বই রিভিউ: আমি বিজয় দেখেছি

  • রিভিউ: মো. হাছিবুল বাসার
  • Category: Book Review
  • Published on: Sunday, Aug 1, 2021

বইয়ের নাম: আমি বিজয় দেখেছি

লেখক: এম আর আখতার মুকুল 

প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর, ১৯৮৫

মূদ্রণ:জানুয়ারি, ২০১০

প্রকাশক: অনন্যা

পৃষ্ঠা: ৪০০

মূল্য: ৩৫০ টাকা

 

রিভিউ:

এম আর আখতার মুকুল একজন মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র লেখক ও পাঠক হিসেবে সুপরিচিত। তিনি কেবল চরমপত্র পাঠকই ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকও ছিলেন। ফলে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক তৎপরতা, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সাংগঠনিক পদক্ষেপ খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। এসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি লিখেন বিখ্যাত গ্রন্থ -'আমি বিজয় দেখেছি'।মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে আবর্তিত তার জীবন কথা বলতে গিয়ে এতে সমাহার ঘটেছে অনেক প্রামাণ্য ঘটনার।

প্রথম পুরুষে লেখা আত্মস্মৃতি বা তৃতীয় পুরুষে লেখা ব্যক্তির জীবনীও সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠতে পারে এই বইটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বইটি এমন এক সাহিত্যকর্ম যাকে সহজে না বলা যাবে আত্মকথা না বলা যাবে নিরেট ইতিহাসকথন। বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে প্রফেসর ডঃ আনিসুজ্জামান লিখেছেন — 'একটি ধরনের আত্মকাহিনী উপন্যাসের কাছাকাছি হয়ে থাকে, তাহলে আরেক ধরনের আত্মকথাকে বলতে হয় ইতিহাসের সগোত্র। এ জাতীয় রচনায় ব্যক্তির আত্মবিকাশের কাহিনী যতটা স্থান পায় তার চেয়ে বেশি রূপ পায় একটা দেশ ও কালের বিচিত্র বৈশিষ্ট্য যারা এক দিকটায় জোড় দেন, তাঁরা একটা বিশেষ সময় ও এলাকাকে ঘিরে স্মৃতিকথা রচনায় মনোনিবেশ করেন। আমি বিজয় দেখেছি মূলত এ জাতীয় গ্রন্থ।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ অধ্যায় দিয়ে বইটি শুরু হয়। তারপর স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট, একনজরে নির্বাসিত মুজিবনগর সরকার, মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সামরিক অফিসারদের তালিকা, আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের তালিকা ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর শুরু হয়েছে ধারবাহিক আলোচনা।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত প্রবাহিত হতে থাকে। এ পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধু কিভাবে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় ও করেছিলেন পাঠকদের সুবিধার্থে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭০ থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এর একটি ঘটনাপঞ্জি উপস্থাপন করেছেন। একাত্তরের বামপন্থীদের ভূমিকাও অত্যন্ত সুচারুরূপে বর্ণনা করেছেন। বামপন্থী আন্দোলন সম্পর্কে ১৪ জন বামপন্থী নেতার বক্তব্য সংযোজন করেছেন। প্রতিটি সেক্টরে হানাদার বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ও সমরনায়কদের নাম সম্বলিত চার্ট সংযোজন করেছেন।

স্মৃতিচারণের সূত্রে প্রসঙ্গত ফিরে গেছেন অতীতে। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে দেশবিভাগ,পূর্ব পাকিস্তানের উপর শাসকদের নিপীড়ন, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, ৬২'র ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, ইয়াহিয়ার ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা, অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা — এভাবে ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা প্রসঙ্গক্রমে টেনে এনেছেন। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাবলীর দিকেও আলোকপাত করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধাদের সংগ্রামের ঘটনা সচিত্র প্রতিবেদন আকারে লিপিবদ্ধ আছে বলে বইটি পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই এক সময় হারিয়ে যাবেন মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে। মুজিবনগর সরকার, বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারদের সমন্ধে বিস্তারিত ধারণা নিতে এই বইটি সহায়ক হবে। তাছাড়া চরমপত্রের ধরন কেমন ছিল? — তা বুঝতে পারবেন।

বইটিতে লেখক পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন বামপন্থী দলগুলোর ভূমিকা মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও স্বাধীনতার মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে নানা উত্থান-পতন যেমন— বঙ্গবন্ধুর হত্যা,জিয়ার সামরিক অভ্যুত্থান, জাতীয়তাবাদী স্লোগানের আড়ালে রাজনীতিতে মৌলবাদীদের ফিরিয়ে আনা ইত্যাদি সবকিছু তুলে ধরেছেন লেখক। এই বই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় দিনগুলোর কথা। নতুন প্রজন্মের নিকট বইটি অনেক বিভ্রান্তির অবসান করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

মো. হাছিবুল বাসার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের একজন শিক্ষার্থী।