Home » MAWblog » International » মধ্যপ্রাচ্যের কালো দাগঃ ইজরায়েলের জন্মের ইতিকথা
International
Written by: এস এম নাহিয়ান
31-05-2024
ইজরায়েল। মধ্য প্রাচ্যে যেন এক মস্ত ক্ষতের নাম। প্যালেস্টানিয়ান এবং তার আশে-পাশের রাষ্ট্রের জনগণেরা ইজরায়েলের স্বরুপ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল অনেক আগে থেকেই। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরই ইজরায়েলের পক্ষে। অন্তত ২০২৩ সালের আগ অবধি চিত্রটা তেমনটাই ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে ২০২৪ এর মে, এর মধ্যবর্তী সময়ে এই চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার এখনও ইজরায়েলকে সমর্থন দিয়ে গেলেও, সেসব দেশের অনেক নাগরিকই ইজরায়েলের নিশৃংস বর্ববরতার বিরোধিতা করছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানেও ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ। এমনকি গত ২৪শে মে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস’ গাজা সহ প্যালেস্টাইনের সকল অঞ্চলে ইজরায়লের সকল আক্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
ছবিঃ ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস
কিন্তু বছর খানেক আগেও সকল সহানুভূতি যেন ইজরায়েলের জন্যই ছিল। এই অল্প সময়ে কি হলো যাতে করে বিশ্বের নানা স্থানে এতটাই সমালোচিত ইজরায়েল? মূল এর থেকেই এবারের হত্যাযজ্ঞের নৃশংসতা বোঝা যায়। কিন্তু এ নৃশংসতার উৎপত্তি একদিনে নয়। হাজার বছরের ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে এই সংঘাতে। আর আধুনিক জমানায় ইজরায়েল রাষ্ট্রের গোড়া পত্তনের মধ্যে দিয়েই শুরু হয়েছে যেন রক্তের এই নবধারা। চলুন জেনে আসা যাক এত সমস্যার মূলে থাকা এই রাষ্ট্রটির জন্মানোর ইতিকথা।
ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্মানোর ইতিহাসের সাথে কেনান ভূমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মূলত বর্তমানের ইজরায়েল, পশ্চিম তীর, গাজা, জর্ডান, এবং সিরিয়া ও লেবাননের উত্তরাঞ্চল নিয়েই গঠিত ছিল কেনান ভূমি। আনুমানিক ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এ অঞ্চলে ছিল ‘ইউনাইটেড কিংডম অফ ইজরায়েল’। কিন্তু পরবর্তীতে তা দুই ভাগ হয়ে সৃষ্টি হয় কিংডম অব ইজরায়েল (সামারিয়া) এবং কিংডম অব জুডাহ।
কিন্তু এ দুইটি রাজ্যই পরবর্তীতে দখল হয়ে যায়। কিংডম অফ ইজরায়েল নিও-অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যা দ্বারা ৭২২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দখল হয়। একই পরিণতি ঘটে জুডাহ এর ভাগ্যে। ৫৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নিও-ব্যাবিলনিয়ান সাম্রাজ্য দখল করে জুডাহ। অবশ্য তার কিছু বছরের মধ্যেই ৫৩৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আকিমিনিড সাম্রাজ্যের সাইরাস দ্যা গ্রেট নিও-ব্যাবিলনিয়ান সাম্রাজ্যকে হারিয়ে দেয়। ফলস্বরুপ আবারও কিছু সংখ্যক ইহুদী সে অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করার সুযোগ পায়। সে সময় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ইহুদীরা ৫১৬ খ্রিষ্টপূর্ব্দে নির্মাণ করে তাদের ‘সেকেন্ড টেম্পল’ যা পরবর্তীতে ইহুদী ধর্মের উপর বিশাল প্রভাব রেখেছিলো। এমনকি ৫১৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকেও ইহুদী ধর্ম অনুযায়ী সেকেন্ড টেম্পল পিরিয়ড বলা হয়।
ছবিঃ ইহুদীদের সেকেন্ড টেম্পল
