Print World

Economy

অ্যাপলের বিবর্তনঃ গ্যারেজ থেকে টেক জায়ান্ট

Written by: Suraiya Zaman

26-10-2023

অ্যাপলের বিবর্তনঃ গ্যারেজ থেকে টেক জায়ান্ট



অ্যাপল নামটা শুনলেই আধ-খাওয়া আপেলের ছবি চোখে ভাসে না- এমন মানুষ আজকের সময়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অন্যদিকে গ্যাজেট এবং ডিভাইসপ্রেমী মানুষের পছন্দের তালিকায় সবসময়ই  শীর্ষে থাকে এই আধ-খাওয়া আপেলের লোগোওয়ালা ব্র্যান্ড। কিন্তু কি আছে এই ব্র্যান্ডে? কেনো এবং কিভাবে এই আধ-খাওয়া আপেলের ছবিওয়ালা যেকোনো পণ্যই এখনকার মানুষের উইশলিস্টে জায়গা করে নিয়েছে? আজ জানবো অ্যাপলের যাত্রা শুরুর ইতিহাস, অগ্রগতি এবং গ্রোথ স্ট্রাটেজি সম্পর্কে। 


অ্যাপলের জন্ম

১৯৭৬ সালের কথা। স্টিভ জবসের বয়স তখন ২২ এর কোটায়। তিনি এবং তার এক বন্ধু স্টিভ ওজনিয়াক মিলে সিদ্ধান্ত নেন তারা একটি ব্যবসা শুরু করবেন। এরপর জবসের পারিবারিক গ্যারেজে তারা সার্কিট বোর্ড বিক্রয়ের মাধ্যমে নিজেদের ব্যবসা শুরু করেন। তখন ওজনিয়াক একক প্রচেষ্টায় অ্যাপল ১ কম্পিউটার উদ্ভাবন করেন। ওজনিয়াক কম্পিউটারটি জবসকে দেখালে, জবস তা বিক্রয় করার পরামর্শ দেন। এবং তখনই তারা এটিকে বিক্রয়ের জন্য রোনাল্ড ওয়েনকে সাথে নিয়ে জবসের সেই গ্যারেজেই অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন।

এভাবেই ১৯৭৬ সালের পহেলা এপ্রিল, জবস এবং তার দুই বন্ধু ওজনিয়াক এবং রোনাল্ড ওয়েন, এই তিনজনের মাধ্যমে ক্যালিফোর্নিয়ার ছোট্ট একটা গ্যারেজে অ্যাপল কোম্পানির প্রতিষ্ঠা হয়। তখন তারা তাদের কোম্পানির নাম দেন “অ্যাপল কম্পিউটার কোম্পানি”। অ্যাপলের প্রাথমিক সহ-প্রতিষ্ঠাতা রোনাল্ড ওয়েন যদিও পরবর্তীতে অ্যাপল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।

অ্যাপলের নাম কেনো অ্যাপল রাখা হলো এই নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। তবে ওজনিয়াকের মতে, জবসই এই নামের রক্ষাকর্তা। একদিন আপেলের সন্ধানে তাকে একটা আপেল বাগানে যেতে হয়েছিলো। সেখানেই তার মাথায় খেলে যায় এই ভাবনা। তিনি ভাবেন, আপেল নামটি উচ্চারনে সহজ। এর থেকে সহজবোধ্য নাম আর কিছু হতে পারে না তার সংস্থার জন্যে। এরপর তিনি এই নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই সংস্থার একটি মজাদার লোগো আঁকার দায়িত্ব দেন রব জ্যানফ’কে। রব সাত-রঙে আঁকেন আধ-খাওয়া আপেলের ছবি, ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত এই লোগোটিই ব্যবহার করে সংস্থাটি। যদিও এর আগে নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার দৃশ্যটি লোগো হিসেবে কিছুদিন ব্যবহৃত হয়েছিলো। ১৯৯৮ এর পর অ্যাপলের আরো কিছু লোগো প্রস্তাবিত হয় এবং পরবর্তীতে আপেলের ছবিটি কালো করে দেওয়া হয়।


