Print World Header Banner 2

Economy

বিশ্বের বাণিজ্যযুদ্ধ যেভাবে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আনতে পারে

Written by: এস এম নাহিয়ান

20-04-2025

বিশ্বের বাণিজ্যযুদ্ধ যেভাবে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আনতে পারে

পরিবর্তন হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দৃশ্যপট। কোনো কোনো দেশ পাচ্ছে ট্যাক্স সুবিধা, কোনো কোনো দেশের উপর চেপে বসছে বিশাল ট্যাক্স। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে একরকম বাণিজ্যযুদ্ধই শুরু হয়েছে বলা যায়। 

শুধু চীন নয়, পাশের দেশ কানাডাসহ ইউরোপীয়ান দেশগুলোও ট্রাম্পের ট্যাক্স নীতিমালার শিকার। কিন্তু চুপচাপ মেনে না নিয়ে পালটা ট্যাক্স বসিয়েছে মেক্সিকো, কানাডার মতো দেশগুলো। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নও এপ্রিলের মাঝামাঝির মাঝে নতুন ট্যাক্স আরোপ করতে যাচ্ছে। খুব দ্রুতই বিশ্ব দেখতে যাচ্ছে এযাবতকালের সবচেয়ে বড় ট্যাক্স বা ট্যারিফ যুদ্ধ। 

কিন্তু কথায় আছে, ‘Chaos is a Ladder’।  আর উন্নতবিশ্বে এই বাণিজ্যযুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য তৈরি করে দিচ্ছে সফলতার মই। যে মই বেয়ে খুব দ্রুতই বাংলাদেশ উঠে যেতে পারে রপ্তানিনির্ভর দেশের কাতারে। 


বাংলাদেশের সুবিধা কোথায়? 

বাংলাদেশ সুবিধার যায়গাটি আসলে দ্বিমাত্রিক। প্রথমত, শুল্ক সুবিধার কারণে বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা হয়তো কিছুটা বৃদ্ধি পাবে। কারণ প্রতিটি দেশের ব্যবসায়ীরাই কম শুল্কযুক্ত পণ্য কিনতে আগ্রহী। 

কিন্তু সত্যি বলতে এটা খুব বড় কোনো সুবিধা নয়। কারণ বাংলাদেশের বেশিরভাগ রপ্তানি আয় আসে গার্মেন্টস শিল্প থেকে। গার্মেন্টস এর আন্তর্জাতিক বাজারে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বেশ শক্ত অবস্থান রয়েছে। আসল পার্থক্যটা তখনই তৈরি হবে যদি বাংলাদেশ পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারটা ধরতে পারে। 

সূত্রঃ নিউ ইয়র্ক টাইমস

উপরের ছবিটায় শুধু মেক্সিকো, কানাডা আর চীনের কথা বলা থাকলেও, এগুলোর পাশাপাশি ভারত, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াও বেশ বড় ধরনের শুল্কের সম্মুক্ষীন হচ্ছে। শুধু যে আমেরিকা ট্যাক্স দিচ্ছে বিষয়টি তেমন না, বরং প্রথম তিনটি দেশও পালটা ট্যাক্স বসাচ্ছে। 

কেন অন্য দেশে বিনিয়োগ?  

কিন্তু দুইটি দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ থাকলেই যে সেই দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে না, তা কিন্তু না। আপনাদের নিশ্চয়ই চাইনীজ ব্র্যান্ড হুয়াওয়ের কথা মনে আছে। ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের পাশাপাশি বিশ্বের মোবাইল মার্কেটেও খুব শক্ত অবস্থান তৈরি করছিলো হুয়াওয়ে। কিন্তু তথ্য চুরির অভিযোগে হুয়াওয়েকে আমেরিকা থেকে ব্যান করা হয়। এরপর কিন্তু হুয়াওয়ের একটি সিরিজ, হনরের (Honor) এর নামে নতুন ফোন আসা শুরু করে মার্কেটে। 

