বুক রিভিউ: শেষের কবিতা
লেখক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকাশনী: সূচীপত্র
দাম: ১৫০ টাকা
ধরন: রোম্যান্টিক উপন্যাস
প্রকাশকাল: ১৯২৮ সাল
লাব্যণের কৌতূহল আর বাধ মানল না, জিজ্ঞাসা করে ফেললো, “লাইন কী-বলুন না।”
“For God’s sake, hold your tongue and let me love!”
লাবণ্যের বুকের ভিতরা কেঁপে উঠলো।
বিশ্বকবি, কবিগুরু, মননের গুরু, আমার রবি’দা উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’র একটি অংশ বিশেষ এটি। অমিত-লাবণ্যের প্রেমময় সময়গুলোকে যুগলবন্দী করে রাখা ইচ্ছেগুলোকে কবিগুরু সমর্পণ করেছেন তাঁর শেষের কবিতায়।
আমি বারবার শৈল্পিক মুগ্ধ হয়ে পড়ি রবি’দার শব্দে, উঁনার গল্পে। এতো চমৎকার প্রেক্ষাপট আর যুগলবন্দীতে আমি যেন অকপটে রাখতে থাকি সময়ের সাথে।যোগ পরিবর্তন আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় নামটা এমন অদ্ভুত রূপ নেয়। তারপর....... কাহিনী বদলে যায় হঠাৎ করে!
নিজের ব্যক্তিগত পাঠ প্রতিক্রিয়ায় ‘শেষের কবিতা’ বেশ গাম্ভীর্যপূর্ণ। বাংলা সাহিত্যে রোমান্সে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
আর, তার রোমান্টিক উপন্যাসের মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয় আর পাঠক-নন্দিত হলো ‘শেষের কবিতা’। শেষের কবিতার কিছু লাইন আপনাকে দিবে দর্শনের পূর্ন প্রান, আর কিছু লাইন আপনাকে ভাসাবে রোমান্সের সাগরে।
শেষের কবিতা উপন্যাসটি লেখা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কালীন অভিজাত ও শিক্ষিতসমাজের গুটিকয়েক সাহিত্যপ্রেমী বিশেষ করে কবিতাপ্রেমীদের নিয়ে। এখানে আমরা যে চরিত্রগুলো দেখতে পাই সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলো অমিত রায়, লাবন্য, কেতকি, শোভনলাল ও যোগমায়া।
অমিত রায় বিলেতে পড়াশোনা করা একজন ব্যারিস্টার। ব্যারিস্টার হলেও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসায় কোনো কমতি নেই। ইংরেজিতে অমিট্রে বা অমিট রে হয়ে যাওয়া এই মানুষটির মনে প্রেমেরও কমতি নেই, তাই বলে তাকে আমি দুশ্চরিত্রের বলতে পারিনি গল্পের শুরুর দিকেই। আশেপাশে কতোশত সুন্দরী ঘুরেফিরে কিন্তু তাদের তার মনে ধরে না। এতটুকু জেনেছিলাম প্রথমে। পরক্ষণেই রবি ঠাকুর আমাদেরকে জানান অমিত সময় কাটাতে শিলং যায় এবং সেখানে যাত্রাপথেই পাহাড়ের রাস্তায় কোনো এক নয়নাভিরাম স্বর্গীয় স্থানে দুইদিক থেকে আসা দুই গাড়ির সংঘর্ষ হয়। গাড়িদুটোর একটিতে ছিলো বিশেষ একরকম অপুর্ণতায় ভোগা অমিত। এই সংঘর্ষে কারো প্রাণ না হারালেও কিংবা বিশালাকার ক্ষতি না হলেও অমিতের মন হারিয়ে যায় বিপরিত দিকের গাড়িতে যাত্রী হয়ে থাকা মায়াবতী লাবন্যতে। এবং লাবন্যের মনেও নতুন কিছু একটার জন্ম নিয়েছিলো। যা বুঝতে পারি অমিত ও লাবন্যের প্রথম দেখার প্রথম আলাপের বিশেষ রকম এক অভিব্যক্তির দ্বারা। অমিত যখন ভদ্রতা প্রদর্শন করে দুঃখ প্রকাশ করলো তখন লাবন্য অনেকটা এরকমই বললো- ভুল আসলে অমিত করেনি, ভুল করেছে লাবন্য। আর এই ভুল বা ত্রুটি সম্পর্কে যে অপ্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দাঁড়া করালো লাবন্য তাতেই মনে হয় হঠাৎ উদয় হওয়া পরদেশি সূর্যকে আলো ছড়ানোর সুযোগ করে দেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।
