Print World Header Banner 2

Sustainable Development

ড. ইউনুসের নতুন বিপ্লবঃ থ্রি জিরো থিওরি

Written by: এস এম নাহিয়ান

13-04-2025

ড. ইউনুসের নতুন বিপ্লবঃ থ্রি জিরো থিওরি

গত মাস সাতেক ধরে বাংলাদেশের হাল ধরেছেন ডক্টর ইউনুস। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি কেমন তা নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকতে পারে, কিন্তু অর্থনীতিবিদ হিসেবে তিনি যে সেরাদের কাতারে, সেটা নিয়ে ভিন্নমতের তেমন সুযোগ নেই। ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসা, এই দুইটি ধারনাকে তিনি শুধু বাংলাদেশেই না, বরং ছড়িয়ে দিয়েছেন পুরো বিশ্বে। 

সামাজিক ব্যবসার ধারনাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে এই মূহুর্তে কাজ করছে ৪০টি দেশের ১১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইউনুস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’। এই সোশ্যাল বিজনেস বা সামাজিক ব্যবসা পুরো পৃথিবীর ব্যবসায়িক চিন্তা ধারার মোড়ই ঘুরিয়ে দিয়েছে। উন্মোচন করেছে সম্পূর্ণ নতুন একটি দিক। 



সেই অর্থনীতিবিদ ডক্টর ইউনুসেরই আরেকটি মতবাদ এই ‘থ্রি জিরো’। যেটিকে বর্তমান বিশ্বের দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বিমোচন এবং পরিবেশ রক্ষা করার অন্যতম কার্যকরী মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।


থ্রি জিরো থিওরি কি? 

থ্রি জিরো থিওরিকে একটা নতুন মতবাদ বা অর্থনীতির নতুন একটা ধারা বললেই বোধহয় ঠিক হবে। ডক্টর ইউনুসের কথা মতে, বর্তমানে পুঁজিবাদের যেই ধারা চলছে, তা শুধু মাত্র অল্প কিছু মানুষকেই সুবিধা দেওয়ার জন্য তৈরি। আর এভাবেই যদি চলতে থাকে, তাহলে কিছু বছর পরে বেকারত্ব, দারিদ্য, এসব সমস্যা কমবে তো নাই, বরং আরও অনেক বাড়বে। 

একই সাথে বিশ্বের তিনটি প্রধান সমস্যা; অর্থাৎ দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং কার্বন নিঃসরণ, সমাধানে তাই ডক্টর ইউনুস ব্যক্ত করেছেন ‘থ্রি জিরো থিওরি’। তার এই থিওরি অনুসারে নতুন বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামো হওয়া উচিত এই থ্রি জিরোর উপর নির্ভর করে। থ্রি জিরো বলতে ‘জিরো প্রোভার্টি, জিরো আনএমপ্লয়মেন্ট’ এবং জিরো নেট কার্বন এমিশন’।  এ মতবাদ আরও দৃড় রুপ পায়  ২০১৭ সালে যখন ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস ‘A World of Three Zeros: The New Economics of Zero Poverty, Zero Unemployment, and Zero Net Carbon Emissions’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। 




কিভাবে কাজ করবে এই থ্রি জিরো থিওরি? 

স্বাভাবিক ভাবেই থ্রি জিরো থিওরির পিলার মূলত তিনটি।  তার প্রথমেই রয়েছে জিরো প্রভার্টি তথা দারিদ্যমুক্ত পৃথিবী। 


জিরো প্রভার্টি 

জিরো প্রভার্টি বা শূণ্য দারিদ্র্য বাস্তবায়নে ইউনুসের সমাধান হলো ‘সামাজিক ব্যবসা’। অর্থাৎ তিনি নিজে যেই ব্যবসায়িক ধরনের প্রবর্তক, সেটিকেই ডক্টর ইউনুস দেখছেন দারিদ্র্য বিমোচনের হাতিয়ার হিসেবে। এই থিওরি অনুসারে সামাজিক ব্যবসার মডেলই পারে সমাজের দারিদ্য দূর করতে। 


কি এই সামাজিক ব্যবসা?

সামাজিক ব্যবসা বা ‘সোশ্যাল অন্ট্রপ্রনারশিপ’ (Social Entrepreneurship) হলো এমন এক ধরনের বিজনেস মডেল যেখানে ব্যবসা শুধু মাত্র মুনাফার জন্য পরিচালনা না করে, সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। 

অর্থাৎ এই ধরনের ব্যবসার প্রাথমিক লক্ষ্য থাকে ব্যবসার মূলধন উঠিয়ে আনা। এর বাইরে নূন্যতম লাভের মাধ্যমে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করা। কিন্তু মূল লক্ষ্য থাকে কোনো না কোনো সামাজিক সমস্যার সমাধান করা। যেমন হাল্ট প্রাইজের চ্যাম্পিয়ন, বানোফি লেদারের ব্যবসাটা ছিলো কলার খোসাকে রিসাইকেল করে প্রিমিয়াম লেদার জ্যাকেট বানানো। অর্থাৎ একই সাথে বর্জ্য সমস্যারও সমাধান হচ্ছে, আবার বেশ ভাল ব্যবসাও হচ্ছে। 

