ছোট গল্পঃ চির বিদায় ভাই
আহমাদ, তোমাকে তো বেশ পরিপাটি লাগছে আজ। কি ব্যাপার কোনো প্রোগ্রাম আছে নাকি? এমন ভাবে আহমদকে প্রশ্ন করে বসে তার রুমের বড় ভাই ইয়াসির। আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের একজন ছাত্র। ছেলেটা বেশ মেধাবী এবং চটপটে। তবে আহমাদের সবচেয়ে বড় গুণ সে ভাবুক শ্রেণির। সবসময় তাকে হাস্যজ্বল চেহারায় দেখা গেলেও কিছু কিছু সময় দেখা যায় সে একাকি অবস্থান করে, সে সবুজ গাছ-পালার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলে। হয়তো তার মনের কথাগুলো প্রকৃতির সাথে ভাগ করে। আহমাদের বাড়ি খুলনা জেলায়। ঢাকা থেকে খুলনার দূরত্ব অনেক দূর। একদিন তার রুমের ভাই ইয়াসির, আহমাদকে বলে- আহমাদ, তুমি খুলনায় সচরাচর কিসে যাও? জবাবে- আহমাদ বলে, ভাই, ট্রেনে বেশিরভাগ যাওয়া হয়। আহমাদের মুখ থেকে কথাটি শোনামাত্র ইয়াসির বলে ওঠে, ওমা তাই নাকি!! তাহলে তো অনেক ভালো। আমার তো রেলপথে যেতে বেশ মজা লাগে। তুমি নিবা নাকি একদিন তোমাদের বাসায়?? আহমাদ তাঁর রুমের ভাই ইয়াসিরের এমন আগ্রহে বলে ওঠে, আরেহ, কি বলেন! অবশ্যই আপনি যাবেন। কেন নয়। সেদিন ইয়াসির, আহমাদের এমন সদয় জ্ঞাপনে বেশ খুশি হয়েছিলো, এবং বলেছিলো হ্যাঁ ইনশাআল্লাহ পরের বার আমায় সাথে নিও।
একদিন সকাল বেলা আহমাদ তাঁর ইয়াসির ভাইকে বলে, ভাই মা ফোন দিয়েছিলো, বললো- বাড়ি আসতে। আমার আপুর শ্বশুর বাড়ি থেকে সবাই আসবে সে উপলক্ষে অনেক আয়োজন। ভাই, খুলনা অঞ্চলের বিখ্যাত খাবার এবং পিঠাপুলির আয়োজন তো হবেই!! ভাই, এবার আর মিস করা যাবেনা। চলুন 'দু' ভাই চলে যাই। ইয়াসির মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে, সে ফ্রেস হতে যাবে, এমন সময় তাঁর ছোট ভাইয়ের আমন্ত্রণে বেশ খুশি হয় তবে অন্য একটা কারনে তাঁর ভিষণ মন খারাপ হয়। এই কাল দিন পরেই যে স্যারের মিডটার্ম এক্সাম। তারপর আবার এসাইনমেন্টের প্যাড়া। আইন বিভাগে পড়ুয়া ইয়াসিরের একাডেমিক পড়াশোনায় বেশ চাপ। তাঁর ফ্রি সময় বের করা অনেক কঠিন। ইয়াসির, আহমাদকে কাছে নিয়ে বল্লো, আহমাদ আমি অনেক খুশি হয়েছি। তোমার আমন্ত্রণ পেয়ে আমি সত্যি খুশি অনুভব করছি। তবে এবার আর যাওয়া হচ্ছেনা, কেন যে পরীক্ষা স্যার এগিয়ে দিলো নচেত খুলনায় যাওয়া মিস হতোনা এবং শীতের পিঠা খাওয়াও মিস হতোনা।
ইয়াসিরের যেহেতু পরীক্ষা রয়েছে সেই সুবাধে আহমাদ একাই রওয়ানা হয়। তবে রওয়ানার পূর্বে হঠাৎ আহমাদ তাঁর ইয়াসির ভাইকে বলে, ভাই বিদায় নিচ্ছি। দুয়া করবেন, আহমাদ কথা গুলো এমন ভাবে বলেছিলো যার ফলে ইয়াসির হঠাৎ বলে, আরেহ আহমাদ, এমন করে বলছো কেন? বিদায় মানে কি?? বলো, ভাই এক সপ্তাহের ব্যাপার মাত্র, তারপর দেখা হবে। পরে আহমাদ মুখে এক চিলতি হাসি দিয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। প্রায় সাত আট ঘন্টার ভ্রমণ শেষে পৌঁছে যায় খুলনায়, পৌঁছেই ইয়াসির ভাইকে ফোন দিয়ে জানাই, ভাই আমি পৌছালাম। আমার মা, আপনার কথা বল্লো, আপনাকে নিয়ে আসেনি বলে মা অনেক বকা দিলো। সত্যি খুব ভালো লাগতো যদি আপনাকে নিয়ে আসতে পারতাম। আহমাদের কথার প্রেক্ষিতে ইয়াসির বলে ওঠে, ইঞ্জয় আহমাদ, ইনশাআল্লাহ নেক্সট টাইম অবশ্যই হবে। আন্টির জন্য অনেক ভালোবাসা রইলো।