অমিত ও লাবন্যের ভালোবাসা নামক অদৃশ্য বস্তুটি পৌঁছে গভীরতর কোনো একখানে। তাঁরা তাঁদের নিজস্ব আলাপের সময় কি নামে ডাকবে সেটিও ঠিক করে নিয়েছে যা আমার কাছে এক প্রকারের ছেলেমিই মনে হয়েছে। অবশ্য প্রেমের কাছে কি ছেলেমি আর কি বয়সানুপাতিক আচরণ, এগুলো ঠিক হিসাবে ধরা হয় না। লাবন্য হলো বন্যা আর অমিত হয়ে গেলো মিতা। এই নামের আগমন ঘটাতে গিয়ে লেখক এক ন্যাকামোধর্মী বা একদমই তুচ্ছমাত্রার কথোপোকথন আমাদের উপহার দিয়েছেন। কেউ কেউ এখানে বলতে পারেন আমি বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ছোট করছি বা ছোট্ট মস্তিষ্কের আমি তাঁর সমালোচনা করছি। আসলে তা নয়, তিনি এখানে সেটিই তুলে এনেছেন যেটি এমন এক পরিস্থিতিতে হয়ে থাকার সম্ভাবনা প্রবল থাকে।
লাবন্য খুবই বিদুষী। বিদ্যার জগতে মা মরা এই মেয়েটির খুব দখল। সাহিত্যের প্রতিও অগাধ প্রেম রয়েছে তার। কেন হবেনা এমন? বাবা যার পশ্চিমি কলেজের অধ্যক্ষ, যে মেয়ে নিজের ঘরেই পেয়েছে লাইব্রেরি নামক স্বর্গ সে মেয়ে যে বিদ্যার্জনে পিছিয়ে থাকবে না সেটি অন্তত আমাদের মতো অসাহিত্যপ্রেমীও বুঝতে পারি। বাবা অবনীশ দত্ত খুব করে চাইতেন মেয়ে বিদ্যায় বড় হয়ে উঠুক, লাবন্যের বিয়ে নাই বা হলো তাতে বাবার কিছু আসে যায় না বরং চায় কন্য তাঁর পাণ্ডিত্যের সাথে জীবন কাটাক। নিজ মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে শ্যাম-সুন্দরী মেয়েটি বঞ্চিত হলে যোগমায়া মাসীর আদর অনেক কিছু দিয়েছে।
অমিত ও লাবন্য দুজন দুজনের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে, একসাথে সময় কাটাচ্ছে, প্রকৃতি দেখছে; আবার সুযোগ পেলে এটিও আন্দাজ করে নিচ্ছে কে কার মধ্যে কতটুকু ডুব দিয়েছে বা দিতে পেরেছে। কে কার মধ্যে কতটুকু ডূবেছে সেটি নিয়ে আমি পাঠক হিসেবে ততটা না বুঝতে পারলেও, অন্তত চরিত্র দুটি যে একজন অপরজনকে কথার বানে ভাসিয়ে গেছেন নদী হতে সমুদ্রে সেটি দৃষ্টি এড়ায়নি। লাবন্যকে বিয়ে করবে এমন আশা দিয়ে অমিত আংটি পরিয়ে দেয়। খুব সাধারণ ও পাগলপ্রায় জীবনধারণ করা শুরু করে সে যা কাছে থেকেই প্রত্যক্ষ করে যোগমায়া মাসী।
ধরেই নিয়েছিলাম ‘সুন্দর একটি প্রেম’র গল্প শেষ করতে চলেছি। কিন্তু সেই প্রত্যাশা মাটিচাপা দিয়ে ঔপন্যাসিক নিয়ে আসলেন কেতকি ও শোভনলাল নামক দুটি চরিত্র। স্বভাবগত দিক থেকে শোভনলাল এবং লাবন্য একই রকম। কোনো এক সময় শোভনলাল লাবন্যকে প্রেম নিবেদন করে। কিন্তু সে নিবেদনে লাবন্যর ইতিবাচক ইশারা পর্যন্তও পায়নি বেচারা। অমিত এবং কেতকিরও একই কেইস। একই কেইস বললে বরং আমারই ভুল হবে। কেতকি, যাকে আমরা কেটি নামেও পেয়েছি, সে অমিতকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসে। যখন সে জানতে পারে পাহাড়ে এসে নতুন এক মেয়ের সাথে প্রেমে জড়িয়েছে তাঁর প্রেমের পুরুষ তখন সেও চলে আসে এখানে আর স্বাভাবিকভাবে যা হবার তা-ই হয়েছে বরং অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটিয়ে দেখাননি যিনি এই উপন্যাসের লেখক। এই কেটি বাংলার মেয়ে হলেও চলনে রয়েছে বিলেতি ছায়া। ধূমপান, কুকুরপোষা, ছোট পোষাক, তাচ্ছিল্য করে কথা বলা ইত্যাদি তাঁর চরিত্রের অংশ। এখানেই লাবন্যের সাথে অমিল কেতকির সাথে। বিলেতে পড়াশোনা করা এই মেয়েটি আবার অমিতের বোন লিসির বান্ধবী। ভালোবেসে অমিত এই মেয়েটিকেও আংটি পরিয়েছে; যা লাবন্যের কাছে গোপন করে। শুধু গোপনই করেনা, লাবন্যকে স্বপ্নও দেখায়।
অমিত যেখানে একজন কেতকির মতো রঙিন জগতের মেয়েকে ভালোবেসেছে সেখানে লাবন্যের মতো শহুরে রঙঢঙহীন ও সমাজের চোখে শালীন একটি মেয়েকে পুনরায় ভালোবেসে কিভাবে আংটি পরায়, এখানে এই পুরুষ চরিত্রটির প্রেম বা ভালোবাসা নিয়ে কি প্রশ্ন তোলা যায় না? সত্যিকারের প্রেমিক কতোবার কতোজনের সাথে প্রেমে জড়াতে পারে? প্রথম প্রেম ছিলো বিলেতি বাংলা মেয়ের সাথে আর দ্বিতীয় প্রেম হলো এক খাটি বাংলা মেয়ের সাথে। প্রথম প্রেমিকা ছিলো খুবই খোলামেলা ও ইউরোপিয়দের দ্বারা সংক্রমিত আর দ্বিতীয় প্রেমিকা হলো চিরাচরিত বাংলা বুকের মেয়ে বলতে যা বোঝা ঠিক সেরকম। হয়তো অমিত মনে মনে এমন কোনো মেয়েকেই জীবনসাথী হিসেবে পেতে চেয়েছিলো বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালি মেয়েদের ক্বদর বোঝানোর জন্যই অমিত চরিত্রটির জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুটির কোনোটিরই প্রতিষ্ঠা লক্ষ্য করা যায়নি ।