বাংলাদেশেও এমন একটি সামাজিক ব্যবসা রয়েছে, যার নাম ‘গ্রামীণ ডানোন’। গ্রামীণ ডানোন এর দই, বিস্কুট, জুস পাউডার এমন নানা ধরনের পণ্য তৈরি করে থাকে। কিন্তু তাদের আসল লক্ষ্যটা কিন্তু গ্রামের বাচ্চাদের পুষ্টি সমস্যা দূর করা। 



ডক্টর ইউনুস মনে করেন, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমেই সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষও সুবিধা পাবে। ফলে বিমোচন হবে দারিদ্র্য। 


জিরো আনএমপ্লয়মেন্ট 

থ্রি জিরো থিওরির দ্বিতীয় ধাপ হলো জিরো আনএমপ্লয়মেন্ট বা শূণ্য বেকারত্ব। কিন্তু জিনিসটা বলা যতটা সহজ, করা ততটাই কঠিন। বিশেষ করে বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সবাই যেন একটা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। 

এর সমাধান হিসেবেও ডক্টর ইউনুস তুলে ধরেন সামাজিক ব্যবসাকে। তার মতে, সকলেই হতে পারে উদ্যোক্তা। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তার সংখ্যা আরও অনেক বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি। কারণ একজন উদ্যোক্তা অন্তত ৪-৫ জনের কর্মসংস্থান করতে পারেন। সময়ের সাথে যা বেড়ে ৪০০-৫০০ ও হতে পারে। 

কিন্তু কোনো ব্যবসা চালু করতে গেলে যেই মূলধরনের দরকার, সেটা সবাই কোথা থেকে জোগাড় করবে? এক্ষেত্রে ডক্টর ইউনুসের সমাধান হলো মাইক্রোক্রেডিট বা মাইক্রোফিন্যান্স। এটিও মূলত তার আরেকটি থিওরি। মজার ব্যাপার হলো, সামাজিক ব্যবসার মতো এটিও একটি প্রমাণিত থিওরি। সত্যি কথা বলতে গেলে, গ্রামীণ ব্যাংক তার যাত্রা শুরুই করেছিলো এই ম্যাইক্রোক্রেডিট এর উপর ভর করে। 



মাইক্রোক্রেডিট কী? 

মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণের সংজ্ঞাটাই স্বাভাবিক ঋণের কিছুটা বিরোধী। কারণ ক্ষুদ্রঋণ হয়ে থাকে জামানত বিহীন। কোনো কিছু জামানত রাখতে পারবে না বলে সাধারণ ব্যাংকিং প্রথায় অতিরিক্ত দরিদ্র্য মানুষদের ব্যাংক ঋণ দেওয়াই হয় না। কিন্তু ডক্টর ইউনুসের ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে এদেশের হাজার হাজার মানুষ তাদের দারিদ্র্য থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। 

তাই ইউনুস মনে করেন, তরুণ উদ্যোক্তাদের যদি মূলধন না থাকে, তবে তাদের ক্ষুদ্র ঋণের উপরেই নির্ভর করা উচিত। কিন্তু তাও নিজের ভাগ্যের চাকা নিজেরই ঘোরানোর চেষ্টা করা উচিত। 


জিরো কার্বন এমিশন 

থ্রি জিরো থিওরি তে শুধু দারিদ্র্য আর বেকারত্ব নিয়েই কথা বলা হয় না, কথা বলা হয় পরিবেশ নিয়েও। আর বর্তমানে সবচেয়ে বড় পরিবেশ ঝুঁকির নাম, কার্বন নিঃসরণ। এই কার্বন নিঃসরণ বা গ্রিন হাউজ গ্যাস এমিশন পুরো পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে অকল্পনীয় হারে। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে তাই আমাদের গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়েই সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামানো উচিত। কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে যেই দেশগুলোর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে, তার মাঝে বাংলাদেশ একটা। 

‘থ্রি জিরো থিওরি’ অনুসারে প্রতিটি মানুষের হয়ে বেড়ে ওঠা উচিত ‘কার্বন-ফ্রি’ (Carbon Free) উপায়ে। তাই সামাজিক ব্যবসাগুলোরও হওয়া উচিত ‘কার্বন’ফ্রি’। অর্থাৎ থ্রি জিরো থিওরির অধীনে যেসকল সামাজিক ব্যবসার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর সবকয়টিকেই হতে হবে পরিবেশ বান্ধব। আর সমাজের মানুষ যখন ধীরে ধীরে কার্বন-ফ্রি সামাজিক ব্যবসায় অভ্যস্থ হতে পড়বে, তখন আপনা থেকেই কমে যাবে কার্বন নিঃসরণ। পৃথিবী পরিণত হবে জিরো কার্ব এমিশনের পৃথিবীতে। 


