ফানুস
ঘড়ির কাটার টিক টিক আওয়াজ বাদে তখন প্রায় সবই নিশ্চুপ আর বাহিরে কই থেকে যেন ক্ষীণ এক গানের আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে অবশ্য, ঠিক কোন গান তা বোঝার উপায় নেই। বাসার সবাই এতক্ষণে ঘুমে বোঘোর। শুধু জেগে আছপ আশা। এতক্ষণ জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল, কি যেন ভাবছিল। এতক্ষণ অবশ্য কখনো জেগেও থাকে না সে, তবে আজ একটা বিশেষ কাজ করতেই যেন জেগে আছে। একটু হাতে কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়লো টেবিলে। আবার কিছুক্ষণ ভাবলো, তারপর টেবিলের একপাশে থাকা মোমবাতির ক্ষীণ আলোতেই গোটা গোটা অক্ষরে লিখতে বসে পড়লো,,,
“ প্রিয় রুহি,
আশা করি ভালো আছিস। যদিও আমি জানি তুই ভালোই আছিস, আমার কাছে থেকে তো ছুটি পেয়েছিস তাই আর কি,, হিহি, মানে আমি নাই যে তোর সাথে,, ”
এইটুকু লিখে আবার কি মনে করে একটু থামলো, নিজের মনেই খানিকটা হেসে উঠলো, তারপর কি মনে করে কেটে দিলো ২য় লাইনটি, ধূর!! পুরো পৃষ্ঠাটাই তো নষ্ট করে ফেললো!! কতদিন পর চিঠি লিখছে অথচ কি হাবিজাবি লাইন দিয়েই না শুরু করলো! নাহ, এটা হবে না ভেবে পৃষ্ঠা মুড়ে রেখে আরেকটা পৃষ্ঠা বের করলো। একটু ভেবে চিন্তে লিখতে হবে। আচ্ছা এই চিঠি তো ও কখনো পাবেই না, তবে এই নাটক করার মানে কি! চিঠি লেখারই বা মানে কি!! এর থেকে বেশ একটা ঘুম দিতে গেলেই পারে এই ভেবে পৃষ্ঠা ফেলে চেয়ার থেকে উঠতেই গেল, আবার কি মনে করে চেয়ারে বসে পড়লো, যেন কেউ মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে, আজ তাকে চিঠি লিখতেই হবে। সামনের জানালার দিকে তাকাতেই আকাশের উজ্জ্বল তারাটি নজরে এল,,, স্মৃতিগুলোও যেন মনে পড়ে গেল, হেহ! মানুষ মারা গেলে নাকি ওই তারা হয়ে যায়!! কথাটি বলেছিল রুহি, আর তা মনে পড়তেই নিজের মনে আবার হেসে উঠলো, কি উদ্ভট কথাবার্তা!! হা হা! ওর উদ্ভট কর্মকান্ডের অবশ্য শেষও নেই। এই যে অদ্ভূত এই চিঠিটি লিখতে বসেছিল, এটাও তো ওর অদ্ভুত আবিষ্কার, যার উদ্ভোদন সেদিন, চলে যাওয়ার আগের দিন করলো। বেশ মনে আছে কথা গুলো। সে বলছিল, “ আশা আপু, আমি তো কালই চলে যাচ্ছি। ( মনে হচ্ছিল একটু আগেও কেঁদে এসেছে) আর হয়তো দেখা হবে না আমাদের ” তখন হাসতে হাসতেই এক ধমক দিয়ে আশা বলেছিল, “ ন্যাকামি করবি না তো আমার সামনে। চলে গেলে চলে যাবি। ” অবশ্য এতে রুহি বেশী মন খারাপ করেনি সেদিন বরং এটাই ওর কাছে স্বাভাবিক ছিল, এরকমেরই অভ্যেস আছে ওর,, এত ধমক, পঁচানি খাওয়ার পরও তো এই আশা আপুকে ছাড়া চলতো না ওর! কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার রুহি একটু আগ্রহের সাথেই বলে উঠেছিল, “ আশা আপুউউউ!! পেয়েছি। শোনো আমাদের এখন যেহেতু প্রতিদিন দেখা হবে না, তাই আমরা চিঠি লিখবো, অবশ্য প্রতিদিন না তবে বছরের এই শেষ দিন, এই শেষ দিন যেদিন আমরা শেষ এইভাবে কথা বলছি এই ৩১ ডিসেম্বর। ”
- আর চিঠি লিখে করবো টা কি? (বেশ তাচ্ছিল্য সহকারে অন্য দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল আশা)
- তারপর যে কি করবো, তারও একটা চমৎকার আইডিয়া আছে আমার!! শোনো তারপর একটা ফানুস আনবো আর ওই চিঠিটাকে প্লেন আকারে বানিয়ে ফানুস আর ওই প্লেন একসাথে উড়িয়ে দিবো। জোস আইডিয়া না?