স্যাংশনের মোকাবেলা করার জন্য এটি অনেক পুরোনো একটি স্ট্রাটেজি। কিন্তু এই স্ট্রাটেজি যে শুধু ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় তা নয়, বরং পুরো দেশের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়। একটি দেশ কোনো কারণে স্যাংশন বা উচ্চ শুল্কের মুখোমুখি হলে, অন্য দেশে বিনিয়োগ করাটা তাদের জন্য একটি ভাল অপশন। এতে করে, উচ্চ শুল্ক এড়ানোর যেমন সুযোগ থাকে, তেমনই সাপ্লাই চেইন রিস্কও কমে যায়। আর 

চায়না প্লাস ওয়ান পলিসি

চায়না প্লাস ওয়ান পলিসি বা সি + ১ পলিসি হলো এমন একটি পলিসি যেখানে উৎপাদনের জন্য শুধু চীনের উপর নির্ভরশীল হওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়। বিশ্বের কারখানা হিসেবে পরিচিতি চীনে ২০১৪-১৫ সালের দিকে লেবার খরচ বেশ বেড়ে যায়। তখনই প্রথমবারের মতো এই পলিসির কথা আন্তর্জাতিক মহলে উঠে আসে। 

এরপর ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ, কোভিডের সময় চীনভিত্তিক সমস্ত উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়াতেও এই পলিসি নিয়ে বেশ কথা হয়েছে। আর এবার ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে নতুন বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার পর, সি+১ এর আলাপটা এখন বেশ জোরেসোরেই হচ্ছে। 

সূত্রঃ নিউ ইয়র্ক টাইমস


দেখতেই পাচ্ছেন, চীনের সাথে আমেরিকার বাণিজ্যঘাটতি প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ আমেরিকাতে চীনের রপ্তানি, আমদানির তুলনায় অনেক বেশি। আর এই বিশাল মার্কেটটার কিছুটা অংশ যদি বাংলাদেশ ধরতে পারে, সেটাও হবে বেশ বড় কিছু। 

শুধু যে চীনে বিনিয়োগকারী বিদেশী কোম্পানীগুলোর বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে তা নয়। বরং চীনের নিজেরও শুল্ক ফাঁকি দিতে এই পদ্ধতি অবলম্বন করার সুযোগ রয়েছে। আর এখানে শুধু চায়না প্লাস ওয়ানের কথা ভাবলেই হবে না। কারণ বাণিজ্যযুদ্ধটা ২০১৮ এর মতো আর চীনকেন্দ্রিক নয়। 

বিনিয়োগ পেতে যা যা করা দরকার বাংলাদেশের 

কিন্তু শুধু বাণিজ্যযুদ্ধের কারণেই বাংলাদেশ বিনিয়োগ পাবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ এ যুদ্ধ ক্ষণস্থায়ীও হতে পারে। সর্বোপরি বাংলাদেশ ছাড়াও বিনিয়োগ গ্রহণের জন্য আরও অনেক দেশ মুখিয়ে আছে। 


তাই বিদেশী বিনিয়োগ পেতে প্রথমেই যা যা করতে হবেঃ 

১। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা

যেকোনো দেশের বৈদিশিক বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় রাজনৈতিক অস্থিরতা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা আরও সত্যি। তাই দেশে যতই রাজনৈতিক সমস্যা থাকুক, তার প্রভাব যে উৎপাদন বা পরিবহন ব্যবস্থার উপর না পরে, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। 

২। দক্ষ জনশক্তি তৈরি

বাংলাদেশে খুবই কম খরচে জনশক্তি পাওয়া গেলেও, তার সিঙ্ঘভাগই অদক্ষ। কিন্তু যেকোনো আধুনিক পণ্যের উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রয়োজন দক্ষ শ্রমিক। তাই বাংলাদেশের পলিটেকনিক ইন্সটিউটগুলোর দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে আরও ভূমিকা রাখা দরকার। বর্তমান ব্যবস্থায় অধিকাংশ পলিটেকনিক স্টুডেন্ট সরকারী চাকরির পেছনে ছোটেন অথবা পরবর্তীতে বিএসসি করে ক্যারিয়ার পরিবর্তন করেন। কিন্তু উৎপাদনমুখী কারখানাগুলোতে যেন তারা আসেন, তা নিশ্চিত করা দরকার। 

