একটি নেউলের গল্প

  • Writer: Md Fahad Hossain Fahim
  • Category: A Short Story
  • Published on: Saturday, Feb 12, 2022

পঙ্কিল প্রান্তর ওকে ডাকে। ও চলে যায় সন্তর্পণে। ধানখেতের থ্যাবড়া আল থেকে দেখে পাঁচটি জিপ গাড়ি ও তিনটি ট্রাক প্রবেশ করেছে গ্রামে। ট্রাক ভর্তি মিলিটারির বহর। জিপ গাড়ি দেখে নিজেকে খুব সৌভাগ্যশালী মনে করে ও। দেশে যুদ্ধ লাগাতে ওর মনে একধরনের আনন্দের লহরি বইছে। কারণ যুদ্ধ না লাগলে এতগুলো গাড়ি দেখার সৌভাগ্য ওর হত না। আঁটে ঘাটে ঝড়ো কাকের আশঙ্কা থাকলেও, ওর মনে খুব আনন্দ। খুশি হয়ে আইল দিয়ে হাটঁতে হাটঁতে বলতে থাকে - 'বড় বড় টেসকি, আমি জিপ গাড়ি দেসকি।' এর আগেও একবার আল্লাদে আটখান হয়েছিল ও। এরকম জিপ গাড়ি দেখেই। সেদিন জিপ গাড়ি দেখতে গিয়ে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়েছিল ওকে। সমরকেন্দ্র এখান থেকে অনেক দূর। কিন্তু আজকে যে জিপ গাড়ি নিজে থেকেই চলে এসেছে ওর গায়ে। তাই জিপ গাড়ির আগমনকে ওর কাছে মনে হয় শাপে বর। গান গাইতে গাইতে বিজন পথ ধরে হাঁটতে লাগে। যতদূর দৃষ্টি যায় সবকিছুই ওর। সবুজ মাঠ, শান্ত নদী, নীলচে আকাশ, দূরের পাহাড়, সারি সারি কড়ই গাছ, ধবল বকের আস্তানা, মরণসাগর দিঘি; হাড়হদ্দ সবকিছুই ওর। কিন্তু একি! আকাশের বুকে ধোঁয়ার শামিয়ানা! আগুন লাগলো কোথায়? এগুতেই দেখে বাজারে আগুন জ্বলছে মাছের আড়তে। কিন্তু আগুন কোথা থেকে এলো! ও বুঝে না। মরণসাগর দিঘি থেকে জল এনে ও একাই আগুন নেবানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু পারে না। গ্রামের আর সব মানুষ কোথায় গেলো! নিভৃতে ভাবতে লাগে ও। সরগরম মাছের আড়ত নিমিষেই যেন নির্জীব হয়ে পড়েছে। আশেপাশে কেউই নেই। এদিকে মাছের আড়তের আগুনের তেজ ভীষণ, মরণসাগরের জল এ আগুনের কাছে বড়োই তুচ্ছ; যেমনটা পাকিস্তানি মিলিটারিদের কাছে গ্রামবাসী। কিন্তু হার মানে না ও। দিনকে রাত করে বস্তা বস্তা বালি আর মরণসাগরের জলে ঠিকই আগুন নিভিয়ে ফেলে ও। তবে আকাশের নীল হাসি দেখার সুযোগ ওর হলো না। আগুন নেভাতে নেভাতে সন্ধ্যার ধূসর শামিয়ানায় আবৃত হয়ে গেছে ওর আকাশ।