অমিত চলে যায় পুরোনো প্রেমিকা কেতকির কাছে। আর তখনই লাবন্যের মনে হয় শোভনলালও তাকে খুব ভালোবাসে কিন্তু বেচারাকে নিজের বিদ্যার অহংকারে পরে পাত্তা দেয়নি এতদিন। ফলাফল যা হবার তা-ই হলো, যা বলে দেবার প্রয়োজন মনে করছি না।
অমিতকে দেখা গেলো এক বিশেষ মন্তব্য করতে, “কেতকির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালোবাসারই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল- প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবন্যের সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা, সে রইল দীঘি, সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে”। কেতকি ও লাবন্যকে নিয়ে করা অমিতের এই মন্তব্য আমার কাছে লম্পটের বানীই মনে হয়েছে।
অমিতের চরিত্রটি খুব একটা সুবিধের মনে হয়নি সেটি আমার করে যাওয়া মন্তব্য থেকেই বুঝেছেন নিশ্চয়ই। লাবন্যকেও যে খুব বেশি ভালো মনে হয়েছে সেটিও নয়। শোভনলালের কাছে এক পর্যায়ে সে গেলেও মন আছড়ে পরে আছে অমিত রায়ের কাছেই। যদি বলি, লাবন্য অমিতকে ভেবেই শোভনলালের সাথে দেহ ভাগ করে নিচ্ছে তাহলেও ভুল হবে না। এই খলনায়করূপি নায়ককে বলতে পারি চরিত্রহীন আর নায়িকা লাবন্যকে মেনে নিতে পারি ভ্রষ্টা হিসেবে। সে যা-ই হোক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে দেখিয়েছেন অতি-পুরুষতান্ত্রিকতা, এমন করে এ লেখাটির উপরের দিকেও বলে এসেছি।
১৯২৮ সালে রচিত এই উপন্যাসে একটু পরপরই ছিলো কবিতার খেলা। শুধু কবিতার খেলায় বা কবিতার ছটার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেকেও প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন এখানে। আমি মাঝে মাঝেই মজার ছলে বন্ধুদের কাছে নিজের ঢোল নিজেই পিটিয়ে থাকি এবং তৈরি হওয়া বিশেষ কৌতুকাবহ পরিবেশটি আমি উপভোগও করি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথও যে এই কাজটিই ভালোবাসতেন সেটি শেষের কবিতা না পড়লে জানতামই না।
লেখকের যতগুলো কালজয়ী উপন্যাস রয়েছে তাঁর মধ্যে শেষের কবিতা অন্যতম, এ আমি ইতিহাস থেকে জানি। আমার কাছেও মন্দ লাগেনি এই উপন্যাসটি।
শেষের কবিতা উপন্যাসের কিছু উক্তি আমার মনে ধরেছে। এর মধ্যে কিছু সমালোচনা বাদেই মেনে নেয়া যায় যেমন- “ফ্যাশনটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্ৰী”। আর কিছু বিতর্কেরও জন্ম দেয় যেমন, “পুরুষ আধিপত্য ছেড়ে দিলেই মেয়ে আধিপত্য শুরু করবে। দুর্বলের আধিপত্য ভয়ংকর।''
আলোচনা বা সমালোচনা যা-ই করি, মনে হলো রোমান্টিসিজম ও বাস্তবতার খুব কাছাকাছি একটি গল্প পড়তে পেরেছি। এটি পড়তে গিয়ে যা বুঝলাম এবং এটি নিয়ে যা লিখলাম তাতে আমার চিন্তাধারায় বা বোঝায় ভুল থাকতে পারে। দয়া করে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন যদি আমার এই আশঙ্কা সত্যি হয়ে থাকে। কোনো রকম চমকপ্রদ উপসংহার ছাড়াই শেষ করছি শেষের কবিতা থেকে আমার ভালোলাগার শেষের কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে-
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু বিদায়.................
Suman Mia is a fourth-year BBA Honours Accounting student at Dohar Nowabgonj College in Nowabgonj, Dhaka.