স্বাধীনতার সংগ্রাম

  • Writer: Jannatul Tabassum Meem
  • Category: Short Story
  • Published on: Sunday, Apr 24, 2022

স্বামীহারা রমিলা মাটিতলী গ্রামের চেয়ারম্যান এর বাড়িতে ঝি এর কাজ করে । তার দুই মেয়ে বকুল ও রাবেয়া।বকুল এর বয়স ১৮ বছর ও রাবেয়া ১৫বছর এর কিশোরী।দুজনেই যেন ছেলের মত দুর্বার,সাহসী।মেয়েদেরকে নিয়ে রমিলার খুব গর্ব হয়।তারা দুজনে চার হাতে সংসারের যাবতীয় কাজ করে।রমিলা খাতুনের কোমরের ব্যামো আছে তাই বেশিরভাগ সময় বকুল রান্নাবান্না করে ও রাবেয়া ঘর পরিষ্কার করে।

 

জৈষ্ঠ্য মাসের ভ্যাপসা গরম পড়েছে।বাতাসে পাকা আমের সুগন্ধের সাথে মানুষের তাজা রক্ত ও গোলা বারুদ এর গন্ধ ভেসে আসে।কারণ দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে।মাটিতলী গ্রামের অদূরেই রয়েছে পাকবাহিনীর ক্যাম্প।লোকমুখে শোনা যায় গভীর রাতে সেখানে মানুষ হত্যা করে গাড়িতে করে নদীর পানিতে ফেলে দিয়ে যায়।সেই অজ্ঞাত লাশগুলো ঠিকানাহীন ভেসে বেড়াতে থাকে সোনাই নদীর স্বচ্ছ জলে!

চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে আজকে পাকবাহিনী দুপুরের খানাপিনা করবে।তাদের সেনা দিয়ে খবর পাঠিয়েছে। অনিচ্ছা থাকা সত্বেও চেয়ারম্যান আদর-আপ্যায়ন এর জন্য বাজারে গেলেন কেনাকাটা করতে।২০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে  আকবর উল্লাহ চেয়ারম্যান কখনো গ্রামবাসীর ক্ষতি হবে এমন কোনো কাজ করেননি।কিন্তু আজকে বাজার থেকে মাছ-মাংস কেনার সময় তার বারবার মনে হতে লাগলো তার পায়ের নিচের মাটিতে মিশে যাচ্ছে তার বাপ-দাদার দেখানো রাজনৈতিক  আদর্শ,তাদের ত্যাগ ও গ্রামবাসীর সম্মান। একবার অশ্রুসিক্ত নয়নে বাজারের মানুষের দিকে তাকিয়ে মনে মনে সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন তিনি।

 

দুপুরের আগেই চেয়ারম্যান বাড়িতে আসা আশেপাশের নারীরা রান্নাবান্নার কাজ শেষ করে সবাই নিজেদের বাড়ি গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল।এ বাড়িতে শুধু চেয়ারম্যানের বউ আসমা, দুই মেয়ে ও দুই ছেলে থাকতো।কিন্তু আজ ভয় ও আতঙ্কে আসমা বিছানায় লুটিয়ে পড়েছে।এই অবস্থায় তাকে ছেড়ে আসতেও ইচ্ছা করেনি রমিলার।তার মন অজানা ডাকে কেন জানি সাড়া দিতে থাকে।তাই ও বাড়ির মন্টুকে দিয়ে বকুল আর রাবেয়ার কাছে খবর পাঠিয়ে রাখলেন যে আজ তার আসতে দেরি হবে।

 

কিছুক্ষণ পর জিপে করে পাকবাহিনীরা অস্ত্রসহ বাড়িতে প্রবেশ করে।হরেক রকম খাবার দেখে  তারা খুবই খুশি হলেন।বাড়ির মহিলারা অন্দরমহলে থাকায় চেয়ারম্যান ও তার দুই ছেলে ও এক ভৃত্য মিলে খাবার পরিবেশন শুরু করে।সেনারা অতি তৃপ্তি সহকারে খেলেন।তাদের মাঝের একজন কমান্ডার একটা করে খাবার মুখে নেয় এবং বলে উঠে, "কেয়া বাত হ্যায়,বারিয়া বারিয়া,লা জাবাব খানা "। গোধূলির বেলায় সকল সেনারা বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকলেন।খাবারের প্রশংসায় অতি পঞ্চমুখ হয়ে থাকা সেই কমান্ডার চেয়ারম্যানকে বললেন," অওরাত কাহা হ্যায়?কিধার ছুপাকে রাখা হে?"