অনেকটা ক্লান্তি এসে ভর করলেও জিপ দেখার আনন্দের কাছে মার খেয়ে যায় ওর শ্ৰান্তি ও অবসাদ। কিছুক্ষণ পর হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে গুরমি কাকির কাছে। এসেই ডাকাবুকো ভাব নিয়ে জোর গলায় বলতে লাগে, 'ও কাকি, আছো নাকি? পান্তা দেও, পান্তা খামু।' গুরমি কাকির উদবিগ্ন চাইনি দেখে ও জিজ্ঞেস করে, 'কি অইছে কাকি? পান্তা নাই।' কাকি ওর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বলে, 'শুন মানিক। মিলিটারি আইছে গ্রামে। বাজারে আগুন দিছে। যারে পাইসে তারেই ধরে নিছে। বড় গলায় কতা কইছ না আর।' কাকির চোখে চেয়ে ও বলে, 'কথা কইতাম না কেন। এইডা তো আমাগো গেরাম।' উচ্চরবে ও বলতে থাকে- 'বড় বড় টেসকি, আমাগো গেরামে দেসকি।' গুরমি কাকি টেসকির কথা জিজ্ঞেস করতেই ও বলে, 'মুদিবাড়ির রাস্তা দিয়া যাইতে দেকসি। তারপর আমি খেতের মধ্য দিয়ে ঘুরে এসে দেখি বাজারে আগুন। আমিই আগুন নিভাইছি কাকি।' বর্ষীয়সী গুরমি কাকি ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,' তুই নিভাইসত। সত্যি কইতাছোস মানিক।' 'হো কাকি। আমিই নিভাইছি।' 'আয় তোরে পান্তা দেই।' ও প্রাণ ভরে পান্তা খায়। আর বলতে থাকে একাই দক্ষিণ হস্ত হয়ে কিভাবে মরণসাগর দিঘি থেকে জল এনে নিভিয়েছে বাজারের আগুন। গুরমি কাকিকে আগুনের কথা জিজ্ঞেস করতেই বলে, 'ঐযে জিপ  ট্রাকের মিলিটারিরাই দিছে। হেরা নাকি ভিনদেশের লোক, পাকিস্তানি বাহিনী। এরা চায় এ দেশও পাকিস্তান অউক। চেয়ারম্যান সহ মিলিটারিরা আক্রমণ করছে গ্রামে।' একথা শুনতেই ওর ছোট্ট মনে জিপ দেখার আনন্দটা মাটি হয়ে যায়। হিয়ার কোয়াড্রেটে শুরু হয় দেশপ্রেমের ডামাডোল। কারণ জিপ দেখার আনন্দের চেয়ে ওর কাছে গ্রামের শান্তি বড়। ও বুঝে গেছে জিপে করে যারা এসেছে তারা ভালো মানুষ না। শত্রু, তারা, এ গায়ের শত্রু। শত্রু, তারা, এ দেশের শত্রু।

ও খেয়াল করে গ্রামে জিপ গাড়ি আসার পর থেকেই গ্রামটা কেমন যেন নিবৃত্ত স্তব্ধ হয়ে গেছে। মানুষের আনাগোনা কমে গেছে। দুই একটা দোকান ছাড়া বাজারে আর দোকানগুলো বন্ধই থাকে। তা-ও দোকানে লাগানো থাকে জবরজং সাইনবোর্ড। কি যেন লিখে রাখা আছে তাতে। ও ঠিক পড়তে পারে না। তবে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগানের মতোই কিছু একটা লেখা রয়েছে তাতে। অনেক দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অনেক বাড়িঘরও। এর আগেও একবার আগুন দেখেছে ও। তখন খুব ছোট ছিল। গায়ে বল ছিল না। তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করবার শক্তি ওর ছিল না সেদিন। বাবা মা ভাইবোন সবাইকে একরাতে হারিয়ে সেদিন থেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়ে ও। তখন ওর বয়স মাত্র ছয় বছর। শোনা যায়  স্টেশনের ট্রেন থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল ওদের বস্তিতে। বেঁচে গিয়েছিল ও। সেদিন যদি ও আজকের মতো বড় হতো, তাহলে হয়তো মরতে হতো না ওর বাবা মা ভাইবোনকে। সেদিন কাউকেই ও বাঁচাতে পারেনি। কিন্তু গ্রামে আবার মৃত্যু নামুক, কেউ মারা যাক, এরকম কিছু আর চায় না ও।

