প্রহেলিকা
Winner of the monthly event based on Editors' Choice (08.05.22)
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় । আম - কাঁঠালের ছুটি চলছিল। আমার বয়স তখন আট কি নয়। মা - বাবা, ছোট মামাসহ সবাই মিলে গ্রামের ঘুরতে গেলাম । দাদাভাইয়ের পুরোনো সেই জমিদার বাড়িটায়। দাদাভাই আজ নেই কিন্তু তাঁর স্মৃতিবিজড়িত সেই জমিদার বাড়িটা এখনো পড়ে আছে। এই বাড়িটা যেন তাঁর কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এখনো দাড়িয়ে আছে মুখ তুলে। রাত প্রায় আটটার দিকে আমরা গ্রামে পৌছালাম। চারদিকে বিদঘুটে অন্ধকার, পিনপতন নীরবতা। হয়তো গ্রামের সবাই যে যার দুয়ার দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। অবশ্য এই সময়টা গ্রামে মাঝরাত্রি বলা যায়। মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে কোনো মতে পথ চিনে আমরা সবাই পুরোনো সেই বাড়িটার সামনে এসে দাড়ালাম। অন্ধকারে বাড়িটাকে পাহাড়ের মতো লাগছিল। আবছা অন্ধকারে বাড়িটাকে পুরোপুরি দেখার চেষ্টা করছিলাম তখন বাবা ছাড়া গলায় ডাকলেন, ' বিনয়কাকা বিনয়কাকা শুনতে পাচ্ছেন? '
' কোথায় তোমার বিনয়কাকা? তাঁর তো এখানে থাকার কথা ছিল। কোথায় তিনি? '
' আহ! শর্মিলা। বয়স্ক মানুষ হয়তো চোখ লেগে গেছে ; ঘুমিয়ে পড়েছেন। '
মাকে থামিয়ে দিয়ে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বাবা আবার ডাকলেন, ' বিনয়কাকা। ' এই বারেও কারো সাড়া শব্দ নেই, পরিবেশ শুনশান। হিমশীতল বাতাস বইছে। চারপাশের ঝিঝি পোঁকার আওয়াজটা গায়ে কাটার মতো ফুটছে।
' কেমন আছেন বাবু? '
' মা! '
বীভৎস চিৎকার করে আমি দৌড়িয়ে মায়ের পেছন গিয়ে দাড়ালাম। লোকটা হাতে থাকা হারিকেনটা তাঁর মুখের সামনে ধরে জিগ্গেস করলেন, ' ভয় পাইছ, খোকা ?
আমি ভয়ার্ত চাহনিতে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। লোকটির মুখ লম্বাটে। চোখ দুটো তক্ষকের চোখের মতো। কোটির থেকে অনেকখানি বেরিয়ে আছে। অত্যন্ত রোগা শরীর। সরু সরু হাত। হাতের আঙুল অস্বাভাবিক লম্বা। বয়স ষাটোর্ধ। আমাকে বললেন, ' ভয় পাইও না ; তোমার বাবা আমারে চেনেন । '
বাবা আমার এক হাত ধরে লোকটার সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, ' বাচ্চা মানুষ অন্ধকারে হঠাৎ আপনাকে দেখেছে তাই একটু ভয় পেয়েছে । তা বিনয়কাকা কেমন আছেন? '
' ভালো আছি আসতে অসুবিধা হয় নাই তো? '
' জ্বী না, কোনো অসুবিধা হয়নি। আপনাকে বলেছিলাম দুটো রুম পরিষ্কার করে রাখতে তা করেছেন? '
বিনয়দাদু কিছুটা কপাল কুচকে বাবার দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ' আপনেরে তো আমি আগেই কইছি এই জায়গাটা মোটেও ভালা না। অনেকদিন হইলো এইখানে কোনো মানুষ থাকে না যারা থাকে তারা হইলো প্রেতাত্মা। '
আমি শুকনা ঢেউক গিলে বাবার হাতটা শক্ত করে ধরলাম। সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। বাবা কিছু বলতে যাবেন ঠিক তখনই ছোট মামা বললেন, ' এই যুগেও ভুতে বিশ্বাস করেন, আজব মানুষ আপনারা বলতে হবে ! '
বিনয়দাদু কঠিন চোখে মামার দিকে তাকালেন। চোখের ভাষায় বলার চেষ্টা, ' তুই কি জানোস, মুর্খ!'