চেয়ারম্যান এর কলিজার পানি শুকিয়ে গেল।এই ভয়টাই তিনি পাচ্ছিলেন।এক চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সেই সেনা কর্মকর্তার পা ধরে ভিক্ষা চাইতে লাগলেন তিনি।তখনই পায়ের বুট জুতা  দিয়ে সজোরে চেয়ারম্যান এর কাধে লাত্থি মারেন কমান্ডার আব্দুল্লাহ আমির।চেয়ারম্যান এর দুই ছেলে কমান্ডার এর দিকে তেড়ে আসতেই সৈনিকরা তাদের দিকে তাক করে গুলি করতে শুরু করে।

কিছুক্ষণ পর কমান্ডারের আদেশ পেয়ে সৈনিকগুলো বাড়ির ভিতর থেকে মহিলাদের চুল ধরে টানতে টানতে গাড়িতে এনে তুলতে থাকে।কেউ কেউ হাত দিয়ে মহিলাদের শরীরে আঘাত করছিল।কেউ বেয়নেট এর মাথা দিয়ে তাদের মাথার চামড়া ছিলে দিচ্ছিল।রমিলা পালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে ধরে রাখা সেনার হাতে কামড় দিতেই সে ডান হাত দিয়ে রমিলাকে কষিয়ে চড় মারে।সবশেষে নিরুপায় আহত মহিলাদের নিয়ে তিনটি জিপ ছেড়ে যায়।শুধু উঠানে পড়ে থাকে চেয়ারম্যান ও তার ছেলেদের নিথর দেহ।ভৃত্য রাজুকেও তারা তুলে নিয়ে যায়।

এলাকাবাসীর মুখে খবর শুনে চেয়ারম্যান বাড়িতে ছুটে আসে বকুল ও রাবেয়া।তাদের বুক ফেটে পড়ে কান্নায়।রাবেয়া উঠানে চিৎকার করে গড়াগড়ি খেতে শুরু করে।আশেপাশের প্রতিবেশী সকলের মনে আতঙ্ক বিরাজ করতে থাকে কারণ যাদের একবার পাকবাহিনী নিয়ে যায় তারা আর কখনো ফিরে আসেনা।এ যেন সত্যিকারের রূপকথার গল্প!!

 

নির্ঘুম রাত কাটায় বকুল ও রাবেয়া।রমিলার ব্যবহৃত জামাকাপড় হাতে জড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাবেয়া একসময় ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।কিন্তু বকুল চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় সারিবদ্ধ ভাবে মহিলাদের আটকে রেখে ধর্ষণ করছে পাকবাহিনীরা।কেউ কেউ গুলি করে তাদের খুলি উড়িয়ে দিচ্ছে কিংবা কেউ চালাচ্ছে পাশবিক নির্যাতন।

এসব দৃশ্য কল্পনা করে বকুলের বুক কাঁপতে থাকে।হঠাৎ করেই প্রতিশোধ এর স্পৃহায় তার ভেতরে আগুনের গোলা জ্বলে উঠে।সকাল বেলা রাবেয়াকে নিয়ে খুব গোপনে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে হাজির হয় সে।সেখানকার ফৌজ সবুজ, বকুল আর রাবেয়াকে চিনতে পারে।সারা এলাকায় চেয়ারম্যান বাড়ির ঘটনার সাথে বাপমরা বকুল ও রাবেয়ার মাও যে অপহৃত হয়েছে এই গল্প সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।সবুজ তাদের কমান্ডার এর সাথে বকুল এর দেখা করায়।বকুল এর স্কুল এর প্রধানশিক্ষকই তখন সেই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার।বেশ ভালো ছাত্রী হওয়ায় তিনি আগে থেকেই বকুলকে চিনতেন।তার মায়ের খবর শুনে সে মর্মাহত কণ্ঠে বললো,"দেখ মা বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে।তোমাকে এখন সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই যে নেই আমার হাতে"বকুল দীপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,"স্যার আমি যুদ্ধ করব।আমি অনেক জায়গায় শুনেছি নারীরাও সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে।সবাই পারলে আমি কেন পারব না?