তিন দিন অতিবাহিত হয়ে গেলো। এর মাঝে আহমাদ এবং ইয়াসিরের মাঝে কোন কথা হয়নি। চতুর্থ দিন পরীক্ষা শেষ করে ইয়াসিরই আহমাদকে ফোন দেয়, হ্যাঁলো, আহমাদ কেমন আছো? জবাবে আহমাদ বলে- ভাই, আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো, আপুর জন্য কিছু কেনাকাটার জন্য শহরে যাচ্ছি। একথা শুনে ইয়াসির বলে- ওহ, অনেক ভালো, আপুর জন্য সেরা জিনিসটাই কিনে নিয়ে আসিও। এখন তো হয়তো ব্যস্ত পড়ে কথা হবে। জবাবে আহমাদও বলে ঠিক আছে ভাই, রাতে কথা হবে, রাখছি আসসালামু আলাইকুম। তাদের কথার পরিসমাপ্তি হয়। দুপুর গরিয়ে রাত এসে যায়। হঠাৎ আহমাদের মোবাইল থেকে কল আসে! ইয়াসির রিসিভ করেই বলে- কি খবর আহমাদ, বোনের জন্য কেমন শপিং করলে? ইয়াসিরের এমন কথা শোনার পরে আহমাদের ফোন থেকে জবাব আসে “অন্য একটা অপরিচিত ছেলের কন্ঠে” আহমাদের মামাতো ভাই আমি, সে বলে, ভাইয়া আহমাদ বেঁচে নেই!! আজকে সন্ধ্যা বেলায় রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়, তার মোবাইলটা অক্ষত থাকার সুবাদে আপনার নাম্বারে রিং দিলাম, আপনিই আহমাদের সাথে সর্বশেষ কথা বলেছিলেন। আহমাদের মামাতো ভাইয়ের কাছ থেকে এমন সংবাদ পাওয়ার পর ইয়াসির বাকরুদ্ধ হয়ে যায়!! সে কি বলবে কিছু বলার আগেই তাঁর দু চোখ দিয়ে ক্রমাগত অশ্রুর ফোয়ারা ঝরে। ইয়াসির কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। ওপাশের আহমাদ পরিবারের সবার কান্নার শব্দে যেনো আরো ব্যথিত হয়ে যায়। শুধু বলে, আমি আসছি। আমার জন্য যেনো অপেক্ষা করা হয় বলেই ফোন রেখে দেয় ইয়াসির।
পরদিন সকালে জানাযা। ইয়াসির পৌঁছে যায় খুলনায় আহমাদের বাড়িতে। আহমাদ একটা খাটিয়ায় উত্তর -দক্ষিন হয়ে শায়িত। ইয়াসির আহমাদকে দেখতে চাইলো, আহমাদের মুখখানা দেখা মাত্রই ইয়াসির তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু নির্গত করলো। একদম হতবাগচিত্তে চেয়ে আছে ইয়াসির। ইয়াসিরের কানে বেজে উঠছে আহমাদের কন্ঠস্বর! ভাই, আপনি এসেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি। তবে আমি এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছি আমার আর সাধ্য নেই। আপনার সাথে খুলনায় ঘুরতে যাবো! ভাই, জানেন ঐ যে দেখেন পিঠার ডালা, যান খেয়ে নেন পিঠাগুলো। ভাই, আপনি বলেছিলেন না, বোনের জন্য ভালো শপিং করতে, ঐ দেখেন লাল শাড়ি, সবচেয়ে ভালো এবং সুন্দর শাড়িটিই কিনেছিলাম কিন্তু ভাই আমার আপুর কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি! ভাই, আমার মাকে একটু সান্ত্বনা দিয়েন, বলিয়েন উনারা যেনো ধৈর্য ধরে। জানেন ভাই, আমি আমাদের রুমের বেলকুনিতে বসে প্রকৃতির সাথে কি কথা বলতাম? আমার মনে দুঃখ ছিলো, যেগুলো আমি কারো সাথে শেয়ার করতে পারতাম না। আপনাকে বলবো বলবো করে আর বলার সাহস পাইনি।
জানেন ভাই, আমার এডমিন ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন ছিল, সেটা আর পূরন হলো না। ভাই, আমার বিছানাপত্র, কাপড়চোপড়, বইগুলি আমার মায়ের নিকট পৌঁছে দিয়েন। দেখতেই পারছেন, মা যে আমার পাগলপারা হয়ে গেছে। ভাই, পারলে আমার পরিবারের দিকে খেয়াল রাখিয়েন। ছোট ভাই সজিব, ও তো সবেমাত্র নাইনে পড়ে, ওর প্রতি নজর দিয়েন, আপনার হাতে তুলে দিয়ে গেলাম। ভাই, আমি আর পারছিনা। আমাকে দাফন দেন দ্রুত। আমার জানাজা নামাজের ইমামতি আব্বাকে দিয়ে করাইতে বলেন। ভাই, আমার জন্য দুয়া রাখিয়েন।
ইয়াসিরের কানে দ্রম দ্রম আওয়াজে কথাগুলো বাজতে লাগলো। ইয়াসিরের বুঁকের মাঝে উদ্মামহীন ঢেউ এর মতোন দুঃখ কষ্টের জাতনা বইতে লাগলো। আর দেরি নয়, দাফন সম্পন্ন হলো আহমাদের। ইয়াসিরের হৃদয়-মাঝারে আহমাদের ঐ উক্তিই বারবার উঁকি দিচ্ছে- “ভাই বিদায় নিচ্ছি” আজ যে সেই বিদায়টিই চিরবিদায় বলে পরিগনিত হয়ে গেলো!!!
চির বিদায় ভাই || মোঃ রুহুল আমিন
মোঃ রুহুল আমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ৪র্থ বর্ষের একজন ছাত্র। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশুনা করছেন। তার পিতার নাম মোঃ শাহজাহান আলী, মাতা নূরুন্নাহার খাতুন। তার স্থায়ী ঠিকানা সিরাজগঞ্জ জেলার চিলগাছা গ্রামে।