অ্যাপলের উত্থান

কোনো বড় প্রতিষ্ঠানই নানা চড়াই-উৎরাই পার হওয়া ছাড়া একদিনে বড় হতে পারেনি। তেমনি অ্যাপলের যাত্রাও ছিলো বন্ধুর। প্রতিষ্ঠার কিছু বছর পর ইন্টেলের তত্কালীন অর্ধ-অবসরপ্রাপ্ত পন্য বিপণন ব্যবস্থাপক মাইক মার্ককুলা তাদেরকে অর্থ সহায়তা প্রদান করেন।

এরপর ১৯৭৮ সালে ওজনিয়াক একটি স্বল্প মূল্যের হার্ড ডিস্ক ড্রাইভ তৈরি করেন যা সকলের নির্ভরযোগ্যতা অর্জন করে। এর স্পিড বেশি হওয়ায় অ্যাপল ২ নামক এই কম্পিউটার অনেক নিবেদিতপ্রাণ প্রোগ্রামারদের পছন্দের কম্পিউটারে পরিণত হয়। এটি বাজারজাত করার পরপরই এর জন্য বোস্টন'র দুজন প্রোগ্রামার ড্যান ও ভিসি নামক একটি প্রোগ্রাম তৈরি করে যা হার্ড ডিস্ক ব্যবহারকে অনেক সহজ করে দেয় এবং এতেই অ্যাপলের লাক ফেভার করতে শুরু করে। অ্যাপলের হার্ড ডিস্কের বাজার বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে ১৯৯০ সালের পরপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে এর ব্যবহার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। 

অ্যাপল একটি কম্পিউটার কোম্পানি হলেও এটি শুধু কম্পিউটার বিক্রয় করেই ক্ষান্ত থাকেনি। উত্তরাত্তর সফলতা পেয়ে বরং আরো বড় হবার স্বপ্ন দেখেছে। অ্যাপলকে আরো বড় করার জন্য জবস তার ভোক্সওয়াগন মিনিবাস এবং ওজনিয়াক তার প্রোগ্রামেবল ক্যালকুলেটর বিক্রি করে দেন।

সন্তানসম এই কোম্পানি থেকে ১৯৮৫ সালে জবস বিরতি নিয়েছিলেন কিছু কারনে। একটি পণ্যের উপর নির্ভর থাকায় ৮০ এর দশকের মাঝামাঝি এই সংস্থাকে আর্থিক সংকটে পড়তে হয়। একই সময়কালে, উইন্ডোজ চলমান বাজারে সস্তা কম্পিউটার বিক্রি করে আসছিল যা মিড রেঞ্জ মানুষের কাছে অনেক বেশি বড় মার্কেট তৈরী করে হোম কম্পিউটারের চাহিদা পূরন করে চলেছিল। তাই এই আর্থিক খরা কাটিয়ে উঠতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছিলো অ্যাপলকে।

এরপর ১৯৯৭ সালে আবার অ্যাপলে ফিরে আসেন স্টিভ জবস। সেই থেকে কোম্পানিটির ফের উত্থানের শুরু। এই টেক জায়ান্ট অ্যাপল যে মোজা বানাত, তা কি আপনারা জানেন? অ্যাপল সত্যিই বছর পনেরো আগে এমন পণ্য বের করেছিল। একে একে অ্যাপলের আইম্যাক, আইপড, আইফোন ও আইপ্যাড বাজার দখল করে রাখলেও অ্যাপলের কিছু পন্য বাজারে বেশিদিন টিকতে পারেনি। অ্যাপলের মোজা এরমধ্যে অন্যতম। তবে এটি পায়ে পরার মোজা নয়। আইপড সকস নামের এই মোজা সহ অ্যাপলের আইপড বাই এইচপি, অ্যাপল ম্যাকফোন, আইপড হাই-ফাই, অ্যাপল টাইম ব্যান্ড, ইওয়ার্ল্ড, ম্যাকিনটোশ ব্যাশফুল, দ্য অ্যাপল কালেকশন- এই উদ্যোগগুলো বাজারে টিকতে না পেরে অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়। 