৩৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চিত্রপটে আগমন ঘটে আলেক্সজান্ডার দ্যা গ্রেটের। তার হাতে পতন ঘটে আকিমিনিড সাম্রাজ্যের। পরবর্তীতে ৬৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জুডাহকে দখল করে রোমান সাম্রাজ্য। রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকাকালীন ইহুদীরা একাধিকবার বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু রোমানদের সাথে ইহুদীদের এই যুদ্ধই ইহুদীদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ৬৬-১৩৬ খ্রিষ্টাব্দ, এই দীর্ঘ সময়ে নানা মাত্রার যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এমনকি ৬৬ সালে ইহুদীরা সাময়িক ভাবে বিজয়ীও হয়। কিন্তু ৭০ সালে রোমানরা আবার এ অঞ্চলে ফেরত আসে। এ সময় রোমানদের আক্রমণে ইহুদীদের বিখ্যাত ‘সেকেন্ড টেম্পল’ ধংস্ব হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৩৫ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট হেড্রিয়ান কর্তৃক ইহুদীদের জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত ও নিষিদ্ধ করা হয়। তিনি এমনকি জেরুজালেমে নাম পরিবর্তন করে ‘অ্যাইলা ক্যাপিটোলিনা’ রাখেন এবং ধংস্বপ্রাপ্ত ‘সেকেন্ড টেম্পল’ এর স্থানে জুপিটারের উদ্দ্যেশ্যে মন্দির নির্মাণ করেন। এরই মাধ্যমে ইহুদীরা ওই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয় এবং ইউরোপ সহ বিশ্বের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে পবিত্র ভূমি জেরুজালেম একাধিক ধর্মের শাসক দ্বারা শাসিত হয়েছে। ক্রুসেডার, থেকে শুরু করে সুলতান সালাউদ্দীন। অবশেষে ১৫১৬ সালে জেরুজালেম চলে আসে উসমানী সাম্রাজ্য তথা অটোম্যানদের হাতে। আর এই শাসন চলে প্রায় ৪০০ বছর, ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ অবধি।
পবিত্র ভূমি জেরুজালেম ও এর আশে পাশের অঞ্চল ৪০০ বছর অবধি অটোম্যানদের হাতে থাকলেও তা মুক্ত করার ইচ্ছে ইহুদীদের মন থেকে কখনোই মুছে যায় নি। আর নানা সময়ে সে ইচ্ছার নানা প্রতিফলনের মাধ্যমেই গঠন হয়েছে আজকের রাষ্ট্র ইজরায়েল।
ইহুদী ধর্মাবলাম্বীদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, এই রাজনৈতিক মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন একজন অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাংবাদিক, থিওডর হার্জল। হার্জল মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, শুধুমাত্র একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী ইহুদীদের স্বার্থ রক্ষা করা।
ছবিঃ ইজরায়েলের শেকেলে থিওডোর হার্জল
তারই এ মতবাদ তিনি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন লেখালেখি। যা আজ সারা বিশ্বজুড়ে পরিচিত জায়োনিজম নামে। ১৮৯৬ সালে থিওডর হার্জল লেখেন ‘ইউডেন্সটা’। যার ইংরেজী অর্থ হলো ‘দ্যা জিউশ স্টেট’। তার ঠিক পরের বছরেই তিনি অস্ট্রো-হাঙ্গেরির বাজেলে আয়োজন করেন প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেসের। সেই কনফারেন্সের মাধ্যমেই ইউরোপে বসবাসরত ইহুদীদের বুকে জায়োনিজমের বীজ বপন হয়। এ সম্পর্কে থিওডর হার্জলের একটি বক্তব্য উল্লেখ না করলেই নয়।
‘আমি ইহুদী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছি। আর আগামী ৫ বছর, অথবা অবশ্যই আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সকলে এটি অনুভব করবে’।”
হার্জলের বক্তব্য ভুল ছিল না। এ ভবিষ্যতবাণীর ঠিক ৫১ বছরের মাথাতেই জন্ম হয় রাষ্ট্র ইজরায়েলের।