কয়েকমাস আগে গ্রামের চেয়ারম্যান মান্নান মোল্লার ছেলেকে সাপের হাত থেকে রক্ষা করেছিল ও। ঠিক নেউল যেভাবে সাপের দেহকে ক্ষত বিক্ষত করে দেয়, তেমনি। পাঁচটা সাপকে সেদিন একাই প্রাণে মেরেছিল ও।  মা বাবা মারা যাবার পর ভয় কি জিনিস তা ও জানে না। আর সেদিনের ঘটনার পর থেকে গ্রামের মানুষ ওকে নেউল হিসেবেই চিনে। নেউলের মতো বিষের সন্ধানে নবিউল ও সিদ্ধ হস্ত। তাই মায়ের দেওয়া নবিউল নামের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে নেউল নামটি। গুরমি কাকি ছাড়া সবাই ওকে নেউলই ডাকে। গুরমি কাকিও ওর মতো। স্বামী সন্তান মারা গেছে বস্তির আগুনে জ্বলসে। ট্রেনের পাশের বস্তিতেই ওরা থাকতো। সেদিনই মরে সাবাড় হয়ে গেছে গায়ের অর্ধেক লোক।

খিদে পেলে কাকির পান্তা দিয়ে ওর দিব্যি চলে। গাছের বরই, নারকেল, কামরাঙ্গা, বনের মিষ্টি কলা, স্কুলের টিউবয়েলের জল, মানিক চাচার চা বিস্কুট দিয়েই কেটে যায় ওর বেলা। আড়তদার শিবু ভাই খুব পছন্দ করে ওকে। প্রায়ই শিবু ভাই ওকে চিংড়ি পোড়া খেতে দেয়। চাঁদনি রাতে ও বলে, 'চাঁদের আলো না খেলে আমার পেট ভরে না।' চাঁদের আলো’ও কি খাওয়া যায়? ও নাকি প্রতি চাঁদনি রাতেই চাঁদের আলো খায়। শুধু চাঁদের আলোই না। সূর্যের আলোও পান করে ও। কিন্তু কিভাবে? মৌকে ও শিখিয়েছে কিভাবে আলো পান করতে হয়। কিন্তু মৌ নাকি এখনো রপ্ত করতে পারেনি সেই কৌশল। মৌকে ও বলেছিল, দেশ স্বাধীন হলে ওকে নিয়ে চাঁদের আলো পান করবে।

মান্নান চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে মাহিন। ওর সমবয়সী। গ্রামের অদূরে  সমরকেন্দ্রে বলী খেলা দেখার সময় মাহিনকে সাপের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল ও। সেদিনই পায়ে হেঁটে নবিউল গিয়েছিল জিপ গাড়ি দেখতে। ঐতিহ্যবাহী এই খেলা দেখতে খোদ মিলিটারির দলপতি আশরাফ সাহেবও এসেছিলেন সেদিন। করাচির মানুষ। খুব লম্বা, চওড়া, শক্তিশালী। ও শুনেছে সেই মিলিটারিরাই নাকি দখল করেছে ওদের গ্রাম।