- তোর মাথা থেকেই এগুলো আসবে। চিঠি এমনে পাঠালে জীবনেও তোর কাছে যাবে?
- জানি যাবে না, তবুও এতটুকু তো জানি যে তুমি চিঠি লিখেছিলে, হিহি। আর চিঠিতে একটা প্রশ্ন রাখবে হ্যা বা না দিয়ে যার উত্তর দেওয়া যায় আর যা তুমি আমার কাছে থেকে জানতে চাও। আর চিঠি উড়িয়ে দেওয়ার পর যদি দেখো আরও একটা ফানুস উড়া শুরু করেছে তবে ধরে নিবে উত্তর হ্যা।
এই বলে একটা চওড়া হাসি দিলো। যদিও এই কথা শুনে আশা সেদিন হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছিল তবে রুহি মোটেও হাসছিল না, বরং আশা যখন বলে উঠলো, “ এসব আজগুবি কাজে আমি নেই। তুই লিখলে লিখিস গিয়ে যা ভাগ এখন, পড়তে হবে! ” তখন যেন রুহি খুশি হয়েই বলেছিল, “ আমি কিন্তু অবশ্যই লিখবো, মনে রেখো। ” এই ছিল চিঠির কাহিনী। আশ্চর্য্য এসব ভাবতে ভাবতেই কখন চোখের পানি চলে এল খেয়ালই করলো না আশা। সেদিন অবশ্য শেষ দেখা ছিল না ওদের। ওর দু'মাস পরেই আবার রুহিরা আশাদের বাসায় এসেছিল। তারা অন্য জায়গায় স্থায়ী হয়ে গেছে, তাই বলতে এসেছিল আর শেষ বারের মতো সব প্রতিবেশীদের দেখতে এসেছিল। দু'মাসেই আশা অবশ্য রুহির অনুপস্থিতি বেশ টের পেয়ে গিয়েছিল, তবুও সে স্বীকার করতো না, যেন নিজেই নিজের আবেগের সাথে খেলা করতো, নিজের সাথেই অভিনয় করতো! সেই দু'মাস পর আবার রুহিকে দেখে আশার থেকে খুশি হয়তো কেউ হয় নি, তবে তার হাবভাব যেন উল্টা কিছুই বুঝালো! রুহি ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই আশার কাছে দৌড়ে গিয়েছিল, “ আপুউউউ, কেমন আছো???”
- হুমম ভালোই আছি, তুই?
- আপু এতদিন ভালো ছিলাম না তবে আজ অনেক খুশি!
- আচ্ছা শোন তোরা যাওয়ার পর আমার পুতুলের দোলনা টা পাচ্ছি না,, মনে হয় নিয়ে গেছিস। কত প্রিয় ছিল আমার!