জায়োনিজমের প্রবক্তা তার প্রথম কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করার মাত্র ৭ বছরের মধ্যেই হটাৎ মৃত্যুর কবলে পতিত হয়। কিন্তু ১৯০৪ সালে তার এই মৃত্যু জায়োনিজমের আগুনকে নিভিয়ে দেয় নি। ততদিনে অনেক ইউরোপীয় ইহুদীদের মনেই তাদের হারানো ভূমিতে নতুন ইহুদী রাষ্ট্র স্থাপনের আশা জেগে উঠেছে। এরই মধ্যে একজন ছিলেন কাইম ওয়াইজম্যান। রাশিয়াতে জন্মানো এই ইহুদী বেড়ে ওঠেন বেলারুশে। ৩০ বছর বয়সে তিনি পাড়ি জমান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে। বায়োকেমিস্ট্রির একজন প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টারে।
ছবিঃ কাইম ওয়াইজম্যান (Chaim Weizzman)
১৯০৫ সালে ওয়াইজম্যানের দেখা হয় আর্ল আর্থার বেলফোরের সাথে। তিনি তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে। ধারনা করা হয় তখন থেকেই ওয়াইজম্যান বেলফোরকে জায়োনিজমের পক্ষে প্রভাবিত করেন। পরবর্তী ১০ বছরে ওয়াইজম্যান তার বিজ্ঞান গবেষণা এবং জায়োনিজম, দুটির বিস্তারই করে চলেন ব্যাপক ভাবে। ১৯১৫ সালে তার ভাগ্যের চাকা অনেকটাই ঘুরে যায়। তারই একটি আবিষ্কার ছিল ওয়াইজম্যান প্রসেস। যা ছিল ব্যাক্টেরিয়াল ফার্মেন্টেশনের মাধ্যমে অ্যাসিটন তৈরি করার প্রক্রিয়া। কিন্তু অ্যাসিটনের সাহায্যে কিভাবে ভাগ্যের চাকা ঘুরলো ওয়াইজম্যানের?
মূলত এই অ্যাসিটন ব্যবহৃত হতো ধোয়ামুক্ত গান পাউডার তৈরির প্রক্রিয়ায়। আর ১৯১৪ আল থেকে চলা যুদ্ধের কারণে এই অ্যাসিটন ছিল মহামূল্য বস্তু। যুদ্ধের আগে ব্রিটেন জার্মানি থেকে অ্যাসিটন আমদানি করতো। কিন্তু যুদ্ধের সময় তার উপায় ছিল না। সে সময়ই ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ওয়াইজম্যানের ওয়াইজম্যান প্রসেস। তৎকালীন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল উইন্সটন চার্চিলের নজরে আসে এই আবিষ্কার। ফলে কাইম ওয়াইজম্যানকে নিযুক্ত করা হয় ব্রিটিশ অ্যাডমিরালিটি ল্যাবের প্রধান হিসেবে।
ছবিঃ কাইম ওয়াইজম্যান এবং আর্থার বেলফোর্ড
ওয়াইজম্যান তার অবস্থানের ক্ষমতা প্রয়োগ করে ব্রিটিশ উপরমহলে আরও প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে নেন। ধারনা করা হয়, তার এই অ্যাসিটন তৈরির প্রক্রিয়ার বদৌলতেই তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোরকে ঐতিহাসিক ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’ দিতে প্রভাবিত করতে সমর্থ হন।
‘বেলফোর ডিক্লারেশন’ বা বেলফোর ঘোষণা। ইজরায়েল রাষ্ট্র তৈরির প্রামাণ্য দলিল হিসেবে অনেকে একেই গণ্য করেন। ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর আর্থার বেলফোর ফ্রান্সের ইহুদী ধনকুবের লর্ড লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি লেখেন। ব্রিটিশ সংসদ সেই চিঠিটিকে অফিসিয়াল স্বীকৃতি দেয়।
ছবিঃ ঐতিহাসিক বেলফোর ঘোষণা
কিন্তু কি ছিল সেই চিঠিতে? লর্ড আর্থার বেলফোর ঘোষণা করেন যে, ব্রিটিশদের দখলকৃত প্যালেস্টাইনের ভূমিতে তাদের একটি স্বাধীন ইহুদী রাষ্ট্র গঠনে ইচ্ছে রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হলো, সেই ভূমিতে হাজার বছর ধরে বসবাসরত আরব তথা প্যালেস্টাইনিয়ানদের মতামতের কোনো তোয়াক্কাই করা হয় নি এ ঘোষণাতে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পর এ ঘোষণার গুরুত্বও হয়তো শেষ হয়ে যেত। কিন্তু তা হতে দেয় নি কাইম ওয়াইজম্যান। একে তিনিই প্রথম ‘বেলফোর ঘোষণা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। যুদ্ধের সময় সহায়তা বৃদ্ধি করতে নিছক এক বুলি নয়, বরং নিজেদের কথা মতো চলতে ব্রিটিশদের উপর চাপ সৃষ্টি করেন ওয়াইজম্যান।