' তার মানে আপনি আমার কথা মতো কিছুই করেননি? আমরা তাহলে এখন থাকব কোথায় ? '
' করছি। আপনের কথা মতো দুটো রুমই মানুষ দিয়া পরিষ্কার করাইছি। কিন্তু আমি চাই না আপনেরা এইখানে থাকেন, আপনেরা আমার বাড়িতে থাকবেন। এই জায়গাটা মোটেও ভালো না। সামনের পুকুর পাড়টাতে রাতে '
' থামুন আর কিছু বলতে হবে না। আমরা এখানেই থাকব। এখন আমাদের ভিতরে নিয়ে যান ; আমরা খুব ক্লান্ত। '
বিনয়বাবু একদৃষ্টে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পাশ থেকে মা বাবার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, ' হ্যাঁ গো উনি যখন বলছেন তখন শোন না। চল না আমরা তাঁর বাড়িতে গিয়েই থাকি। দিনের বেলায় নাহয় আসব। '
' আহ চুপ কর তো। ভুত - প্রেত বলতে কিছু নেই। ভুত - প্রেত শুধু আমাদের ঠাকুমা - ঠাকুরদাদের গল্পে আর সাহিত্যের বেঁচে আছে। এছাড়া তাদের অস্তিত্ব সর্বত্রই কাল্পনিক। '
মামা মায়ের নাজুক অবস্থা দেখে হাসলেন। রসিকতার সুরে বললেন, ' কি রে দিদি ? ভুতে - ভয় আর তোর গেল না। কেন এসেছিস বল তো এখানে, দেখিস এইবার না ভুতে তোর ঘাড় মটকায়। '
' চুপ কর , শুভ্র। সবকিছু নিয়ে রসিকতা করা ভালো না। '
বিনয়দাদু ঘুরে দাড়ালেন। হিমশীতল কন্ঠে বললেন, ' আসেন , বাবু। আমার সাথে আসেন। '
মামা আমাকে সাথে করে নিয়ে বিনয়দাদুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা শুরু করল। বাবা - মা আমাদের পিছনে। মামা বিনয়দাদুর পাশ থেকে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করল, ' এই বাড়িতে আপনি রাতের বেলাতেও থাকেন? '
তিনি প্রশ্ন শুনে কিছুটা থমকে দাঁড়ালেন। পরক্ষণেই হনহনিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। মামা বললেন, ' কি হলো বিনয়বাবু, বললেন না? '
' এই ভুতুরে বাড়িতে আমি রাইতের বেলায় থাকুম ? আমার কি নিজের জীবনের মায়া নাই ? '
' ওহ। আচ্ছা তখন যেন কি বলতে গিয়েও জামাইবাবুর জন্য বলতে পারলেন না। ওই পুকুরপাড়ের কথা। '
' হ। এই বাড়ির পিছনের দিকে যেই পুকুরটা সেইখানে রাইতের বেলায় ভুত দেখা যায়। অশ্বরীরীরা ঘুরতে থাকে চারপাশে। '
' তা আপনি দেখেছেন নিশ্চয়ই। '
' শুধু কি আমি একা গ্রামের প্রায় সবাই তো দেখছে। '
' ওহ আচ্ছা এই জন্য আপনি এই বাড়িতে থাকেন না? '
বিনয় দাদুর অচৈতন্য চাহনি । দেখে কিছুটা বিচলিত মনে হচ্ছে। খক্খকানি দিয়ে বললেন, ' এটা আপনার ঘর। '
আমরা হাঁটতে হাঁটতে কখন যে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেছি বুঝতে পারিনি। কারণটা বোধহয় ভয়। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম, ' মা, আমি মামার সাথে ঘুমাব। '
মা বাবার দিকে তাকালেন। বাবা বলল, ' ঠিক আছে। একা একা বের হবে না, কেমন? '
' আচ্ছা। '
' তোমরা ভিতরে যাও। '