- কিন্তু আমার কাছে তো নেই আপু ওটা।
হটাৎ যেন রুহির মন টা অন্য রকম হয়ে গেল, এতদিন পর এল ও অথচ এই তুচ্ছ বিষয়টাই আগে মনে পড়লো! তবুও আবার বলতে লাগলো
-আপু জানো নতুন স্কুলে,,
- চুপ কর না তুই,, কালকে আমার পরীক্ষা। আর শোন পরের বার এলে দোলনা নিয়ে আসিস।
রুহির খুব ইচ্ছে করছিল যেন সেখানেই কেঁদে দেয়, কেন এমন করে আশা আপু! সব সময় তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে হবে তাকে! আর কোনো কথা বলতে মন চাচ্ছিল না তার অথচ কত কথাই না এই দু'মাসে জমে ছিল,আশা আপুকে বলার মতো! শেষে শুধু বলে গিয়েছিল, “ আচ্ছা আপু আমি আসি, আম্মুরা এখনই চলে যাবে, তোমার দোলনা পেলে নিয়ে আসবোনি, আর তোমাকে চিঠি লিখবোনি। ” এই বলে দ্রুত রুম থেকে যেন দৌড় দিতে পারলে বাচেঁ।
এরপর আর দেখা হয়নি, আর এরপর ৯ টা বছর চলে গেল! আর তখন ওদের ঠিকানাও রাখা হয়নি, আর ফোন নাম্বারটাও আগেই হারিয়েছে। এসব মনে করতেই চোখের পানির বাধ যেন ভেঙে পড়েছে আশার। এত কান্না আসছে কেন! কই কোনো খারাপ স্মৃতি তো নেই সবই তো ছোটবেলার যত আনন্দময় স্মৃতি, এই তো ঘর ঘর খেলতো, পুতুল খেলতো, কত খেলাই না আবিষ্কার করতো দু'জনে মিলে। একসাথেই তো বেড়ে উঠেছিল, ছোটবেলার যত রঙিন স্মৃতি নিয়ে। যেহেতু মনে পড়ছে স্মৃতিগুলো তবে আনন্দ কেন পাচ্ছে না! কষ্ট কেন লাগছে তার? আজ প্রায় ৯ বছর পরও তার কথা ভূলেনি, এই ৯ বছরে যেই কাজটি করেনি তা আজ করবে বলেই ভেবেছিল। আজ সেই চিঠিটা লিখবে, হুমম লিখতেই হবে তাকে।
এরপর শুধু রাত গভীরের দিকে যেতে লাগলো, মোমবাতির আলো আরও ক্ষীণ হতে লাগলো, মুড়িয়ে রাখা কাগজের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো। আর আশা যেন কোন এক ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে চিঠি লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বেশ অনেকক্ষণ পর নিচে টা ঠিক করে লিখল
“ ইতি,
তোমার প্রিয় আশা আপুউউ ”
তো, এতক্ষণে যেন মন মতো কিছু একটা লিখতে পেরেছে, কিন্তু চিঠিতে তো শুধু একটি লাইনই লেখা, “ আমাকে মনে আছে?”
