Movie Review: মনপুরা (Monpura)
পরিচিতিঃ
নামঃ মনপুরা (Monpura)
পরিচালক রচয়িতা, চিত্রনাট্যকারঃ গিয়াসউদ্দিন সেলিম
প্রযোজকঃ অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু
সম্পাদক, সংগীত পরিচালকঃ ইকবাল আহসান কবির
সুরকার ও গীতিকারঃ মোহাম্মদ ওসমান খান | কৃষ্ণকলি ইসলাম | গিয়াস উদ্দিন সেলিম
চিত্রগ্রাহকঃ কামরুল হাসান খসরু
পরিবেশকঃ মাছরাঙ্গা প্রোডাকশন
মুক্তিঃ ১৩ ফেব্রুয়ারি,২০০৯
দৈর্ঘ্যঃ ১৩৮ মিনিট
দেশঃ বাংলাদেশ
ভাষাঃ বাংলা
আইএমডিবি রেটিংঃ ৮.৭/১০
বিএমডিবি রেটিংঃ ৮.৫/১০
দর্শক জনপ্রিয়তা রেটিংঃ ৪.৯/৫
ব্যক্তিগত রেটিংঃ ৯.৪/১০
মনপুরার বিস্তৃতিঃ
ঘটনা শুরু হয় বৃষ্টি আর বিদ্যুৎ চমকানো দিয়ে। অঝরে বৃষ্টি পড়ছে। পরক্ষণেই দেখা যায় এক নারীর লাশ। পাশেই এক পুরুষ।
নারীর খুনের জন্য পুলিশ কেস হয়। খুনী মাতব্বর গাজীর পাগল ছেলে হালিম। হালিমকে বাঁচানোর জন্য গাজী নিজের স্বার্থে তাদের বাড়ির কাজের ছেলে সোনাইয়ের উপর খুনের দায় চাপিয়ে দেয়।
তারপর পুলিশের হাত থেকে বাচানোর জন্য তাকে 'মনপুরা' নামে এক দ্বীপে নির্বাসন দেয়। গাজী সাহেব মাঝে মাঝে ট্রলারে করে ছাগল, হাস,মুরগি এনে দিয়ে যায় সোনাইয়ের কাছে। সোনাই দ্বীপে একটা ঘর বেঁধে থাকে। কিন্তু কিছুদিন যেতেই তার একাকীত্ব বোধ হতে শুরু করে এবং মানুষ না পেয়ে ময়না, ছাগল, হাঁস, মুরগীর সাথে কথা বলতে থাকে। এভাবে দিন চলে যায়।
হঠাৎ একদিন জেলে নৌকা দেখতে পেয়ে দৌড়ে যায় সোনাই। সেই নৌকাতে মাছ ধরছিল পরী আর তার বাবা। সময়ের সাথে সাথে পরী আর সোনাইয়ের মাঝে ভাবের বিনিময় হয়,ভালোলাগা ধীরে ধীরে ভালোবাসাতে পরিনত হয়। কিন্তু পরীর বাবা অর্থের লোভে ধনীর ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়। যেটা মেনে নিতে পারে না সোনাই, পরী আর ঐ 'মনপুরা' দ্বীপ।
পরী আর সোনাই ঠিক করে তারা পালিয়ে যাবে।
সোনাই নদী সাতরিয়ে পার হবার পর পুলিশ তাকে ধরে জেলে নিয়ে যায়। অন্যদিকে সোনাইয়ের আশায় পথ চেয়ে বসে থাকা পরীকে নিরুপায় হয়ে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়।
কিন্তু বিয়ের পরে এক রাতের বেলা পরী বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। জেল থেকে ফিরে সোনাই গাজী সাহেবের বাড়ি গিয়ে পরীর খোঁজ করে জানতে পারে যে সে আত্মহত্যা করেছে।
এরপর একটা গানের সাথে সোনাইয়ের কল্পনায় পরী আসে এবং সিনেমা সমাপ্ত হয়।
চরিত্র ও অভিনয়ঃ
চঞ্চল চৌধুরী - সোনাই
'মনপুরা'র জন্য চঞ্চলকে সোনাই করে তোলা পরিচালক ও অভিনেতা, কারোর জন্যই সহজ ছিল না, অথচ কাজটি চঞ্চল চৌধুরী করতে সক্ষম হয়েছেন দারুণভাবে। এ কথা অনায়াসেই বলা যায়, 'মনপুরা'র সোনাই এখন পর্যন্ত চঞ্চল চৌধুরীর সেরা অভিনয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার অভিনয় ছিল তাকিয়ে থাকার মতোই।
ফারহানা মিলি - পরী
নায়িকা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও পরিচালক যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন এবং ফারহানা মিলি পরী চরিত্রটির জন্য যথাযথ ছিলেন। সিনেমায় তার মোহনীয় ঘোর থেকে বের হওয়া সত্যিকার অর্থেই অসম্ভব। তার সুগোল, শান্ত মুখটি 'মনপুরা'র বাতাবরণের সাথে মিলেমিশে গেছে। যদিও তার অভিনয় থেকে শহুরে গন্ধ একদম উবে যায় নি, তবুও তাকে গ্রহণ করে নিতে বেগ পেতে হয় নি। যতদিন আমাদের মধ্যে শ্বাশ্বত প্রেমের আবেগ বর্তমান থাকবে আর সেখানে এমন একটি প্রেমিকার বিয়োগ, আমাদের ব্যথিত না করে পারবে না।