থ্রি জিরো থিওরির তিনটি পিলার যেভাবে জড়িত 

থ্রি জিরো থিওরির তিনটি পিলারের প্রতিটি আলাদা আলাদা অনেক আশাপ্রদ মনে হলেও, এরা আসলে কিভাবে একে অপরের সাথে জড়িত, সে বিষয়ে বোঝাটা জরুরি। এটি অনেকটা সাইকেলের মতো কাজ করে। 

দারিদ্য বিমোচনের জন্য যখন কেউ উদ্যোক্তার পথ বেছে নিচ্ছে, তখন একই সাথে বেকারত্বও বিমোচন হচ্ছে। আবার বেকারত্ব বিমোচন হচ্ছে বিধায় একাধিক পরিবারের দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যবসা গুলো ‘কার্বন-ফ্রি’ বা ‘গ্রিন বিজনেস’ (Green Business) হওয়ায় কার্বন নিঃসরণও কমছে। কার্বন নিঃসরণ কমায় পরিবেশগত দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট দারিদ্যও কমে যাচ্ছে। 

মূলত এভাবে একটি তিনটি পিলারের পারষ্পারিক নির্ভরতার মাধ্যমে চালিত হয় থ্রি জিরো থিওরি। 


বিশ্বে থ্রি জিরো থিওরির অবস্থান 

ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস শুধু বাংলাদেশের জন্যই থ্রি জিরো ভাবেন নি। বরং তিনি ভেবেছেন পুরো বিশ্বের কথা। সেই প্রেক্ষিতেই বিশ্বের ১১১টি ইউনুস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টারে বর্তমানে থ্রি জিরো থিওরি সম্পর্কে শেখানো হচ্ছে। 


একই সাথে সারা এই থিওরিকে তুলে ধরার জন্য সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অন্তত ৪৬০০ ‘থ্রি জিরো ক্লাব’ গঠিত হয়েছে। তারা সবাই নিজেদের যায়গা থেকে স্ব-উদ্যোগে এই মতবাদের প্রচার প্রসার করছে। সহজ ভাষায় বলা যায়, উন্নত বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে ক্যাপিটালিজমের বিপরীতে যদি এখন কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে থাকে, তবে সেটি থ্রি জিরো থিওরি।


শেষকথা

দুঃখের বিষয় হলো ইউনুসের নিজের দেশ বাংলাদেশে, এতদিন থ্রি জিরো থিওরি নিয়ে তেমন কোনো কার্যক্রম হয় নি। ২০১৫ সালে ডক্টর ইউনুস ৬ষ্ঠ সামাজিক ব্যবসা দিবস উপলক্ষ্যে ‘থ্রি জিরোস’ থিওরি নিয়ে ৩০ টি দেশে থেকে আগত প্রায় ২৫০জন ডেলিগেটের সামনে বক্তব্য রাখেন। ২০১৭ সালে প্রকাশ হওয়া তার বইয়ের কথা তো বলেছিই। কিন্তু এরপর দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত তেমন কোনো কার্যক্রম হয় নি। এমনকি বাংলাদেশের থ্রি জিরো ক্লাবের কার্যক্রমও ছিল মন্থর।

ডক্টর ইউনুস বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পরে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে সরকারি ভাবে থ্রি জিরো থিওরি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। কিভাবে এসডিজি অর্জনে এই থ্রি জিরো থিওরি ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে এখন কিছু কথা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ থ্রি জিরো থিওরিতে বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, বিশ্ব যে বিশ্বাস করেছে, তার প্রমাণটা বেশ স্পষ্ট।  


তথ্যসূত্র

১। ইউনুস সেন্টার

২। দ্যা ডেইলি স্টার 

৩। ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস 

৪। অবজার্ভার বিডি 
৫। প্রথম আলো

Previous Post

Next Post

Related Posts

বাংলাদেশে স্টারলিংক আসায় কাদের লাভ? কত খরচ হবে...

13-03-2025

Sustainable Development

বাংলাদেশে স্টারলিংক আসায় কাদের লাভ? কত খরচ হবে...

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড মুহাম্মদ ইউনূস, ইলন...

Read More
বাংলাদেশের নতুন সংবিধান আর আমেরিকার সংবিধানের মিল...

11-03-2025

Sustainable Development

বাংলাদেশের নতুন সংবিধান আর আমেরিকার সংবিধানের মিল...

বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা...

Read More
চাকরির পাশাপাশি সাইড বিজনেস শুরু করার কার্যকর উপায়

10-03-2025

Sustainable Development

চাকরির পাশাপাশি সাইড বিজনেস শুরু করার কার্যকর উপায়

বর্তমান সময়ে শুধুমাত্র একটি চাকরির আয়ে আর্থিক...

Read More

Trending

About MAWblog

MAWblog strives to provide a platform for authors, reporters, business owners, academics, people who do writing as a hobby and concerned citizens to let their voices be heard by a wider community. Our goal is to publish contents that are in line with our core goals of promoting sustainable business practices, improving community harmony and facilitating knowledge sharing and ethical labour market practices.

We invite you to write and publish under any of our nine chosen categories and make an impact towards building a better and more sustainable future.

Sign Up for Our Weekly Fresh Newsletter