বিকেল বেলা ও হাঁটতে থাকে বনের পথ ধরে। এর আগে কয়েকবার স্কুলের মিলিটারি ক্যাম্পে গিয়েছিল ও। ওর কলা খেয়ে পাকিস্তানি এক সৈনিক বলেছিল - 'বহুত আচ্ছা। বহুত মিঠা হে।' ও মানে বোঝে না। রাজাকার বাহিনীর একজন ওকে বলে প্রতিদিন এসে কলা খাওয়াতে। বয়সে ছোট মানুষ। তেরোতে পা দিয়েছে এবার। তাই মিলিটারি ও রাজাকার বাহিনী ওর উপর সন্দেহ করে না। ও নেহাতই  চুনোপুঁটি ওদের কাছে। তাছাড়া সবাই জানে ও পাগল ছেলে। তাই ওকে নিয়ে কারোরই মাথা ব্যাথা নেই। বনের পথ বন্ধুর, দুর্গম রাস্তা। আলের পর আল পাড় হয়ে নদী। তারপর বন। তাই ঐ পথে কেউ যায় না। কিন্তু ও যায়। কলা খেতে। মিলিটারিদের জন কলা আনতে। বন্য কলা। সময় অসময়ে পেকে ঝুলে পড়ে গাছের শরীরে। মিষ্টি কলা, সাগরকলা। বনের ভেতর বাঁশ ঝাড়ের নিচে চোখ পড়তেই ও খেয়াল করে বন্দুক হাতে গোল করে বসে আছে দশ বারোজন। ও চুপিচুপি এগুতেই দেখতে পায় শিবু ভাই, সাথে আরও অনেকে। শিবু ভাই, শিবু ভাই  বলে চিৎকার করে ওঠে ও। এতোদিনে ও বুঝে গিয়েছে গ্রামের মানুষ দুই দলে বিভক্ত। এক দল ভালো, যারা যুদ্ধ করে লুকিয়ে লুকিয়ে। এরা মুক্তিযোদ্ধা। আরেকদল পাকিস্তানি বাহিনী। এ দলে আছে মিলিটারি, রাজাকার আর রাজাকার প্রধান চেয়ারম্যান মান্নান মোল্লা। শিবু ভাইকে দেখেই ও জিজ্ঞেস করে, 'তুমি কি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিসো ভাই?' শিবু ভাই কিছু না বলে ওকে চলে যেতে বলে। ও চলে যায়। এদিকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা অপেক্ষা করছে ওর জন্য, কখন কলা নিয়ে আসবে। কিন্তু ওকে খালি হাতে ফিরতে দেখে এক মিলিটারি বলে উঠে - 'কেলে কাহা হ্যায়? তুম খালি হাত কিও?' ও বুঝে না কিছুই। তবুও বলতে থাকে, 'কলা নেই। শেষ হয়ে গেছে।' রাজাকার শাফি ওর ঘাড়ে জোরে চেপে ধরে বলে, 'শুয়োরের বাচ্চা একটা গুলি করে খুলি উড়ায় দিমু। কলা আনোস নাই কেন।' ও কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, 'কলা এখনো পাকে নাই। তাই ফিরা আইসি।' ছাড়া পেয়ে এক দৌড়ে ও ফিরে আসে বনের মধ্যে। লুকিয়ে লুকিয়ে শুনতে থাকে শিবু ভাইয়ের কথা। কথা শুনে ও বুঝতে পারে, গ্রামে চারটা মিলিটারি ক্যাম্প ছিল। এখান একটা। এ গ্রামে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার শিবু ভাই। তিনটা ক্যাম্পে ইতোমধ্যে তারা আক্রমণ করে সবকিছু শেষ করে ফেলেছে। তাই সেদিন বাজারের সবকিছু পুড়িয়ে ফেলেছিল মিলিটারিরা। ধরেও নিয়ে গেছে যাকে পেয়েছে সামনে। মেরেও ফেলেছে অনেককেই।

ও সামনে গিয়ে শিবু ভাইকে বলে, 'এই দেহো হেরা কত মারছে আমারে। আমিও তুমাগো লগে যুদ্ধ করমু ভাই। আমারে তুমাগো দলে নাও।' শিবু ভাই প্রথমে ওকে নিতে মানা করলেও অলি ভাইয়ের অনুরোধে ওকে দলে নিয়ে নেয়। অলি ভাই বলে, 'সেদিন যখন মিলিটারিরা বাজারে আগুন দিয়ে চলে যায়, আমি পুকুরে কচুরিপানায় লুকিয়ে ছিলাম। আমি দেখেছি কিভাবে ও আগুন নিভানোর কাজ করছিল। ও পারবে। ওকে দলে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।' অবশেষে শিবু ভাই বলে, 'ঠিক আছে। তুই আমাগো লগেই থাকবি। আর এর বাইরে কেউ যেন এ ব্যাপারে কিছু জানতে না পারে। তুই যুদ্ধ করবি না। তুই আমাদের জন্য পানি আনবি, ফল নিয়ে আসবি... ' ও খুশি হয়, জিপ গাড়ি দেখার চেয়েও বেশি খুশি আর সৌভাগ্যবান মনে করে নিজেকে।