আইফোন 

ম্যাকওয়ার্ল্ড এক্সপোতে ২০০৭ সালের ৯ই জানুয়ারী, আইফোন নামক অভিনব এক ফোনের ঘোষণা করে অ্যাপল। বাজারে আসার আগেই প্রথম ৩০ ঘন্টায় ২৭০০০০ আইফোন বিক্রি হয়ে যায়, ফলে এই ফোন ‘গেইম চেঞ্জার অব ইন্ড্রাস্ট্রি’ হিসেবে অল্প সময়েই পরিচিত লাভ করে। পাশাপাশি আইফোন, আইপড টাচ এবং আইপ্যাড পণ্য প্রবর্তনের মাধ্যমে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করতে থাকে আইফোন। প্রতি বছর তাদের যাত্রা এক নতুন দিগন্তে পা দিতে থাকে। আইফোনের ফিচার, ডিজাইন এবং চাহিদা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হতে থাকে। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে আইফোনের নাম। ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর কোটি মানুষের স্বপ্ন এই আইফোনের লেটেস্ট ভার্সনটি। 


গ্রোথ স্ট্রাটেজি

১,৩২০০০ মানুষের কর্মসংস্থানের এই অ্যাপল প্রতিষ্ঠান বিশ্বে প্রথম ট্রিলিয়নার হিসেবে সৃষ্টি করেছে এক নতুন ইতিহাস। 

গ্যারেজের আধো-অন্ধকার থেকে ইতিহাস সৃষ্টির এই যাত্রায় তাদের সবচেয়ে বড় স্ট্রাটেজি ছিলো সময়ের সাথে ক্রেতার চাহিদার তুলনা করা। তারা কোনোরকম ব্যবসা করে বাজারে টিকে থাকতে চায়নি, বরং নিজেদের অস্তিত্ব বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে তারা টার্গেট করেছে ধনী ক্রেতাদের। নতুন ফিচারে, নতুন আদলে বাজারে নতুন পণ্য আনার আগে তারা মাথায় রেখেছে মানুষের রূপান্তরিত চাহিদার নতুনত্বের কথা। মানুষের বদলানো সেই রুচির নাটাই ধরার প্রতিযোগীতায় সবসময় এগিয়ে থাকতে অ্যাপল কখনো পণ্যের মানের সাথে আপোষ করেনি। তারা জানে, প্রযুক্তির এই যুগে শখ এবং স্বপ্নের ডিভাইসটি মানুষ ঠিকই নিজের করে নিবে। 

জনসাধারনের মুঠোয় পৌঁছাতে পণ্যের মানের সাথে আপোষ না করার এই বিষয়টি তাদের অন্যতম গ্রোথ স্ট্রাটেজি। 

এছাড়াও ‘অ্যাপল ইকোসিস্টেমের’ প্রায় সব পণ্যের সহজ ব্যবহার প্রচণ্ডভাবে ভোক্তাদের আকৃষ্ট করে। প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড হিসেবে অ্যাপল সবসময়ই এই স্ট্রাটেজিকে কাজে লাগিয়ে এসেছে। পণ্যের গুন, মান, আধুনিকতা এবং নতুনত্বের পাশাপাশি অ্যাপল সবসময়ই ইনডিভিজ্যুয়াল ক্রেতাকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে থাকে, ভোক্তা আকর্ষনের এই দিকটি অন্যান্য টেক ব্র্যান্ডের থেকে অ্যাপলকে সবসময় আলাদা করে রেখেছে। 