৩। অর্থনৈতিক জোনগুলোর সঠিক ব্যবহার

বর্তমানে আটটি সরকারী এবং ২৯টি প্রাইভেট  এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বেজার (BEZA) অধীনে মোট ৮৮টি ইপিজেড গড়ে তোলার ছাড়পত্র হয়েছে। জোনগুলোর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা, ও অন্যান্য সুবিধাদি নিশ্চিত করতে পারলে এগুলো হতে পারে বিদেশী বিনিয়োগের অন্যতম কেন্দ্র। 


৪। ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু করা

যদিও এদেশে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (BIDA) এর মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কিন্তু এখনও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশীদের অনেক ভোগান্তী পোহাতে হয়। এক্ষেত্রে প্রধান ভোগান্তি হলো বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। ছাড়পত্র ও অনুমতির জন্য এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে ঘোরার ভয়ে অনেক বিদেশীই এখানে বিনিয়োগ করতে চান না। 


৫। আইনী সংস্কার

যদিও বাংলাদেশের আইনে ১০০% বিদেশী মালিকানাও গ্রহণযোগ্য, তবুও এদেশের আইন সংস্কারের অনেক সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সংক্রান্ত আইন নবায়ন করা খুবই জরুরী। কারণ নতুন পৃথিবীতে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদই সবচেয়ে বড় সম্পদ। 

৬। নির্দিষ্ট সেক্টর টার্গেট করা

যেকোনো খাতে বিনিয়োগ আনার চেয়ে যেসব পণ্যের বিশ্বব্যাপী চাহিদা রয়েছে, সেসব পণ্যেই বিনিয়োগ আনাটা লাভজনক। ইলেক্ট্রনিক্স, আইটি প্রডাক্ত, সফটওয়্যার, ঔষুধ, ইত্যাদি খাত বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা শিল্প। এর পাশাপাশি দেশীয় চাহিদা মেটাতে অন্যতম আরেকটি শিল্প হতে পারে ‘নবায়ন যোগ্য শক্তি’ খাত। 

শেষকথা

বিশ্বের নতুন বাণিজ্যযুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য এনে দিচ্ছে নতুন সুযোগ। শুধু এই একটি কারণ হয়তো দেশে বিনিয়োগ আনার জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু এই একটি কারণে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগের স্থান খুঁজছে। আর তাদের সামনে নিজেদের বিনিয়োগের সবচেয়ে আদর্শ স্থান হিসেবে তুলা ধরাটাই আসল চ্যালেঞ্জ। 

Previous Post

Next Post

Related Posts

ড. ইউনুসের আবিষ্কার মাইক্রো ক্রেডিট কিভাবে সফল হলো?

03-03-2025

Economy

ড. ইউনুসের আবিষ্কার মাইক্রো ক্রেডিট কিভাবে সফল হলো?

গ্রামীণ ব্যাংক, ক্ষুদ্র ঋণ, সামাজিক ব্যবসা, মাইক্রো...

Read More
যেভাবে আপনার প্রতিষ্ঠান কে বিদেশী বিনিয়োগের উপযোগী করে...

16-10-2024

Economy

যেভাবে আপনার প্রতিষ্ঠান কে বিদেশী বিনিয়োগের উপযোগী করে...

ব্যবসা ও বিনিয়োগ, একটি ছাড়া অপরটির অস্তিত্ব কল্পনা করা...

Read More
বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট নিরসন হবে কিভাবে?

28-08-2024

Economy

বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট নিরসন হবে কিভাবে?

গত বেশ কয়েক বছরে বাংলাদেশের ফরেইন রিজার্ভ নিয়ে...

Read More

Trending

About MAWblog

MAWblog strives to provide a platform for authors, reporters, business owners, academics, people who do writing as a hobby and concerned citizens to let their voices be heard by a wider community. Our goal is to publish contents that are in line with our core goals of promoting sustainable business practices, improving community harmony and facilitating knowledge sharing and ethical labour market practices.

We invite you to write and publish under any of our nine chosen categories and make an impact towards building a better and more sustainable future.

Sign Up for Our Weekly Fresh Newsletter