সন্ধ্যায় মুক্তিবাহিনী প্ল্যান করে আগামীকাল আক্রমণ করবে মিলিটারি ক্যাম্পে। কিন্তু কিভাবে? ওদের সব রাস্তাই এখন বন্ধ। আগের তিনটা ক্যাম্পের সব মিলিটারি মারা যাওয়াতে এবার বেশ শক্ত হয়ে গেছে এরা৷ নতুন সৈন্য, অস্ত্র, বোমা, গাড়ি নিয়ে এসেছে শহর থেকে। এ পর্যন্ত দু'শ জন মুক্তিযোদ্ধাও মারা গেছে। গুম হয়েছে অনেকেই। বেঁচে আছে ওরা কয়েকজন। একদিকে মিলিটারি অন্যদিকে রাজাকার বাহিনী। ওরা কি পারবে? চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে শিবু ভাই। পেছন থেকে নবিউল বলে উঠে, 'একটা কাম করোন যায়। হেরা কলা খাইতে পছন্দ করে। কলার মধ্যে বন্য গাছের বিষ মিশায় দিলে.....' শিবু ভাই চমকে উঠে বলে,' তুই পারবি?' ও বলে, 'পারবো বৈকি।'

শুরু হয় ওদের অপারেশন 'জয়বাংলা'।
হাসতে হাসতে এক গাউর কলা নিয়ে ক্যাম্পে গিয়ে মিলিটারিদেরকে বলে, 'এই নাও, তুমাগো লইগ্যা নিয়া আইছি। অনেক মিষ্টি।' কলা রেখে ও চলে যায়। যেমন প্ল্যান তেমন কাজ। কলা খেয়ে পাঁচজন মিলিটারি বিষক্রিয়ায় মারা পড়ে রাতের মধ্যেই। এমন কায়দায় কলার মধ্যে বিষ মিশিয়েছে বাইরে থেকে বুঝার কোনো উপায় নেই। মিলিটারিরাও বুঝে গেছে সবই ওর কাজ। তাই হন্যে হয়ে ওরা খুঁজতে থাকে ওকে। কিন্তু ওকে আর কে পায়! ওর মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা, যেদিন ও পাঁচটা সাপকে মেরেছিল। সেদিনের মতো আজকেও নিজেকে নেউল ভাবতে লাগে। ও নেউল হলে পাকিস্তানিরা সাপ, বিষাক্ত সাপ। ও পাকিস্তানি মিলিটারিদের সাপই ভাবতে লাগে। আর মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে নেউল হয়ে পাকিস্তানি সাপের বাহিনীকে চিরতরে শেষ করে দেবে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না, চেয়ারম্যান সহ গায়ের অনেক লোক কেন পাকিস্তানের দলে। এরা কি চায়! এরা কি দেশকে ভালোবাসে না?

দশ দিন পর মৌয়ের সাথে ওর দেখা হয় বনের রাস্তায়। এতোদিন শিবু ভাইয়ের সাথে ট্রেনিং এ ছিল ও। পাশের গ্রামে দেখা গণকবরের কথা ও মৌকে বলে। মৌ ওকে বলে- 'নেউলরে আমি মায়ের সাথে চলে যাচ্ছি মামার বাইত। তুই সাবধানে থাকিস৷ দেশ স্বাধীন হলে তোরে নিয়া চান্দের আলো পান করমু।' মৌ ওকে এও জানায়ঃ 'আমি আর চেয়ারম্যান কাকার মেয়ে মিলি রাতে ঘুমাইতেছিলাম। মিলিটারির সেনাপ্রধান হঠাৎ দরজার কড়া নাড়তেই, আমরা ভয় পেয়ে যাই। দরজা খুলতেই মাতাল মিলিটারি আমাদের কাছে আসতে লাগে। আমি কোন রকমে বাইরে বের হয়ে পড়ি। মিলিকে বাঁচাতে চেয়ারম্যান কাকা গেলে তাকেও মেরে ফেলা হয়। মিলির জীবন নষ্ট করে মিলি মাহিনকেও মেরে ফেলে ওরা।'

চেয়ারম্যানের কথা ভাবতেই ও বলে উঠে,  'দেশের শত্রু যারা অয়, হেগর পরিণতি বোধহয় এইরহমই।' কিন্তু ওর কষ্ট হয় মাহিনের জন্য, মিলির জন্য। মিলির মতো কত মেয়ে এভাবে সর্বস্ব হারিয়েছে! কষ্ট ফেটে যায় ওর বুকটা। মৌকে এগিয়ে দিয়ে ও একাই হাঁটতে থাকে আল ধরে।স্বপ্ন দেখে স্বাধীন দেশে মৌকে নিয়ে চাঁদের আলো পান করছে। কেউ থাকবে না ওদেরকে বাঁধা দেওয়ার। ফিরে পাবে ও স্বাধীনতা।

হঠাৎই পেছন থেকে রাজাকার শফি ওকে ধরে ফেলে। নিয়ে যায় মিলিটারি ক্যাম্পে। নিয়ে যাবার সময় ওর পায়ে কাচ বিঁধে যায়। হাত পা বেঁধে ওকে রাখা হয় ক্যাম্পের এক কোণায়। সবাই মিলে ঠিক করে, সকালেই মেরে ফেলবে ওকে। মিলিটারিরা বলতে থাকে - 'একদিন সাব লোক মারেগা। সাবকো, সাব লোক।' ও কিছুই বুঝে না। গভীর রাত। ছটফট করতে লাগে। পা থেকে অঝোরে বের হচ্ছে রক্ত। ওর মনে পড়ে মায়ের কথা, বাবার কথা, শিবু ভাইয়ের কথা, মৌয়ের কথা, গুরমি কাকির কথা। ও দেখে পাশেই একটা নেউল যুদ্ধ করছে সাপের সাথে। তিনটি সাপকে মেরে বনের দিকে রওনা করছে নেউলটা। চাঁদের আলোতে সবকিছু খুব স্পষ্ট দেখেছে ও। কোনরকমে দড়ি কামড়ে হাতটা ছাড়িয়ে পা থেকে কাচ বের করে সেই কাচ দিয়ে পায়ের বাঁধন খুলে ফেলে ও। শিবু ভাই ওকে শিখিয়েছে কিভাবে পিস্তল চালাতে হয়। ঘুমিয়ে থাকা এক মিলিটারির পিস্তল নিয়ে গুলি চালাতে শুরু করে দেয়।

এদিকে গভীর রাতে ওকে বাঁচাতে শুরু হয় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ। ও একাই পাঁচটা পাকিস্তানি সাপকে মেরে ফেলে। শুরু হয় তুমুল লড়াই। এক পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী ওকে আক্রমণ করলে ও ঝাপ দেয় মরণসাগর দিঘিতে। দীর্ঘ লড়াই শেষে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনে মুক্তিবাহিনীর দল। রাজাকার বাহিনী, মিলিটারি বাহিনী সব খতম। পড়ে আছে পাকিস্তানি সাপেদের নিস্পন্দ দেহ। জয় বাংলা ধ্বনির সাথে সাথে সবার মুখে একটাই প্রশ্ন- 'নেউল কোথায়?' ফজরের আজানের সাথে সাথে ওরা শুনতে পায় নেউলের শেষ শব্দটুকু- 'যুদ্ধ আমি করসি, স্বাধীন দেশ দেকসি; যুদ্ধ আমি করসি, স্বাধীন দেশ দেকসি।' মরণসাগরের জল লাল হয়ে গেছে ওর রক্তে। দিঘির কচুরিপানার ওপর মুমূর্ষ হয়ে পড়ে আছে ও৷ ভোরের আলো পৃথিবীকে যতই আছন্ন করতে থাকে, ততই নিঃশেষ হতে থাকে ওর প্রাণ বায়ু। নিভু নিভু চাঁদ ওকে দেখে বলে উঠে, 'দেখেছি আমি শহিদ নেউলের হাসি, স্বাধীন বাংলাকে বড়োই ভালোবাসি।'

 

 

 

 

একটি নেউলের গল্প || মোঃ ফাহাদ হোসেন ফাহিম

মোঃ ফাহাদ হোসেন ফাহিম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন অনুষদের একজন শিক্ষার্থী। তিনি লেখালিখি করতে পছন্দ করেন।