আমি আর মামা আমাদের ঘরে ঢুকলাম। যেতে যেতে শুনলাম বাবা বিনয়দাদুকে বলছেন, ' আপনি আজকে এই বাড়িতেই থাকবেন ? ' তিনি বললেন, ' হ্যাঁ । বাবু, ওটা আপনেগো ঘর। আপনেরা বিশ্রাম নেন ; আমি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করি। চা খান তো? '
মাঝরাতের দিকে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। অদ্ভূত এক ধরনের শব্দ হচ্ছে। পরিচিত কোনো শব্দের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই বলে শব্দটিকে ঠিক ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। লক্ষ লক্ষ ঝিঝি পোকার আওয়াজের সাথে অন্য একটা আওয়াজ মিলিত হয়ে ভিন্ন একটা আওয়াজ তৈরি করেছে। আওয়াজটার মধ্যে ধাতব ঝংকার আছে। মনে হচ্ছে কেউ ঘুঙুর পড়ে হাঁটছে। খুব অস্বস্তিকর লাগছে। সহ্য করা যাচ্ছে না। ভয়ার্ত গলায় ছোটমামাকে ডাকলাম, ' মামা জেগে আছ? '
' ভয় পেয়েছিস?'
মামার গলার আওয়াজ প্রকট। মনে হলো ঘুমায়নি, জেগেই ছিল। বললাম, ' মামা শুন , কেমন একটা আওয়াজ হচ্ছে না? '
' হু, ঝিঝি পোকার আওয়াজ। '
' দ্বিতীয় আওয়াজটার কথা বলছি। ভালো করে শুনো। মনে হচ্ছে না কেউ ঘুঙুর পড়ে হাঁটছে ? '
' উহু, আমার মনে হচ্ছে না। তোর মনে হচ্ছে। কারণ তুই মনে মনে ঘুঙুরের আওয়াজটা কল্পনা করছিস। তাই তোর কাছে লাগছে কেউ ঘুঙুর পড়ে হাঁটছে। শব্দটার দিকে মনোযোগ দে। এটা কোনো ঘুঙুরের আওয়াজ না ইঁদুরের লাফালাফির আওয়াজ। বোধ করি উপরের তলায় অনেক ইঁদুর আছে। আর থাকাটা অস্বাভাবিক না পুরাতন একটা বাড়ি তার উপর বহুদিন হলো এই বাড়িতে কেউ থাকে না। '
আমি গভীর মনোযোগে শব্দটা শুনলাম। বুঝার চেষ্টা করলাম শব্দটা আসলে কিসের। বুঝলামও মামাকে আশ্বস্ত করে বললাম, ' ঠিক বলেছ , মামা। শব্দটা ইঁদুরের। '
' হু, অনেক রাত হয়েছে এখন ঘুমা। '
' হু। '
মামা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রফেসর। বয়স পঁয়ত্রিশ। যুক্তিবাদী মানুষ। সবকিছুই যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চান। পারেনও বটে।
কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বুঝতে পারি নি। সকালে ঘুম ভাঙল জানালার ফাঁকে আসা সূর্য রশ্মি মুখে পড়াতে। ওঠে দেখি মামা পাশে নেই। বসার ঘরে গিয়ে দেখলাম সবাই বসে চা খাচ্ছেন। বিনয়দাদুও একপাশে বসে ধোয়া উড়ানো চায়ে ফু দিচ্ছেন। আমাকে দেখেই বললেন, ' ঘুম ভাঙছে খোকা। চা খাও নাকি দুধ দিমু । '
' আমি চা পছন্দ করি। '
হেসে আমাকে চা দিলেন। কালকের বিনয়দাদু আর আজকের বিনয়দাদুর মধ্যে অনেক পার্থক্য। আমি খেয়াল করলাম গতকাল রাতে উনি খুব গম্ভীর ছিলেন। মুখে একটা রহস্যের ছাপ ছিল। মুখে একরত্তি হাসির রেশ ছিল না। আর আজকে তাঁর মুখ হাস্যজ্জ্বল। মুখে কোনো রহস্যের ছাপ নেই। কি সুন্দর সবার সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে মায়ের গা গেসে বসলাম। বিনয়দাদু আমাকে একটা সিরামিকের কাপে চা দিলেন। চায়ে ছোট একটা চুমুক দিলাম। সবাই হেসে হেসে কথা বলছেন। এইসময় মা বলল, ' কাল রাতে তোমরা কোনো আওয়াজ শুনেছ ? কাল রাতে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তখন রাত দু ' টা হবে হয়তো। অনিমেষ তো ঘুমাচ্ছিল। মনে হলো ছাদে কে যেন হাঁটছে। সাধারণ মানুষের হাঁটা নয় , পা টেনে টেনে হাঁটা। আমি ওকে ডাকলাম। