Book Review: A Golden Age
চলছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর।ডিসেম্বর মাস আসলেই যুদ্ধের কথা আমাদের বেশি করে মনে পড়ে। যুদ্ধ আমাদের কারোরই কাম্য নয়। যুদ্ধ মানেই আতঙ্ক, গোলাগুলি, অগণিত মৃত্যু, হাহাকার, বিধ্বংস। তবে যুদ্ধ কাম্য নয় বললেই শুনছে কে? যখন একটি ভূখণ্ডের জনগণের ওপর নিরন্তর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বৈষম্য করা হয়, তাদের বাক স্বাধীনতা, সংস্কৃতির ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়, সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়, তখন সে জাতির দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। যুদ্ধ তখন হয়ে ওঠে অনিবার্য। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে যখন দ্বিজাতিতত্ত্ব অনুযায়ী অখন্ড ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটো আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয় তখনও হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা কল্পনা করতে পারেনি যে, আরো ২৪ বছরের শোষণ তাদের ভোগ করতে হবে। শুধু ধর্ম এক হওয়াই একসাথে থাকার জন্য পর্যাপ্ত নয় এই বোধ তখনো গড়ে ওঠেনি। পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগলিক দূরত্ব ছিল ১২০০'শ মাইলের বেশি কিন্তু মানসিক দূরত্ব যে আরো বেশি ছিল!! ১৯৭১ এ শুরু হলো বাঙালির রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। তবে যুদ্ধকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু সবার ক্ষেত্রে এক ছিল না। কারো কারো কাছে এ যুদ্ধ ছিল স্রেফ স্বজন হারানোর কারণ, অসময়, গন্ডগোলের সময়। তখনকার একটি পরিবারের কাছে যুদ্ধ দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা কেমন ছিল? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা আমরা অনেকেই হয়তো অনেক বই পড়েছি কিন্তু আজ আমি যে বইটির ব্যাপারে বলবো সেটা অন্য বইগুলোর চেয়ে আলাদা।
এ বইয়ের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে রেহানা হক নামের এক বিধবা মাকে কেন্দ্র করে। রেহানা হক বাঙালি নন, তার মাতৃভাষা উর্দু। তার শৈশব কেটেছে কলকাতায়। স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম রেহানার বাবার মৃত্যুর পর পরিবারে নেমে আসে অস্বচ্ছলতা। তার দুইবোন করাচিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে চলে যান। রেহানার বিয়ে হয় ইকবাল হকের সাথে। বিয়ের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। রেহানার স্বামী হার্টএ্যাটাকে মারা যাওয়ার পর রেহানা তার দুই সন্তান সোহেল ও মায়াকে নিয়ে বিপাকে পড়েন। রেহানার জা পারভিন নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি ও তার স্বামী ফয়েজ সোহেল ও মায়াকে নিজেদের অধিকারে নিয়ে যাওয়ার জন্য আদালতে মামলা করেন। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, মানসিক ভঙ্গুরতার কারণে রেহানা মামলায় হেরে যান। তার সন্তানরা চলে যায় করাচি। এরপর রেহানা তাদের ফিরে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। ১০ বছর পর তিনি তার সন্তানদের ফিরে পেতে সমর্থ হন। তার এই যাত্রায় তার সঙ্গী ছিল তার বান্ধবী মিসেস চৌধুরী। রেহানা এখন তার সন্তানদের নিয়ে ধানমন্ডিতে এক বাংলোতে বসবাস করেন এবং বাংলোর সাথে "সোনা" নামের আলাদা একটি ভবনও আছে। যেটা এখন ভাড়া দেওয়া হয়েছে সেনগুপ্ত পরিবারকে। তবে রেহানা বাংলো তৈরির এই টাকাগুলো কোথায় পেয়েছেন তা চিরদিনের জন্য তার মনেই কবর দিয়ে দেয়। কাহিনীর শুরু হয় ১৯৫৯ সালে। যেখানে রেহানা তার স্বামীর কবর যিয়ারত কালে বাচ্চাদের হারানোর কথা বলেন। সোহেল ও মায়া এখন বড় হয়ে গেছে। দুজনেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ঢাকায় বেড়ে ওঠার কারণে তাদের মনে আছে দেশের জন্য অগাধ ভালোবাসা। এরইমধ্যে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরু হলে সোহেল মুক্তিবাহিনীতে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে যুক্ত হয় আর মায়া কলকাতায় যেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করে। রেহানা