আধাঁর রাত্রির রোদেলা

  • লেখকঃ জান্নাতুল তাবাসসুম মীম
  • Category: A Short Story
  • Published on: Sunday, Apr 24, 2022

Winner of the monthly event based on Editors' Choice (28.03.22)

২রা মার্চ,২০০৩ সাল।


অন্তরা বেগম প্রসববেদনায় ছটফট করছেন।পাশে উদ্বিগ্ন অবস্থায় তার মা সালমা বানু ক্রামাগত পাখা দিয়ে বাতাস করছে।একজন দাই অবস্থা বেগতিক দেখে সালমা বানু কে বললেন,"আম্মা অবস্থা ভালো না উনারে হাসপাতালে নেন"।এই শুনে কিছুক্ষণ পর হন্তদন্ত হয়ে অন্তরা বেগমের বাবা রিক্সা নিয়ে আসলেন।অন্তঃসত্ত্বা মা কে সবাই কষ্ট করে রিক্সায় উঠিয়ে জেলা মাতৃসদন এর উদ্দেশ্য রওনা হলেন।রিকশায় সালমা বানু কেঁদে কেঁদে  বারবার দুরুদ শরিফ পাঠ করছে যেন নবাগত সন্তান ও অন্তঃসত্ত্বা দুজনেই যেন ভালো থাকে। আল্লাহ যেন রহমতের সহিত তার একমাত্র মেয়েটির জীবনে  আরেকটি জীবন এর উদ্ভব ঘটান।


হাসপাতালে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর বাড়ির সকলেই সেখানে উপস্থিত হন।সালমা বানু নিরবে কাঁদছে। তার একটাই মেয়ে। সেই মেয়ের প্রসব বেদনার কাতরতা যেন বুকে তীর হয়ে বিঁধছে।অন্তরার বাবা আলতাফ সাহেব স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য তার পাশে গিয়ে দাঁড়ান।সালমা বানুর কাঁধে হাত রাখতেই সালমা মুখ তুলে জিজ্ঞেস করেন,"জামাইরে খবর দিছো?"আলতাফ উদ্দিন মাথা নেড়ে বলে," হুম দিছি তো সকালবেলা।এতক্ষণে হাসপাতাল এর কাছাকাছি এসে পরছে।"


সামনে হেঁটে যাওয়া রুবিনা কে দেখে চমকে উঠে আলতাফ উদ্দিন।এ তো তার দুঃসম্পর্কের  জ্যাঠাতো ভাই এর মেয়ে রুবিনা।এই হাসপাতালেরই মহিলা ডাক্তার!


আলতাফ উদ্দিন এর মত তার ভাই ভুল করেননি।মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছে,উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। এখন সে এই হাসপাতালে চাকরী করে। তার আফসোস হয় ইশ যদি অন্তরা কে অল্পবয়সে বিয়ে না দিয়ে পড়াশোনাটা করাতো।!মেয়েটার তো ইচ্ছাশক্তি ছিল বড় হওয়ার।কেনই যে তার কথা না শুনে বয়সে ১৫ বছরের বড় ছেলের সাথে বিয়েটা দিল।সেইসময় অন্তরার বিয়ে না দিলে আজ বোধহয় রুবিনার মত সেও বড় কোথাও চাকরী করতে পারতো!


আলতাফ উদ্দিন কে দেখে চিনতে পারে রুবিনা।হাসিমুখ করে এসে বলে,"আসসালামু ওয়ালাইকুম চাচা।আপনারা চিন্তা করবেন না। অন্তরার কিছু হবে না।বড় স্যার ভিতরে আছেন,আমিও যাচ্ছি ভিতরে।আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।"রুবিনার হাত ধরে সালমা বেগম কেঁদে উঠে।রুবিনাও তাকে সান্ত্বনা দিয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকে।


কিছুক্ষণ পর নবজাতক এর কান্নার শব্দ পেয়ে সকলের দেহে প্রাণের সঞ্চার হয়।।রুবিনা নবজাতককে কোলে করে এনে আলতাফ সাহেব এর কাছে দিয়ে বলেন,"চাচা মিষ্টি খাওয়ান আপনার নাতনি হয়েছে।"নিজের হাতে সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের ন্যায় নাতনিকে দেখে বিশ্বাস করতে পারেন না আলতাফ সাহেব।এ যেন রক্তে মাংসে গড়া ছোট্ট একটি রাঙা পুতুল।ডাগর ডাগর চোখ,পাপড়ির মতো রাঙা ঠোঁট।নাক টা অন্তরার মত ছোট।


আলতাফ সাহেব এর হাত থেকে সালমা বেগম হাতে নেন।তিনি সন্তান দেখেই বলে উঠেন,"মা শা আল্লাহ।আল্লাহর কাছে যা চেয়েছিলাম তার থেকেও বেশি দিয়েছেন,শোকর আলহামদুলিল্লাহ। 


হাসপাতাল থেকে একটু দূরে মিষ্টি কিনতে যায় আলতাফ সাহেব।হাতে দুই কেজি মিষ্টি এনে গেট দিয়ে ঢোকার সময় দেখে অন্তরার স্বামী মনির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে।কৌতুহল দমাতে না পেরে আলতাফ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,"এ কী বাবা। এখানে কী করছো?আমার নাতনিকে দেখতে যাওনি?"