১ টা বাজতে নিবে, ততক্ষণে আশাদের বাসার সব ঘুমে । আশা চুপচাপ ড্রয়ারটা খুললো, ইশশ! ড্রয়ারটা বেশ পুরনো তাই খ্যাঁচ করে এক শব্দ করে উঠলো, কেউ শুনে ফেলেনি তো! যাক তার আর এসব ভেবে কাজ নেই, হয়তো কেউ শোনেনি। তারপর ফানুসটা বের করে নিল,অনেক দিন আগে থেকেই একটা কিনে রেখে দিয়েছিল ফানুসটা। প্রায় নিঃশব্দে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল, বেশ! কোনো শব্দ হয়নি তেমন। হাতের মোমবাতিটি প্রায় নিভু নিভু অবস্থা। তাদের বাসার উপর তলাতেই ছাঁদ। সিড়িটা বেশ অন্ধকার, একটু যেন ভয়ও করছিল, ভূতের! রাতে তো নাকি ছাঁদে ভূতও থাকে, তবে কি বাসায় চলে আসবে সে! ইশশশ কেনই যে এসব করছে না! কিছুক্ষণ ভেবে আবার একটু দাড়িয়ে পড়লো, আবার নিজের মনেই হেসে উঠলো, বাহ রে ভূতের এই আজগুবি কাহিনীও তো ওই রুহির বানানো। নাহ একবার যেহেতু চিঠিটা লিখেই ফেলেছে আজ উড়িয়েই দিবে। ছাঁদে যেন সিড়ির একদম বিপরীত পরিবেশ, বেশ আলো, চাঁদ থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে, আজ পূর্ণিমা কি না কে জানে! তবে পুরো গোলই তো লাগছে চাঁদটাকে !! ফানুস টা ঠিক করে নিল, একটু অন্যরকম লাগছিল তার, নিজে একলা কখনো ফানুস উড়ায়নি যে। প্রায় নিভে যাওয়া মোমবাতিটি থেকে আগুন লাগাতে লাগলো। তারপর ফানুসটি উড়িয়ে দিল,, হুমম এবার প্লেনটি, হিহি। হাস্যকর কাজ,, কখনো ভাবেও নাই সে এগুলো করবে! ফানুসটিকে চমৎকার লাগছে দেখতে, প্লেনটি হাতে নিয়ে আরেকবার নেড়ে নিল। কেন যেন এখন হটাৎ ভয় করছে! চিঠি উড়ানোর পর যদি অন্য ফানুস না উড়ে? তাহলে তো এর মানে ওর মনে নেই তাকে, তার আশা আপুকে! বাহ রে মনে রাখবেই বা কেন! এমন অত্যাচারই না করতো ওর সাথে, এখন নিশ্চয়ই ওর খুব ভালো আর মিষ্টি মিষ্টি বন্ধু আছে।তবুও তাকে ভূলে যাবে? এ ভাবা যায়! ধূর আবার আশা হেসে উঠলো কি সব ভাবছে সে। হটাৎ হটাৎ হাসছে হটাৎ আবার কেদেঁও উঠছে, কি হয়েছে তার! তারপর সবকিছু ভাবা বাদ দিয়ে প্লেনটি উড়িয়ে দিল। ওইতো প্লেন উড়ে গেল, গাছটার ওপাশে চলে গেল।
কিছু সেকেন্ড কেটে গেল, কিন্তু আশার কাছে মনে হচ্ছে যেন অনেক অনেক সময় চলে যাচ্ছে, একটু পরেই সকাল হয়ে যাবে, রাতই তো শেষ হয়ে যাবে, কই কোনো ফানুস তো দেখছে না? হটাৎ দূর থেকে যেন একটা আলোর বিন্দু দেখতে পেল, আরেহ আরেকটা দেখতে পেল, ওই যে আরও আছে তো! কিছুক্ষণ পর পুরো আকাশ ভরে উঠলো বিন্দু বিন্দু আলোতে!! আশা ততক্ষণে বুঝতে পেরেছে এই সবই নতুন বছর আগমনের উৎযাপন এর জন্য, তবুও তার শরীরে যেন আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল, অন্য শিহরণ শুরু হলো, তার কাছে মনে হতে লাগলো যে তার চিঠির উত্তর হ্যা!!! রুহি তাকে এখনো মনে রেখেছে!! সে এখনো তাকে ভূলে যায়নি! সেই ঠিকানা বিহীন চিঠিটা যেন ঠিক গন্তব্যেই পৌছে গেছে। এতগুলো আলোর বিন্দু যেন তাই চিৎকার করে বলে যাচ্ছে। হয়তো কোনো এক কোণায় বসে রুহিও এই আলোর বিন্দু গুলো দেখছে আর প্রাণ খুলে হাসছে!
ফানুস ।। Rokea Begum
রোকেয়া বেগম বিএএফ শাহীন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর একজন ছাত্রী। তার বাড়ি পশ্চিম ভাষানটেক, ঢাকা ক্যান্ট।