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হলো না। ওর যা ঘুম ; উঠলোই না। তা বিনয়কাকা আপনি কি বলতে পারবেন ওটা কিসের শব্দ ছিল ? '
আমি লক্ষ্য করলাম, কথাটা শোনার প্রায় সাথে সাথেই বিনয় দাদুর মুখটা মলিন হয়ে গেল। তিনি ভয়ার্ত চোখে মায়ের দিকে তাকালেন। উনি হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই মামা বললেন, ' মনোবিদরা বলেন কারো মন যখন বিশেষ কোনো বিষয়ে বেশি ভাবে তখন তার চোখে সেটা ফুটে উঠতে পারে। যেমনটি ঘটে মরুভূমিতে মরিচীকা দেখার মতো। সে যদি মনে করে তার সামনে পানির ফোয়ারা বইছে তাহলে চোখের পলক ফেললেই সে তা দেখতে পারে। আবার কেউ যদি মনে করে তার পাশে কেউ আছে তাহলে মুহুর্তেই সে তাকে অনুভব করতে পারে। অর্থাৎ তার পঞ্চ ইন্দ্রিয় সে কাজে লাগাতে পারে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে মনে কর তুই ট্রেনে যাত্রা করছিস অনবরত ট্রেনের একটা শব্দ হয় নিজের ছন্দে। এবার তুই মনে মনে যেকোনো একটা ছন্দ ভাবতে থাক দেখবি তোর ছন্দে ট্রেনে আওয়াজ হচ্ছে। মানে তোর পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে তুই যেভাবে চালনা করবি ঠিক সেভাবেই চলবে কিন্তু সেটা যে আদৌ বাস্তব তা কিন্তু নয়। '
মা এতক্ষণ ভ্রু কুচকে কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করছিলেন। পরক্ষণেই নিজ মস্তিষ্কে যুক্তিগ্রাহ্য হলে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন , ' বেশ বলেছিস তো ভাই। '
বাবা চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, ' বাহ বাহ শালাবাবু দেখছি ভালোই যুক্তি দেখিয়েছে। '
সবার চোখে - মুখেই হাসি কিন্ত বিনয়বাবুর চোখ সরু। চোখ - মুখে কৌতুহলি ভাব স্পষ্ট। মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছেন। আমাকে আশ্বস্ত করে জিগ্যেস করলেন , ' তাইলে বাবু আমরা যেইডারে ভুতের আওয়াজ কই ওইডা কি তাইলে ভুতের না আমাগো মনের ভুল ? '
মামা মুচকি হাসলেন। বললেন, ' হ্যাঁ, বিনয়বাবু। আসলে ছোটবেলা থেকেই আপনারা ভুতের গল্প শুনে বড় হয়েছেন তাই মাঝরাতে শোনা যেকোনো শব্দকেই আপনাদের কাছে ভুতের শব্দ বলে মনে হয়।'
নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পেরে খুশিতে বিনয়দাদুর চোখ চকচক করে ওঠল। দীপ্তিমান নক্ষত্রের চোখ জোড়া দেখে আমার হৃদয়ে প্রশান্তির ঢেউ বয়ে গেল।
ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে নয়টা। ঘরে কেউ নেই। আমার চোখে ঘুমঘুম ভাব। তাই ভাবলাম ইজি চেয়ারে বসে পড়ব। যেই ভাবা সেই কাজ। একখানা বই নিয়ে ইজি চেয়ারে বসে হেলান দিয়েছি, সাথে সাথেই ঘরের আলো নিভে গেল। আমি ভয় পেয়ে ভুত! ভুত বলে চিৎকার করলাম। কিন্তু তখন বাইরে আলো জ্বলছিল। আবার যখন ঝুঁকলাম তখন আবার আলো জ্বলে উঠল। আমি লক্ষ্য করলাম চেয়ারের নিচে ঘরের বৈদ্যুতিক সংযোগের তারের এক অংশ ছেঁড়া অবস্থায়। যখন আমি পেছনের দিকে হেলান দেই তখন আলো নিভে যায়, আর সামনে ঝুঁকলে আলো জ্বলে ওঠে। কিছু একটা আবিষ্কার করতে পেরে নিজেকে আইনস্টাইন মনে হচ্ছিল। হঠাৎ মৃদু শব্দ করে মামা দরজা খুলল। আমি খুশিতে গদগদ হয়ে আমার আবিষ্কারের কথা মামাকে জানাতে ছুটে গেলাম। বলার জন্য যেই না মুখ খুলব ওমনি মামা বলল, ' চল একটা জিনিস দেখাই। ' এই বলে আমার হাত ধরে হাঁটা শুরু করল। আমিও ভালো ছেলের মতো মামার পায়ে পা মিলিয়ে চলা শুরু করলাম। দক্ষিণের বারান্দায় এসে আমরা দাড়ালাম। আমি লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিঃশব্দে ছেড়ে দিলাম। বাতাস বইছে না তবুও পরিবেশ বেশ ঠাণ্ডা। এইখান থেকে বিনয়দাদুর উল্লেখ করা সেই পুরাতন পুকুরটা দেখা যায়। আমি পুকুর পাড়ে তাকালাম। চারপাশে চোখ বুলাতেই কিছু রংবেরঙের আলোর উপর নজর পড়ল। কিছুটা ভয় পেলাম। কাঁপা কণ্ঠে মামাকে জিগ্যেস করলাম, মামা, এগুলো কিসের আলো? '
মামা বলল, ' ভুতের। '
মুহুর্তেই কেঁপে ওঠলাম। চিৎকারের সাড়া পরে গেল। মা, বাবা আর বিনয়দাদু ছুটে এল। মা বিচলিত হয়ে জিগ্যেস করল, ' অর্ণব কি হয়েছে ,
বাবা? ভয় পেয়েছিস ? কিসে ভয়? '
বাকিরা উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগল। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে আলোগুলোর দিকে ইশারা করলাম। মা আতকে উঠল। খুব শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
বাবা বললেন, ' এগুলো কিসের আলো? '
বিনয়দাদু ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন, ' দেখছেন বাবু কইছিলাম না এই পুকুরে ভুত আছে। বিশ্বাস করেন নাই তো দেহেন এহন নিজ চোক্ষে দেহেন। '
বাবার কপালে ভাঁজ। বোধহয় ভাবছেন সত্যিই কি এটা ভুত। মামা কিছু বলছে না। শুধু মৃদু মৃদু হাসছে। বিনয়দাদু জোরপূর্বক বললেন, ' আহেন ঘরে আহেন এইহানে থাকা সুবিধার না। কখন ওগো আমগো উপরে নজর পইড়া যায়। '
মামা বিনয়দাদুকে থামিয়ে বলল, ' দাড়ান বিনয়বাবু। সবকিছুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখা শুনলেন এই ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনবেন না? '
সবাই থমকে গেলাম। চোখ সরু করে তাকালাম। মামা বলল, ' আপনারা যেটাকে ভুত বা ভুতের আলো বলছেন সেগুলা আসলে ভুত - প্রেত্মের আলো না বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হয় আলেয়া। '
সবাই একে অপরের দিকে তাকালাম। মা বলল, ' হ্যাঁ রে, শুভ্র , আলেয়া কি রে? '