মামুনুর রশীদ - গাজী ও ফজলুর রহমান বাবু - হাকিম মাঝি (তারা পরীক্ষিত অভিনেতা। তাদের অভিনয় বরাবরের মতোই অসাধারণ ছিল।)
মনির খান শিমুল - হালিম
পাগল চরিত্রে মনির খান শিমুলের অভিনয় কিছুটা খাপছাড়া ছিল। এখানে তার পাগলামো পাগলের হয়নি বরং অভিনেতা শিমুলের হয়েছে আর তিনি যে চরিত্রটির সাথে সফলভাবে মানিয়ে নিতে পেরেছেন, তা আংশিক সফল, অনেকাংশেই অসফল।
সংগীত ও প্রচারণাঃ
রিভিউ পুরোপুরি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি 'মনপুরা'র গানের কথা উল্লিখিত না হয়।সিনেমার প্রতিটি গান এখনো লোকমুখে ঘুরে অনবরত।
সিনেমার গানগুলোর মধ্যে 'নিথুয়া পাথারে', 'যাও পাখি বলো তারে', 'আগে যদি জানতাম রে বন্ধু', 'সোনাই হায় হায় রে' প্রত্যেকটি গানই দর্শক মহলে বহুল জনপ্রিয়।
সিনেমাটির জন্য ফজলুর রহমান বাবু, চঞ্চল চৌধুরী, মমতাজ, অর্ণব, কৃষ্ণকলি, চন্দনা মজুমদারের মতো কণ্ঠশিল্পী কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন।
সিনেমার প্রতিটি গানই হৃদয়স্পর্শী ছিল যার ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের মুখ পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিল। সিনেমার ছন্দময় গানগুলো চলচ্চিত্র মুক্তির পূর্বে ব্যাপক প্রচার করা হয়, ফলে চলচ্চিত্র লাভজনক হতে অনেক সাহায্য করে। এটি ক্যাবল এবং স্যাটেলাইট টিভি নেটওয়ার্কে ব্যাপক প্রচার করা হয়েছিল।এছাড়াও এর ডিভিডি এবং ভিসিডি ২০০৯ এর ডিসেম্বরে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল লেজার ভিশনের ব্যানারে।
অর্জনঃ
২০০৯ সালের সেরা ব্যবসা সফল ছবি ছিল 'মনপুরা'
৩৪ তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, শ্রেষ্ঠ খল অভিনেতা, শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার সহ মোট ৫টি বিভাগে পুরস্কৃত হয়।
১২ তম মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতা ও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতা (সমালোচক) বিভাগে পুরস্কৃত হয়। পাশাপাশি আরো ৫টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিলেন 'মনপুরা'র সংশ্লিষ্টরা।
পুনর্নির্মাণঃ
পশ্চিম বাংলার বা টালিউডের অঞ্জন দাশ ২০১০ সালে অচিন পাখি নামে এই চলচ্চিত্রটি পুনরায় তৈরি করেন। যেখানে অভিনয় করেন সুব্রত দত্ত, মোনালি দে, বরুণ চক্রবর্তী প্রমুখ।
লোকেশনঃ
'মনপুরা'র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকগুলোর একটি হলো এর লোকেশন নির্বাচন। লোকেশন হিসেবে এই সিনেমা ও কাহিনীর জন্য 'মনপুরা' কেবল অসাধারণ নয়, বরং এর চেয়ে ভাল লোকেশন বোধ করি এই সিনেমার জন্য খুঁজে পাওয়া দুরুহের। আর এখানেও প্রশংসা পরিচালকের জন্যই বরাদ্দ, কেন না তিনি 'মনপুরা'র জন্য সত্যিকারের এক নৈসর্গিক লোকেশন নির্ধারণ করেছেন, যা একদিকে যেমন কাহিনীর দাবী পূরণ করেছে, তেমন আবহমান গ্রাম-বাংলার চিরাচরিত রূপকে অনেক বেশি বিস্তৃত করে তুলেছে সিনেমার পটভূমিতে, যার জন্য মুগ্ধতাই বরাদ্দ কেবল। এক কথায় 'মনপুরা'র সামগ্রিক যে চিত্রায়ণ অথবা যেভাবে 'মনপুরা'র দৃশ্যাবলী আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে, তেমনটা খুব বেশি দেখা যায় বলে মনে পড়ে না।