বকুল এর সাহস দেখে লতিফ স্যার এর কপাল কিঞ্চিত ভাজ হলো। কিশোরী বয়সের মেয়ের কাছে যুদ্ধে যাওয়ার আকুতি শুনবেন এটা তিনি সপ্নেও  কল্পনা করেননি।সবাই ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে কিন্তু এই মেয়ের বাড়িতে এত বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও সে যুদ্ধে আসতে চায় এটা তাকে বিস্মিত করছে।

তিনি কতগুলো কলা এনে বললেন,"এই কলাগুলোর মধ্যে বিষ মেশানো আছে।তুমি যদি বিষ মাখানো কলাগুলো পাক বাহিনীর ক্যাম্পে বিক্রি করে আসতে পারো তবেই তোমাকে আমরা যুদ্ধে নিব।"মনের মধ্যে  কিছু আশার সঞ্চার করে স্যার এর থেকে কলার ডালাটি নিল বকুল।

ছেলেদের মত ছোট চুল, আলগা দাঁড়ি,পুরনো লুঙ্গি-শার্ট পড়ে রওনা হয় বকুল।নির্ধারিত ঠিকানার কাছে এসে "কলা নিবেন কলা"বলে হাকতে থাকে সে।অধিক সাহসের জন্য তার কণ্ঠটাও একদম পুরুষের মতো শোনাচ্ছে।গেট এর সেন্ট্রি কলা দেখে আরেকজন সেন্ট্রিকে আনে।তারা একটি কলা বকুলকে খেতে বলে।পূর্ব নিশানা অনুযায়ী নির্ভেজাল একটি কলা বকুল খেতে শুরু করে।বকুলের খাওয়া শেষে তারা দেখে শুনে বেশ ভালো কয়টা কলা বেছে নিয়ে টাকা না দিয়েই বকুলকে বিদায় করে।এরপর উল্টোদিকে বহুদূর হেঁটে এসে নাচতে নাচতে ক্যাম্পে ফিরে যায় বকুল।রাতেই গোপনীয়ভাবে খবর আসে পাকবাহিনীর ১৫জন অফিসার বিষক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করেছে।

বকুলের কার্যসিদ্ধি দেখে লতিফ কমান্ডার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ।ক্যাম্পের সকলে বকুলের সাহসের  প্রশংসা করতে থাকে।পরদিনই তিনি সেক্টর কমান্ডার এর পারমিশন নিয়ে বকুলকে সম্মুখ যুদ্ধে নামানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।রাবেয়াকে লতিফ স্যার নিজের বাসায় ছেলে-মেয়েদের কাছে রেখে আসে।বকুলকে বিদায় জানাতে গিয়ে রাবেয়া কান্না জর্জরিত কণ্ঠে বলতে থাকে,"বকুল আপা,তুমি বাদে আমার তো কেউ নাই।আম্মাকে হারাইছি কিন্তু তোমাকে হারাইতে চাইনা।দেশ স্বাধীন করে আইনো যাতে আর কোনো মাকে বর্বর সেনাদের হাতে মরতে না হয়।"স্নেহ পরশে রাবেয়ার মাথায় হাত বুলায় বকুল।তার চোখে ভেসে উঠে এক টুকরো স্বাধীন বাংলাদেশ এর প্রতিছবি।

 

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অর্জিত হয় প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা।এই নয় মাসে বকুলের শরীরের নানা জায়গা ক্ষত বিক্ষত হয়।কিন্তু হেরে যায়নি তার কোমল হৃদয়।বহুদিন পর গ্রামে ফিরে আসে বকুল।নদী পার হয়ে আসতেই কোথা থেকে জানি ছুটে আসে রাবেয়া।বোনকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে,"আমরা পারছি বকুল আপা।আমরা পারছি!"

 


স্বাধীনতার সংগ্রাম  ।। জান্নাতুল তাবাসসুম মীম

জান্নাতুল তাবাসসুম মীম ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের একজন ছাত্রী। তিনি লিখতে পছন্দ করেন।