সন্তানদের আগলে রাখতে চান। তিনি চান না তার সন্তানেরা তার থেকে দূরে থাকুক। তার স্বীকার করতে কুন্ঠাবোধ হয় না যে এখনও উর্দুতে কথা বলতেই তিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তবে পরিস্থিতির চাপে তিনি যুদ্ধে জড়িয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করা, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছে সোহেল ও মায়ার ব্যাপারে মিথ্যে বলা সহ যাবতীয় কাজ তিনি করে গেছেন। গেরিলাদের একটি অপারেশনে একজন মেজর আহত হলে দীর্ঘদিন যাবত তার সেবা করতে করতে রেহানা তার একান্ত ব্যক্তিগত কথাও তাকে বলা শুরু করেন। তাকে ভালোবেসে ফেলেন৷ একদিন রেহানার বাড়িতে পাক সেনাদের আগমন হয়। তারা সোহেলকে খুঁজতে থাকে। এরপর কি হয়? জানতে হলে পড়তে হবে "এ গোল্ডেন এজ"।
এই বইটিতে রেহানার প্রবল মাতৃত্ববোধ দেখা যায়। তার মাতৃত্ববোধের একটি অংশ ছেলেমেয়েদের তাদের মত চলতে দিতে চায় আবার আরেক অংশ চায় তাদের আগলে রাখতে। ছেলেমেয়েদের সাথে তার একটা মানসিক দূরত্ব থেকেই যায়। সবসময় দেশ, দেশ করা তার ছেলেমেয়েদের তিনি মাঝেমাঝে চিনতে পারেন না। এই গল্প রেহানার আত্মোপলব্ধিরও বলা যায়। যেখানে তিনি মাঝেমাঝে বুঝতে পারেন না আসলেই তার দেশটার প্রতি টান আছে কি না। রেহানার স্বার্থপরতার গল্পও বলা যায়। তিনি শুধু নিজের ছেলেমেয়ের বেঁচে থাকার জন্য দোয়া করেন। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেলে একজন মা কতটা একা হয়ে যান তার নিদর্শন মেলে। মানুষ একাকিত্ব দূর করার জন্য কখনো কখনো সম্পূর্ণ অচেনা এক ব্যক্তিকে গোপন কথা বলতে পারে। সেটাও দেখা যায় এখানে। চরিত্রগুলোর মধ্যে একমাত্র মায়া চরিত্রটি আমার ভালো লেগেছে। সোহেলের দেশপ্রেমের মধ্যে মাঝেমাঝে সিলভির প্রতি থাকা প্রেম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সিলভিকে পাওয়ার জন্য সিলভির স্বামী সাবের যে কি না একজন সামরিক অফিসার, দেশের জন্য কাজ করতে নামায় মিলিটারিদের নির্যাতনের শিকার তাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য মায়ের কাছে অনুরোধের ব্যাপারটা স্বার্থান্বেষী মনোভাব মনে হয়েছে। এছাড়া অপারেশন সার্চলাইটের মত ভয়াবহ অবস্থায় মিসেস চৌধুরীর মেয়েকে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগা, যুদ্ধের দিনগুলোতে রেহানার ভালো ভালো খাবার রান্না করা যেখানে বাজারে যাওয়াই আশঙ্কার বিষয়, অতিথি আপ্যায়নের জন্য বাঙালি সংস্কৃতিতে আস্ত ভেড়া রোস্ট করে খাওয়ানো প্রভৃতি ব্যাপারগুলো অসংগতিপূর্ণ মনে হয়েছে। এছাড়া বইটিতে যুদ্ধকালীন ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা ততটা জোরালোভাবে নেই, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার মধ্য দিয়ে ভয়াবহতা প্রকাশ পেয়েছে। তাছাড়া রেহানার জবানিতে ঘটনাগুলোর বর্ণনা কিছুটা খাপছাড়া লেগেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস একটি পরিবারের দৃষ্টিতে কেমন ছিল এই বইটা পড়ে সে ব্যাপারে অনেকটাই জানা যায়। সব মিলিয়ে আমার কাছে ব্যক্তিগত রেটিং ৩ দেওয়ার মত মনে হয়েছে।রিভিউ ব্যাপারটি যেহেতু সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত তাই আমি আমার মতামত দিলাম। আপনাদের কাছে ভালো লাগলেও লাগতে পারে।বইটি কমনওয়েলথ লেখক পুরস্কার ২০০৮ এ সেরা বই হিসেবে পুরষ্কৃত হয়। বইটি বাংলা সহ আরো ১৬টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পড়ে দেখতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব, অহংকারের বিষয়। আমাদের অস্তিত্বের বিষয়। তাই মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আমাদের জানা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বেশি বেশি বই আমাদের পড়া উচিত।
বইয়েরনাম: A Golden Age
লেখক:তাহমিমাআনাম
ধরণ:ঐতিহাসিকউপন্যাস
প্রকাশক:জনমুরে(যুক্তরাজ্য)
প্রথমপ্রকাশ:মার্চ,২০০৭(যুক্তরাজ্য)
রেটিং:৩/৫
Book Review: A Golden Age || Halima Akter Tanny
Halima Akter Tanny is a passionate Writer. Currently, She is studying in BBA 4th year at Khulna University. She has won several writing competitions.