সিনেমাটোগ্রাফি ও প্রোডাকশনঃ
একদম শুরুর দৃশ্য থেকেই 'মনপুরা' তার চিত্রায়ণে মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছে এবং সমগ্র সিনেমা জুড়েই তা ক্রমশঃ ব্যপ্ত ও বিস্তৃত হতে হতে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, একটি সিনেমার চিত্রায়ণ কোন পর্যায়ে উন্নীত হলে তা বিশ্বমানের হয়ে উঠে। নিতান্তই গতানুগতিক কিংবা সাধারণ মানের একটি গল্পের পরও মনপুরা দর্শকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবার ক্ষেত্রে এর শুরুর দুটি অধ্যায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে এবং দর্শককে কাহিনীর সাথে একাত্ম হতে সহায়তা করেছে। সিনেমাটোগ্রাফির আদর্শ মাত্রা স্পষ্ট ছিল পুরো সময় জুড়েই।কাহিনী, পরিচালনা, সম্পাদনা, সংগীত, সংলাপ, চিত্রায়ণ যে কোনো দিকেই বেশ ভালো ছিল 'মনপুরা'।
সিনেমার লক্ষণীয় দিকসমূহঃ
- সিনেমায় যে দৃশ্যগুলো আমাদের দেখানো হয়েছে বা বলা হয়েছে, যেভাবে দেখানো হয়েছে, তাতে আমাদের বুদ্ধিমত্তা আপনা-আপনি ক্রিয়া শুরু করে তাতে আপনি কাহিনির সাথে একাত্ত হতে বাধ্য।
- কাহিনির গভীরতায় একদম শুরু থেকেই 'মনপুরা' আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয় সোনাইয়ের সাথে সাথে 'মনপুরা'য় গমন করতে ও কাহিনীর গতির সাথে সাবলীল হয়ে উঠতে।
- 'মনপুরা'র নৈসর্গিক যে দৃশ্যাবলী তা এমনিতেও মনোহর, তবে তাকে অনবদ্য করে তোলার দায়িত্বে চিত্রগ্রাহকের সফলতা আপনাকে স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতে দেবে না।
- 'মনপুরা' সিনেমার রোমান্টিক দৃশ্যগুলো খুব মোলায়েম ও সাবধানতার সাথে শ্যুট করা হয়েছে, যেখানে রোমান্টিক আবেগের বাড়াবাড়ি নেই বললেই চলে, যেন সবকিছুই সেখানে স্বর্গীয়, সুন্দর, নির্মল ও বিশুদ্ধ।
- 'মনপুরা'র সুন্দর হয়ে উঠার পরিসর ছিল ব্যাপক আর সেই বিশাল পরিসরের দিকে পরিচালক আমাদের টেনে নিয়ে গেছেন সুষম গতিতে। কেউ-ই আসলে টের পাবেনা 'মনপুরা'র নদীটি কোন সে মাদকতায় আমরা সাঁতরে পার হয়ে এসেছি সোনাইয়ের সাথে সাথে।
পরিসমাপ্তিঃ
আমাদের দেশিয় সিনেমার যে চিরকালীন প্রেক্ষাপট, 'মনপুরা' তার বলিষ্ঠ রিপ্রেজেন্টেশন।সিনেমার গল্পটা অসাধারণ। সেই সাথে প্রতিটা চরিত্রই ছিল অমায়িক। তাই মুভিপ্রেমীদের কাছেও এই ছবিটি একটি সোনার খনি হিসেবেই বিবেচিত হয়। 'মনপুরা'র মতো একটি কমপ্লিট সিনেমা, যা কেবল দেশিয় পরিমন্ডলেই নয় বরং আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের সিনেমা শিল্পকে নেতৃত্ব দিতে পারে, দৃঢ়ভাবে।
মনপুরা নিয়ে প্রশংসা এজন্যই আরও অধিক কেননা, সিনেমাটিকে দর্শক গ্রহণ করে নি, বরং সিনেমাটিই দর্শককে বাধ্য করেছে তা গ্রহণ করতে আর শুধুমাত্র তা করেই সিনেমাটি ক্ষান্ত থাকে নি, দর্শককে অবলীলায় এর বাতাবরণে টেনে এনেছে মন্ত্রমুগ্ধের মতো।
Movie Review: মনপুরা (Monpura) || সুলতান রওনক
সুলতান রওনক নটরডেম কলেজের একজন শিক্ষার্থী। তিনি বিভিন্ন ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন ও সৃজনশীলতা চর্চার অভিপ্রায় থেকেই পাঠ্যক্রমের বাইরের কিছু করার প্রচেষ্টা করেন।