বড্ড চকোলেটের শখ। অথচ যে দাম এসবের। ইচ্ছে করলেই কিনে দেয়া যায় না। তবে আজ কিছু বখশিশ পাওয়ায় সে ভালো একটা দোকান হতে চকোলেট কিনলো।
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এবং অনেক ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে সে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই কোথা হতে যেন একটা প্রাইভেট কার এসে তাকে চাপা দিয়ে চলে গেল।
আকাশ লাল হয়ে আছে। কিংবা ওর চোখ রক্তে লাল হয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না।
তার ভীষণ তৃষ্ণা পাচ্ছে। সে তার চারপাশে জমে যাওয়া ভীড়কে উদ্দেশ্যে করে বললো, "পানি! পানি!"
অথচ তারা শুনতে পেল না। বিউটির খেয়াল হলো- আসলে সে যা বলছে সবই মাথার ভেতর। মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।
তার সামনের জটলায় কেউ কেউ ওর ছবি তুলছে। কেউ আবার সামনে উবু হয়ে বসে আছে। সবার চোখেমুখে বিস্ময় কিংবা কৌতুহল।
সে আবারো চিৎকার করতে যায়। এবং তখন সেই রক্তাক্ত লাল আকাশের নিচে- সে দেখে, ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে দেখে, প্রতিটি বালুকারাশি সেই মানব-মানবীদের চলনে কম্পিত হয়। তার অনুভূত হয়, সে রাস্তা ছেড়ে বিশাল একটা মাঠে শুয়ে আছে। কোথায় সেসব মানুষ যারা তার ছবি তুলছিল? বরং তার বদলে সেসব অদ্ভুত মানবেরা সবাই তার সংস্পর্শে এসে দাঁড়ায়। এবং হঠাৎ করেই তার মনে হয়, সে এদের সবাইকে চেনে। ওরা তারা, যাদের মৃত্যুর সময় ও হাত ধরেছিল।
ওরা ধীরে ধীরে ওর হাতে হাত রাখে। কেউ বা ওর গাল স্পর্শ করে। সবার চোখেই কেমন গাঢ় বিষাদ।
এই তো, ওদিনকার সুখনও এখানে আছে। সে ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে। ওর একেবারে কাছ ঘেষে বসে। গভীর কন্ঠে ডাকে, "আমেনা!"
Talha Muntasir Nafi is a published author and a professional book cover designer. His first novel "Megher Aralee" got published in 2021. Writing is his passionate hobby and it goes way back to his childhood. He was in only fourth grade when he started writing.