মনির হাত থেকে সিগারেট এর অবশিষ্ট অংশটুকু নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষতে পিষতে বললো,"দেখেছি আব্বা।"এরপর আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে অন্যদিকে হেঁটে চলে গেল।


আলতাফ সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন জামাই এর এরকম আচরণে।উপরে উঠে জানতে পারলেন অন্তরাকে বেডে দেওয়া হয়েছে।সেই বেডের কাছে গিয়ে দেখতে পেলেন বাড়ির সকলেই মুখ ভার করে বসে আছে।অন্তরার কোলে ফুটফুটে শিশুটি।অন্তরার চোখের পানিতে শিশুটির গালও ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে।কিছুটা এগোতেই সালমা বানু উঠে এসে ধীর গলায় বললো,"জামাই মন খারাপ করেছে মেয়ে হয়েছে জন্য।"


আলতাফ সাহেবের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। পরীর মত সন্তান কে দেখে কীভাবে একজন জন্মদাতা মুখ ফিরিয়ে নেয়?আগুন এর স্ফুলিঙ্গ তার শরীরের বেড়ে উঠছে এরকম অনুভূতির সাথে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন অন্তরাকে আর সংসার করাবেন না ওখানে কিন্তু পরক্ষণেই লোকলজ্জা, সামাজিক পদমর্যাদা এবং "লোকে কী বলবে" এই কথা ভেবে চুপসে যান তিনি।


হসপিটালের বেডও অন্তরার অশ্রুজলে সিক্ত।সন্তান হলে মায়ের চোখ দিয়ে খুশির অনবরত অশ্রু ঝরে,কিন্তু তার চোখ দিয়ে কষ্টের অশ্রু ঝরছে।আল্লাহ কেন ছেলে সন্তান পাঠালো না?নিজ কন্যা সন্তানকে যেন গর্ভের কলঙ্ক মনে হচ্ছে তার!

 

দিনে দিনে স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়িতেও কটু কথার শিকার হন অন্তরা!ভুল এর মাসুল দিতে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন এর শিকারও হন তিনি।সবাই যেন আঙুলে  দিয়ে বুঝাতে চায় কন্যা সন্তান জন্ম দেয়াটা একটি গুরুপাপ!নিজেও একজন  নারী হয়ে শাশুড়ীর এমন কুরুচিপূর্ণ আচরণে অন্তরা স্কুল জীবনে পড়ে আসা কাজী নজরুল ইসলামের সেই উক্তিটির স্মৃতিচারণ করে,"আমরা সবাই পাপী, আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি।"

 

১৮ বছর পর,২০২১ সাল,


দীর্ঘদিন করোনাক্রান্তি কালে ঘরবন্দী বহু মানুষ।চাকরী হারিয়েছেন প্রায় দেড় কোটি মানুষ।তাদের মধ্যে একজন মনির সাহেব।তার বয়স আজ তেতাল্লিশ বছর।করোনার প্রথম বছরেই চলে গেছে তার অল্প বেতনের বেসরকারি চাকরী ।৪জন সদস্য সংখ্যা বিশিষ্ট পরিবারকে নিয়ে খুব হিমশিমেই  পড়তে হয়েছিল তাকে।কিন্তু আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘে অন্ধের নড়ির মতো পরিবারের হাল ধরলো বড় মেয়ে রোদেলা।তার বয়স আজ ১৮ বছর।লকডাউনের বন্দী জীবনে সে বাসাতেই অনলাইন ফুড ডেলিভারি শপ খুলেছে।সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার কর্মব্যস্ততা।বার্গার,স্যান্ডউইচ,পিজ্জা কি নেই তার রান্নাঘরে!৩ মাসের মধ্যেই লাখপতি হয়ে গেল সে।জমে থাকা বাড়িভাড়া,বাবার অ্যাজমার ওষুধ, মায়ের হাতখরচ,বোনের স্কুলের বেতন সবকিছুই এখন তার অর্জিত টাকা দিয়েই হয়।অ্যাডমিশন টেস্টে সে দেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে।কিছুদিন পর তার ক্লাস শুরু হবে।রোদেলা  ভার্সিটিতে চলে গেলে তার অনলাইন শপ এর হাল ধরবে ছোট মেয়ে বর্ষা ও অন্তরা বেগম।দিন রাত ছোট মেয়েটি বড় আপুর থেকে খাবার বানানো,ডেলিভারি এসব পর্যবেক্ষণ করে।দূর থেকে দুই বোনের রন্ধনশিল্প  দেখতে ভালোই লাগে মনির সাহেবের।চোখ বন্ধ করে ১৮ বছর আগের সেই দিনটির কথা মনে হলে মনের অজান্তেই চোখে জল আসে তার।আজ তার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর-শ্বাশুড়ি কেউই বেঁচে নেই।কন্যা সন্তানকে পাপ মনে করা তার আপন মাও বেঁচে নেই পৃথিবীতে।মনির সাহেব এখন বুঝতে পারে নারী-পুরুষ সব সমান।একজন পুরুষ যা পারে ঠিক সেইরকম স্বাধীনতা ও সুযোগ একজন নারীকে দেয়া হলে একই কাজ নারীও পারবে।তারা কখনোই আমাদের নিরাশ করবে না।বরংচ পুরুষদের থেকেও নারীরা মেধাশক্তি,কর্মস্পৃহায় এগিয়ে যেতে পারবে।

 

পাশের বাড়িতে রহমান সাহেবের নাতনি হয়েছে,আজকে মুখেভাত অনুষ্ঠান।রোদেলার কিনে দেয়া লাল পাঞ্জাবিটা পড়ে মনির সাহেব সদর দরজা খুললো।আজ তার বড়ই খুশি লাগছে।নতুন কন্যা সন্তানকে মন ভরে দোয়া করে আসবে যাতে কোন নারী শুধুমাত্র নারী পরিচয় নয় মানুষ পরিচয়ে পরিচিত হতে পারে।






আধাঁর রাত্রির রোদেলা ।। জান্নাতুল তাবাসসুম মীম

জান্নাতুল তাবাসসুম মীম ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের একজন ছাত্রী। তিনি লিখতে পছন্দ করেন।