আজ অ্যাপলের পণ্য কিনতে অ্যাপল স্টোরের সামনে লম্বা লাইন পড়ে যায়। সৃষ্টিতে বিশ্বাসী এই ব্র্যান্ডটি নিত্যনতুন আর বৈচিত্রপূর্ণ পণ্যগুণেই ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জিনস, টার্টলনেক ফুল হাতা কালো টি শার্ট আর কেডস পরিহিত স্টিভ মানেই আইকনিক আধ-খাওয়া অ্যাপল আর সাফল্যের প্রতিমূর্তি। তার হাত ধরেই অ্যাপল আজ কোটি মানুষের স্বপ্ন। বহমান নদীর স্রোতের মতো সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে অ্যাপলের পরবর্তী আকর্ষন হতে চলেছে ইলেকট্রিক গাড়ি, যা ইতোমধ্যে গাড়িপ্রেমীদের চেকলিস্টে নাম লিখিয়ে ফেলেছে। হয়তো আগামী ৫০ বছরের মধ্যে নতুন কোনো আবিষ্কারে অ্যাপল কল্পনাতীত কোনো সাফল্যের দ্বার উন্মোচন করতে পারে, কে বলতে পারে!

 

স্টিভ জবস যেমন নিজের গ্যারেজে খুব ছোট্ট পরিসরে ব্যবসা শুরু করে আজ ওয়ার্ল্ড বিজনেস আইকন, ঠিক তেমনি মাত্র ১৬ টাকা পুঁজি দিয়ে শুরু করে বাংলাদেশে বিজনেস আইকন হয়েছিলেন একজন। পড়তে পারেন আকিজ উদ্দিনের গল্প - মাত্র ১৬ টাকা থেকে ১৬ হাজার কোটি টাকার প্রতিষ্ঠান যেভাবে গড়ে উঠলো।

 

Q/A

১। অ্যাপলের পণ্যগুলোর এতো দাম হবার কারন কি?

উত্তরঃ নিজস্ব প্রযুক্তি, ফ্ল্যাগশিপ প্রোডাক্ট, ব্র্যান্ডিং, সাপ্লাই চেইন, অপারেশন ইত্যাদি অনেক কারনে অ্যাপলের পণ্যগুলোর দাম অনেক বেশি, যা মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। 

২। আইফোনের অসুবিধাগুলো কি কি?

উত্তরঃ সব ডিভাইসেরই কিছু সুবিধা অসুবিধা রয়েছে। আইফোনের ক্ষেত্রেও তাই।

সাধারনত ম্যাপিং, ওয়েব ব্রাউজিং ও মেইলে ডিফল্ট অ্যাপ ইত্যাদি অসুবিধার মুখোমুখি হয়ে থাকেন আইফোন ইউজাররা। 

Previous Post

Next Post

Related Posts

যেভাবে আপনার প্রতিষ্ঠান কে বিদেশী বিনিয়োগের উপযোগী করে...

16-10-2024

Economy

যেভাবে আপনার প্রতিষ্ঠান কে বিদেশী বিনিয়োগের উপযোগী করে...

ব্যবসা ও বিনিয়োগ, একটি ছাড়া অপরটির অস্তিত্ব কল্পনা করা...

Read More
বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট নিরসন হবে কিভাবে?

28-08-2024

Economy

বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট নিরসন হবে কিভাবে?

গত বেশ কয়েক বছরে বাংলাদেশের ফরেইন রিজার্ভ নিয়ে...

Read More
মুদ্রাস্ফীতির একাল সেকাল

23-05-2024

Economy

মুদ্রাস্ফীতির একাল সেকাল

বাংলাদেশের জনজীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ যেন এখন...

Read More

Trending

About MAWblog

MAWblog strives to provide a platform for authors, reporters, business owners, academics, people who do writing as a hobby and concerned citizens to let their voices be heard by a wider community. Our goal is to publish contents that are in line with our core goals of promoting sustainable business practices, improving community harmony and facilitating knowledge sharing and ethical labour market practices.

We invite you to write and publish under any of our nine chosen categories and make an impact towards building a better and more sustainable future.

Sign Up for Our Weekly Fresh Newsletter