নারী জীবনের সংজ্ঞা
সন্ধ্যার আকাশে যখন মেঘ এসে হানা দেয়, কিছুসময় বারান্দায় দাড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। নিস্তব্ধ এক পরিবেশ। নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে উকি দেয় ফেলে আসা কিছু স্মৃতি। আমার ছোট ছেলেটি যখন পাশে এসে হাতটি ধরে দাড়ায় মূহুর্তেই আমি ফিরে যাই স্মৃতির ডায়েরির একেবারে প্রথম অধ্যায়ে যেখানে আমিও একদিন ঠিক আমার এই ছোট বাচ্চাটির মতোই ছিলাম। বাবা মায়ের ঠিক মাঝখানে শুয়ে গল্প শুনতাম। কখনো বাবা গল্প শোনাতো কখনো আবার মা। কতটা পথ পেছনে ফেলে এসেছি। ভাবলেই চোখে যেন বৃষ্টি ঝড়ে। চোখের সবটুকু জল বিসর্জন দিয়েও যদি সেই দিনগুলো ফিরে পাওয়া যেত তবে আজ তাই দিতাম।
আচ্ছা এই বৃষ্টি কি আমাকে চেনে?
কেন চিনবেনা!
বাবার বুকে শুয়ে যখন গল্প শুনতাম এই বৃষ্টিও তো জানালার পাশে এসে টুপটাপ করে গল্প শোনাতো। তাহলে বৃষ্টি কি আমার জীবনের সংজ্ঞা জানে?
আসলে জীবনের কোনো সংজ্ঞা নেই, নেই তার কোনো রং। ব্যতিক্রম শুধু প্রতিটি মেয়ের জীবন। বাবার বুকে বসে খেলা করা মেয়েটি একদিন অন্যের ঘরে চলে যায়। মানুষ যত সুখেই থাকুক না কেন কিছু স্মৃতি তার পিছু ছাড়েনা। বাস্তবতা এই যে, ছেলেদের চাইতেও মেয়েরা বাবা-মায়ের স্মৃতি অনেক বেশি আগলে রাখে। জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না এসব নিয়েই আমাদের জীবন। আমরা আমাদের জীবনে কতটুকু পেয়েছি তার হিসাব নিকাশ করতে-করতে জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাই। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা মেয়েরা সারাটা জীবন ধরে অন্যকে খুশি রাখার চেষ্টা করি। কখনো নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পাইনা। শিশুকালে মা-বাবার সাথে কাটানোর পর পড়াশোনার গন্ডি না পেরোতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। মা-বাবা সব সময় মেয়েদের নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা করেন এটাই স্বাভাবিক।
বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি চলে যায়। শুরু হয় তার এক নতুন জীবন। তারপর প্রতিযোগিতায় নামতে হয় মানুষের মন জয় করার। অনেক প্রতিযোগিতায় মানুষ প্রথম স্থান পেলেও এই মন জয় করার প্রতিযোগিতায় বেশিরভাগ মেয়েরা সবার শেষেই থেকেছে। কারণ মানুষের মন জয় করা অনেক কঠিন একটা বিষয়। তারপরও আমরা মেয়েরা স্বপ্ন দেখি। জীবন থেকে মরণ পর্যন্ত আমরা চেষ্টা করে যাই। আমরা যখন মা হই তখন সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি তাকে বড় করার, তাকে মানুষের মতো করার কিন্তু পিতা-মাতার এই সংগ্রামী জীবনের কথা তারা কতটুকু মনে রাখবে তা মনের মাঝে প্রশ্ন হয়েই থেকে যায়।
আজ হঠাৎ হাজেরা ম্যাডামের সেই প্রশ্নটার কথা মনে পড়ে গেল। তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ম্যাডাম আমাকে পুর্বেই চিনতো তাই বেশিরভাগ প্রশ্ন আমাকেই করতো। ম্যাডাম একদিন জিজ্ঞাসা করে বসলেন বলো তো জীবন মানে কি? আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম আর মৃদু হাসলাম। আমি ভাবলাম জীবনের আবার আলাদা কোনো সংজ্ঞা হয় নাকি! আমি বলে উঠলাম ম্যাডাম আমার জানা নেই। তিনি বললেন এখন এটি না জানারই কথা। তবে যখন বড় হবে, অন্যের বাড়িতে যাবে, ছেলেমেয়ে মানুষ করার সংগ্রামের মধ্য লিপ্ত হবে সেদিন নিজে থেকেই বুঝতে পারবে জীবন মানে কি?
আজ প্রতিনিয়তই শেখার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু নির্দিষ্ট করে জীবনের সংজ্ঞা শেখা হয়ে উঠলো না। যখন কোনো কারনে মন খারাপ হয় তখন ভাবি পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষটি হয়তো আমি তবে ছেলেকে স্কুলে নেয়ার সময় যখন গাড়ির সামনে এসে কোনো ছোট শিশু হাত পেতে বলে 'আজ সকালে কিছু খাইনি' তখন আমার ধারনা পাল্টে যায়। আজ মনে বড় ইচ্ছে জাগে আবার কলেজে যাই, আবার ম্যাডাম আমাকে জীবনের সংজ্ঞা জিজ্ঞাসা করুক আমি হাজারো সংজ্ঞা তাকে বলতে পারবো কিন্তু সময় আমাকে আর সেই সুযোগটি দেয়নি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কলম আর চালাতে পারছিনা কারন আমি একজন নারী। পুরুষের ব্যস্ততা দেখা গেলেও নারীর ব্যস্ততা অনেকে অনুভবও করতে পারেনা। নারীর হাতের কলম বন্ধ হলেও মনের কলম চলে আজীবন। এভাবেই একজন নারী খুঁজে ফেরে তার নারী জীবনের সংজ্ঞা। হয়তো আজকের এই লেখা পুরোটাই বৃথা যাবে যদি আগামীকাল নতুন কোনো জীবনের সংজ্ঞা খুঁজে পাই।
নারী জীবনের সংজ্ঞা || মিষ্টি আহমেদ
মিষ্টি আহমেদ সাংসারিক কাজের ফাঁকেফাঁকে জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে গল্প লেখার চেষ্টা করেন। তার বাড়ি ঢাকা জেলার মীর-হাজিরবাগ।