মামা আলোগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করল। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে বলল, ' আলেয়া একধরনের বায়ুমণ্ডলীয় আলো যা রাতের অন্ধকারে জলাভূমিতে বা খোলা প্রান্তরে দেখা যায়। ইংরেজি বা মার্কিন লোককাহিনীতে একে " Will- o' - the - wisp " বলে। লোক কথায় একে ভৌতিক অ্যাখ্যা দেওয়া হলেও বিজ্ঞানীরা মনে করে গাছপালা পচনের ফলে যে মার্শ গ্যাসের সৃষ্টি হয় তা থেকে আলেয়ার উৎপত্তি। আলেয়াতে থাকা ফসফরাস ডাইহাইড্রাইট গ্যাসটি বায়ুর সংস্পর্শে এলে জ্বলে ওঠে। ফলে এতে থাকা অন্যান্য গ্যাস যেমন মিথেন, ফসফিন ও একই সাথে নীল শিখাসহ জ্বলতে থাকে। বায়ুপ্রবাহের কারণে জ্বলন্ত গ্যাসটি গতিশীল হয়। এটিই হলো আলেয়া। '
সবার চোখে মুখে টানটান উত্তেজনা। দীর্ঘদিনের বিশ্বাস আজ মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে। মামা আলোগুলোর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে বিনয়দাদুর দিকে তাকালেন। বললেন, ' যদিও আলেয়া কোনো ভৌতিক ব্যাপার নয় তারপরও গ্রাম - বাংলার অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে এটি অশরীরীদের কাজ। '
' বাবু এতোদিন তাইলে আমরা ভুল জানতাম। এগুলা কিছুই না সব ভুয়া। ভুত বলতে আসলে কিছুই নাই? '
' হ্যাঁ বিনয়বাবু কিছু নেই।'
আমি দৌড়ে বিনয়দাদুর কাছে গেলাম। তার একটা হাত ধরলাম। বললাম, ' দাদু, তোমার আর ভুতে ভয় নেই তো? '
দাদু আমার সামনে হাটু গেড়ে বসে আমার দুই বাহু ধরে বললেন, ' না দাদুভাই আমার আর কোনো ভয় নাই আর বিশ্বাসও নাই। '
আমি হাসলাম। তিনি বললেন, ' তোমারে আমি দাদু ভাই কইতে পারুম তো? '
আমি মাথা নাড়লাম। তিনি স্বহাস্য হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর কিছুক্ষণ আমাদের মধ্য যে গল্প চলল সেগুলো আমার কাছে অমূল্যবান।
ঘড়ির কাটা দশটাতে গিয়ে ঠেকেছে। আমাদের ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। জড়তা স্থিতি থেকে গতিশীল হয়েছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে মুখ করে তাকালাম। বিনয় দাদু দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর অপলক দৃষ্টি। আমি হাত নেড়ে বিদায় সম্ভাষণ জানালাম। এখনো তাঁর দৃষ্টি স্থির । খুব ইচ্ছে করছিল গিয়ে বলতে, ' আসো না দাদু আমাদের সঙ্গেই নাহয় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবে। ' কিন্তু বলা হয়নি কেননা তাঁরও নিজের জন আছে , পরিবার আছে। আপন সংসারে তিনি নিজের মতো ব্যস্ত। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ট্রেন অনেক দূর এগিয়ে গেল, বিনয়দাদু চলে গেলেন দৃষ্টির বাইরে!
প্রহেলিকা ।। অনিকা আক্তার সিনথিয়া
অনিকা আক্তার সিনথিয়া তেঘরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী। তার বাড়ি কেরাণীগঞ্জ। তিনি লিখতে পছন্দ করেন।