১ম বিশ্বযুদ্ধের পরেই মহান অটোম্যান তথা উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। বিজয়ী দেশ গুলোর ইন্ধনে স্থাপিত হয় ‘লীগ অব নেশনস’। অতঃপর ‘ম্যান্ডেট’ নামক অদ্ভুত এক নিয়মে চলতে শুরু করে প্যালেস্টাইন। আরব দেশ গুলো স্বাধীনতা পেলেও স্বাধীনতা পায় নি প্যালেস্টাইন। যদিও প্যালেস্টাইনের আরবেরা ১৯২০ সালের ২০শে মার্চ দামেষ্কের সিরিয়ান কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করে। সেখানে প্যালেস্টাইন সহ ‘ইউনাইটেড সিরিয়া’ এর রাজা মনোনীয় হন ফয়সাল (প্রথম)। যদিও তা ফলপ্রসূ ছিল না। সেই বছরেরই এপ্রিল মাসে ইটালির একটি সভাতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স প্যালেস্টাইন সহ আশে পাশের ভূমি ম্যান্ডেট এর মাধ্যমে নিজেদের করে নেয়।
ছবিঃ ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ ম্যান্ডেট
আরবদের অসম্মতি সত্ত্বেও ১৯২০ এর জুলাই মাসে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট এর দায়িত্ব দেওয়া হয় স্যার হার্বাট স্যামুয়েল নামক এক জায়োনিস্টকে। তার ছত্রছায়ায় শুরু হয় বেলফোর ঘোষণা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া। প্রথম বছরেই পূণ্যভূমিতে আসে ১৬,৫০০ ইহুদী। পরবর্তী বছর গুলো জুড়ে ইহুদীদের আগমনের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। ১৯২১ সালে আরব নেতারা লন্ডনে যেয়ে বেলফোর ঘোষণার বিরোধিতা করলেও কোনো লাভ হয় নি। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী ধনী ইহুদীদের অনুদানে গঠিন জায়োনিস্ট ন্যাশনাল ফান্ডের মাধ্যমে ইহুদীরা খুব দ্রুত নিজেদের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে শুরু করে। অপরদিকে বিতাড়িত হতে শুরু করে আরবরা। পরবর্তী বছর গুলোতে এই অঞ্চলে আরব মুসলিম এবং ইহুদীদের একাধিক বার সংঘর্ষ হয়েছে। কিন্তু ব্রিটেন ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের ছত্রছায়ায় বাড়তে থাকে ইহুদী প্রভাব কোনো ভাবেই দমিয়ে রাখা সম্ভব হয় নি।
১৯৩৩ সাল। জার্মানিতে নাজি বাহিনীর ক্ষমতায় আরোহণ। তার পর পরই প্যালেস্টাইনে ইহুদীদের সংখ্যা ব্যাপক ভাবে বাড়তে থাকে। ১৯৩৩ সালে নতুন আগমনকারী ইহুদীর সংখ্যা ছিল ৩৩,০০০। ১৯৩৪ সালে যা হয় ৪২,০০০। ১৯৩৫ সালে তা হয় ৬১,০০০।
১৯৩৯ সাল। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তবে এই পুরো যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ও জায়োনিস্টদের অবস্থান মুখোমুখি হয়ে যায়। জায়োনিস্টদের বক্তব্য ছিল যত বেশি সম্ভব ইহুদী প্যালেস্টাইনে অভিবাসন করা। কিন্তু ওই অঞ্চলের ভারসাম্য রক্ষায় তাতে বাধ সাধে ব্রিটেন। ব্রিটেনের এই প্রচেষ্টায় দুইটি ইহুদী রিফিউজি জাহাজ বিধ্বস্ত হয়। ফলস্বরুপ জায়োনিস্ট উগ্রবাদীরা সারা ব্রিটেন জুড়েও নানা ধরনের হত্যা চেষ্টা চালায়। নিহত হয় ব্রিটিশ স্টেট মিনিস্টার সহ একাধিক ব্যক্তি।
ছবিঃ হলোকাস্ট ক্যাম্পে বন্দী ইহুদীগণ মুক্তির পর
তবে যুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে জায়োনিস্টদের অফিসিয়াল অবস্থান ব্রিটেনের পক্ষেই ছিল। ২৭,০০০ সেনা নিয়ে গঠিত ইহুদী বাহিনী যোগ দেয় ব্রিটেনের ৮ম আর্মিতে। তবে আসল সমীকরণ ঘুরতে শুরু করে ১৯৪৫ সালে। মিত্র বাহিনী কর্তৃক নাজিদের হলোকাস্ট ক্যাম্প খুঁজে বের করার পর ইহুদীদের মানবেতর জীবন-যাপনের দেখে তাদের প্রতি বিশাল জনসমর্থন তৈরি হয়। সে সময় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্র্যুম্যান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন ১ লক্ষ ইহুদীকে প্যালেস্টাইনে স্থানান্তর করার জন্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্যালেস্টাইনের অঞ্চলে ভয়াবহ অস্থিরতা শুরু হয়। সে সময় আরবদের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় ব্রিটিশ সরকার ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বন্ধ করতে চাইলেও সে অস্থিরতা সামলানোর উপায় তাদের ছিল না। একই সাথে চলতে থাকে জায়োনিস্টদের অবৈধ অভিবাসন। উগ্রবাদী জায়োনিস্টদের হামলায় ১৯৪৬ সালের ২২শে জুলাই কিং ডেভিড হোটেল ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়। ফলস্বরূপ সেখানে প্রাণ হারায় ৯১ জন সরকারি ও বেসামরিক ব্রিটিশ কর্মকর্তা।
যুদ্ধ শেষে ব্রিটেন বিজয়ী হলেও তাদের অর্থনীতির অবস্থা ছিল করুণ। তাই ভারতের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য থেকেও তাদের কলোনী গুটিয়ে নেওয়ার সিধান্ত নেয় ব্রিটেন। অবশেষে ব্রিটেন শাসিত রক্তস্নাত প্যালেস্টাইনের দায়িত্ব নেয় নবগঠিত জাতিসংঘ। জাতিসংঘের একটি স্পেশাল কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী সাধারণ সভায় এ অঞ্চলকে বিভক্ত করার সিধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াতেই কোনো মতামত নেওয়া হয় নি সেখানে বসবাসরত আরবদের।
অতঃপর আরবরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকা সত্ত্বেও প্যালেস্টাইনের অর্ধেকের বেশি জমি ইহুদীদের দিয়ে রাষ্ট্র গঠনের সিধান্ত দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের ৩১ শে মার্চ গৃহীত এ সিধান্তে স্বভাবতই খুশি ছিল জায়োনিস্টরা। কিন্তু ক্ষুব্ধ প্যালেস্টাইনিয়ানদের সাথে দ্রুতই সংঘাত সৃষ্টি হয় জায়োনিস্টদের। শুরু হয় প্রথম গৃহযুদ্ধ। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে আরব লীগ প্যালেস্টাইনের সমর্থনে ৩,০০০ সৈন্য প্রেরণ করে। ক্রমবৃদ্ধিমান সংঘাতের কারণে আমেরিকা এবং জাতিসংঘ দুই পক্ষই কিছুটা নড়ে চড়ে বসে। এমনকি ১৯৪৮ সালের মার্চের ৩০ তারিখ যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষের ভেতর শান্তি চুক্তি করে অবস্থান নতুন ভাবে পর্যালোচনার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু জায়োনিস্টরা তা কোনো ভাবেই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। জায়োনিস্টদের ক্রমাগত আক্রমণে পর্যদুস্থ হয়ে পড়ে আরব বাহিনী। সে সময় ইহুদী বা জায়োনিস্টদের যেই বাহিনী ছিল তার নাম ছিল হাগানাহ। হাগানাহ এর বাহিনী ছিল আরবদের তুলনায় অনেক সুসজ্জিত এবং অভিজ্ঞ। তাদের সুচিন্তিত আক্রমনে হাইফা এবং জাফফা দ্রুতই তাদের দখলে চলে যায়।
ছবিঃ হাগানাহ বাহিনী বহনকারী জাহাজ
অবশেষে মে মাসের ১৪ তারিখে ব্রিটিশ হাই কমিশনার, জেনারেল স্যার অ্যালান কানিংহাম প্যালেস্টাইন ত্যাগ করেন। সেই দিনই ইজরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। জন্মের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডে ফ্যাক্টো’ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এর ‘ডে জুরে’ স্বীকৃতি অর্জন করে নেয়। কিন্তু আরব দেশগুলো তা কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি। ১৫ মে সিরিয়া, জর্ডার, ইরাক, এবং মিশরের সেনাবাহিনী প্যালেস্টানিয়ান বাহিনীর সাথে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়। কিন্তু ইজরায়েল পশ্চিমা অস্ত্রে সুসজ্জিত বাহিনী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত দক্ষ অফিসার, ও পশ্চিমাদের সরাসরি সহায়তায় ৯ মাসের ভেতর সে যুদ্ধের অবসান ঘটায়। আর এ সময়ের ভেতরেই বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জায়োনিস্টরা অর্জন করে নেয় ৫০টিরও অধিক দেশের স্বীকৃতি। যুদ্ধের শেষে দেখা যায় ইজরায়েল শুধু তাদের জন্য বরাদ্দকৃত যায়গা নয়, বরং আরবদের ভূমির ৬০ ভাগও দখল করতে সক্ষম হয়েছে। যার ভেতর ছিল জাফফা, লিডা, রামি, গ্যালিলি এবং অন্যান্য। এ যুদ্ধে জর্ডান ও সিরিয়া অল্প কিছু জমির দখল রাখতে সফল হয়। জর্ডানের উদ্ধারকৃত ভূমি পরবর্তীতে ওয়েস্ট ব্যাংক এবং সিরিয়ার উদ্ধারকৃত ভূমি পরবর্তীতে গাজা স্ট্রিপ নামে পরিচিত হয়। এভাবেই উথান হয় রাষ্ট্র ইজরায়েলের। এবং শুরু হয় ৭৬ বছর ধরে চলতে থাকা নিপীড়নের।
ঠিক এভাবেই নানা কূটনীতি, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং অবৈধ দখলদারিত্বের মাধ্যমে জন্ম হয় রাষ্ট্র ইজরায়েলের। যার ফল বর্তমানে শুধু প্যালেস্টাইন নয় বরং মধ্য প্রাচ্যের প্রতিটি রাষ্ট্রই ভুগছে। আজও ইজরায়েলের টিকে থাকার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবের। আর সেই প্রভাবের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বিশ্ব জুড়ে থাকা ধনী, ক্ষমতাবন জায়োনিস্টদের। বর্তমানে রাষ্ট্র ইজরায়েলের যেই প্রচন্ড ক্ষমতা, অর্থনৈতিক শক্তি, এবং কূটনৈতিক প্রভাব, তার কোনোটাই একদিনে গঠিত হয় নি। এত বছরের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা, নিখুঁত পরিকল্পনা, দৃড় মনোভাগ এসবের কারণেই আজ বিশ্ব দরবারে তাদের এত শক্তিশালী অবস্থান। আর তার মূল্য চুকাতে হয়েছে সাধারণ প্যালেস্টাইনিয়ানদের। নিজের ভূমি, অর্থ, সম্পদ ও এমনকি জীবন দিয়ে।
তথ্যসূত্র
১। What Happened on May 28 | HISTORY
২। Palestine - The Arab Revolt | Britannica
৩। More than a century on: The Balfour Declaration explained | Features | Al Jazeera
৪। Chaim Weizmann | Zionist Leader, Israeli President, Scientist | Britannica
৫। Mapping which countries recognise Palestine in 2024 | Israel-Palestine conflict News | Al Jazeera
৭। Al-Nakba: The Palestinian catastrophe - Episode 1 | Featured Documentary (youtube.com)
৮। How Israel Was Created | AJ+ (youtube.com)
৯। Palestine 1920: The Other Side of the Palestinian Story | Al Jazeera World Documentary (youtube.com)
24-11-2024
International
আধুনিক পৃথিবীতে যে নির্বাচনটি বিশ্বের উপর সবচেয়ে বেশি...
Read More21-11-2024
International
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) বিশ্বের অন্যতম প্রধান...
Read More14-11-2024
International
সত্য নাদেলা মাইক্রোসফটের সিইও হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের...
Read MoreTop 10 in...
03-10-2022
Miscellaneous...
20-08-2024
Miscellaneous...
10-12-2023
International...
03-10-2024
MAWblog strives to provide a platform for authors, reporters, business owners, academics, people who do writing as a hobby and concerned citizens to let their voices be heard by a wider community. Our goal is to publish contents that are in line with our core goals of promoting sustainable business practices, improving community harmony and facilitating knowledge sharing and ethical labour market practices.
We invite you to write and publish under any of our nine chosen categories and make an impact towards building a better and more sustainable future.