শেষ ঠিকানা
Winner of the Fortnightly event based on Editor's Choice (22.11.21)
বিকেল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ যেমন কিছু একটা ভেবে থেমে-থেমে কাঁদে আকাশটাও আজ যেন ঠিক তেমনি কেঁদে চলেছে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আলেয়া বেগম। একাকী জীবনের কষ্টটা পূর্বে কখনো আঁচ করতে পারেননি তিনি। একটিমাত্র ছেলে তার। আকাশের বিশালতা দেখে ছেলের নামটি সে নিজেই রেখেছিল আকাশ। দুঃখের বিষয় আকাশের মাঝে যে বিন্দু-বিন্দু নক্ষত্র দেখা যায় সেই বিন্দু পরিমান ভালবাসাও আজ মায়ের প্রতি নেই ছেলেটির। ছেলের কথা মনে হলেই আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদে আলেয়া।
বয়সের ভারে কিছুটা দুর্বল হয়ে পরেছেন তিনি। তিন বছর হয়ে গেল আলেয়া একজন ঠিকানাহীন মানুষ। ঠিকানা নেই বললে ভুল হবে কেননা বিশাল এই অট্টালিকার মূল দরজায় বড় করে লেখা আছে 'শেষ ঠিকানা'। কতটা পাষাণ হলে একটি সন্তান তার বাবা-মাকে এমন একটি ঠিকানায় রেখে যায় এর উত্তর আজও খুঁজে পায়নি আলেয়া। ফেলে আসা স্মৃতিগুলো ভাবতে-ভাবতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। সন্ধ্যা হতেই আলেয়ার রুমে প্রবেশ করল রেখা।
কি ব্যাপার দিদি!
অন্ধকারে বসে আছো, বাতি জ্বালোনি?
রেখা আর আলেয়া এই রুমে প্রথমদিন থেকেই একে অপরের সঙ্গী। বিদ্যুৎ না থাকায় রেখা নিজেই গেল ড্রয়ার থেকে মোমবাতি আনতে। মোমবাতির প্যাকেট টান দিতেই একটি পুরোনো শাড়ির বাক্স মেলে পরলো মেঝেতে আর শাড়ির ভাঁজ থেকে পরলো এক হাজার টাকার তিনটি চকচকে নোট। তড়িঘড়ি করে শাড়ি আর টাকা গোছাতে-গোছাতে রেখা বলল,
আচ্ছা দিদি,
তুমি এই পুরোনো শাড়ি আর তিন হাজার টাকা এত যতন করে রেখে দিয়েছে কেন?
অবশেষে মুখ থেকে কথা বেরুলো আলেয়ার।
জানিস রেখা,
আকাশ যেদিন প্রথম বেতন পেয়েছিল সেদিন আমাকে এই শাড়ি আর তিন হাজার টাকা দিয়েছিল।
ছেলের দেয়া প্রথম উপহার তাই আমি খুব যতন করে রেখে দিয়েছি। ওর বাবার অভাব ওকে কোনদিন বুঝতে দেইনি। আজ খুব মনে পড়ছে ওকে।
চিৎকার করে উঠলেন আলেয়া, বাবা একটিবার আয়, আমি তোকে মন ভরে দেখি।
আলেয়ার কথা শুনে রেখা আর চোখের পানি আটকাতে পারলনা। রেখা জড়িয়ে ধরলো আলেয়াকে। সান্তনা দেবার মতো কোনো ভাষা তার জানা নেই। কারন তিনিও একই শোকে পাথর। রেখা লক্ষ্য করল আলেয়ার মধ্যে কেমন যেন একটা অস্থিরতা ভাব বিরাজ করছে। রেখা চমকে উঠল।
কি হয়েছে দিদি?
ও কিছু না, হয়তো রক্তচাপটা একটু বেড়ে গিয়েছে।
তুমি শুয়ে থাকো আমি ডাক্তার ডাকতে বলছি।
হঠাৎ রেখার হাতটা চেপে ধরলো আলেয়া।
বোন, আমার একটা কথা রাখবি?
আমি যেদিন মরে যাবো আমার কাফনের কাপড়টা আমার ছেলের প্রথম বেতনের ঐ টাকাটা দিয়ে কিনে দিতে বলিস।
চোখ মুছতে-মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল রেখা। খাটে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল আলেয়া। চোখে ভেসে উঠে আকাশের ছোট বেলার দিনগুলোর কথা। আমার এই বুকে শুয়ে ঘুমাতো আমার ছোট্ট আকাশ। কিভাবে আজ সে ভুলে আছে আমায়! মায়ের ভালবাসা কি কোনো সন্তান তার জীবন থেকে এভাবে মুছে ফেলে? চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার বালিশে। বুকের হাহাকার সহ্য করতে না পেরে চোখ বুজে শুয়ে রইলেন আকাশের গর্ভধারিণী মা আলেয়া। জানালা দিয়ে শীতল একটা বাতাসের ঝাপটা এসে ঘুম পাড়িয়ে গেল আলেয়ার দগ্ধ হৃদয়কে। যতক্ষণে রেখা ডাক্তার নিয়ে রুমে প্রবেশ করল ততক্ষণে আলেয়া ছেলের খোঁজে দেহ ছেড়ে চলে গেছে বহুদূর।
সারারাত বৃষ্টির পরে সকালে রোদের দেখা মিলল। আলেয়ার কথা মতোই তার ছেলের দেয়া টাকা থেকেই কেনা হলো তার কাফনের কাপড়। অবাক দৃষ্টিতে আলেয়ার দিকে তাকিয়ে রইল রেখা। রেখার মনে হলো আলেয়া তাকে ডেকে বলছে,
জানিস রেখা, আমি ভেবেছিলাম এই শেষ ঠিকানায় আমি চিরদিন অবহেলায় আর অনাদরে পড়ে থাকব কিন্তু আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, দেখ পৃথিবীর মানুষ এই বৃদ্ধাশ্রম আমার শেষ ঠিকানা নয় আজ আমার সন্তানেরা আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে আর আজ আমি ওদের কাঁধে ভর করে আমার নতুন ঠিকানায় যাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন যুবক এসে আলেয়ার লাশ নিয়ে চলে গেল আলেয়ার নতুন ঠিকানায় পৌঁছে দিতে।
শেষ ঠিকানা || Suman Mia
Suman Mia, a resident of Nowabgonj, Dhaka, is pursuing his BBA (4th year) in Accounting at Dohar Nowabgonj College.