Economy

মুদ্রাস্ফীতির একাল সেকাল

Written by: এস এম নাহিয়ান

23-05-2024

মুদ্রাস্ফীতির একাল সেকাল


বাংলাদেশের জনজীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ যেন এখন মুদ্রাস্ফীতি। শত সমস্যার ভীড়েও, এই একটি সমস্যার কথা ভুলতে পারছেন না কোনো স্তরের মানুষ। বিশেষত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের গলার কাঁটা যেন এই মুদ্রাস্ফীতি। অনেকে আবার বলছেন, দেশে মধ্যবিত্ত বলতে এখন আর কোনো শব্দ নেই। মধ্যবিত্তরাই যেন আজ নিম্নবিত্ত। অথচ বছর দশক আগেও এমন পরিস্থিত ছিল না। আর এই ১০ বছরে নিত্যপণ্যের দামটা বাড়লেও, মানুষের আয়ের পরিমাণটা মোটেও তেমন বাড়ে নি। ১০ বছর আগে কেমন ছিল দেশের পরিস্থিতি? আর এখনই বা কোন অবস্থানে দাড়িয়েছি আমরা? এতদিন কি আদৌ এদেশের মানুষের জীবনে এক ফোটাও স্বস্তি এসেছে? এ সকল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে চলুন আগে জেনে নেওয়া যাক এই সব কিছুর মূলে যেই কালপ্রিট, সেই মুদ্রাস্ফীতি আসলে কি।


মুদ্রাস্ফীতি কী? 

মুদ্রাস্ফীতি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে পণ্যের বিপরীতে মুদ্রার বা টাকার মূল্যমান কমে যায়। খুব সহজ ভাবে যদি বলি, ১ কেজি চালের মূল্য ধরা যাক ৫০ টাকা। কিন্তু সেই একই চাল যদি আপনাকে এখন ৬০ টাকা দিয়ে কিনে খেতে হয় তার মানে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে। কারণ আগে ৫০ টাকা দিয়েই আপনি ১ কেজি চাল পেতেন। কিন্তু এখন সমপরিমাণ পণ্য কেনার জন্য আপনাকে অতিরিক্ত ২০% টাকা খরচ করতে হচ্ছে। 


তবে এমন উদাহরণ থেকে অনেকে মনে করেন, পণ্যের দাম বৃদ্ধি মানেই মূদ্রাস্ফীতি। বিষয়টা তা নয়। বরং, পণ্যের দাম বৃদ্ধি হলো মুদ্রাস্ফীতির একটি ফলাফল মাত্র। মুদ্রাস্ফীতি নামটি থেকেই এর সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। ‘মুদ্রার স্ফীতি’, অর্থাৎ একটি দেশে যখন পণ্যের তুলনায় মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়, তখনই ঘটে মুদ্রাস্ফীতি। এর পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতিরিক্ত টাকা ছাপানো থেকে শুরু করে, বৈশ্বিক মন্দা, যুদ্ধ, উৎপাদন ব্যহত হওয়া, সুদের হার, ভর্তুকির পরিমাণ থেকে শুরু করে নানা ধরনের কারণ থাকতে পারে। 


দেশের সার্বিক মুদ্রাস্ফীতির চিত্র 

দেশের সার্বিক মুদ্রাস্ফীতির একটি চিত্র পাওয়া যায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এর তথ্য-উপাত্ত থেকে। গত ১৩ বছর সহ এ বছর এপ্রিল অবধি মুদ্রাস্ফীতি তুলনা করলে দেখা যায় ২০১০ সালের পর থেকেই মুদ্রাস্ফীতি ক্রমাগত শুরু করে। ১০ এর ঘর থেকে ৮, ৭,৬ এমনকি ৫ শতাংশের ঘরেও গিয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। কিন্তু ২০২১ সাল থেকেই তা উর্ধ্বমুখী আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ৮ শতাংশের অধিক। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি যেন লাগামছাড়া। গত ১২ বছরে  বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি এতটা বাড়ে নি।




 


অর্থ বছর 

মুদ্রাস্ফীতি 

২০১০-১১

১০.৯২

২০১১-১২

৮.৬৯

২০১২-১৩

৬.৭৮

২০১৩-১৪

৭.৩৫

২০১৪-১৫

৬.৪১

২০১৫-১৬

৫.৯২

২০১৬-১৭

৫.৪৪

২০১৭-১৮

৫.৭৮

২০১৮-১৯

৫.৪৮

২০১৯-২০

৫.৬৫

২০২০-২১

৫.৫৬

২০২১-২২

৬.১৫

২০২২-২৩

৮.৮৭

২০২৩-২৪

৯.৪৬ (এপ্রিল ‘২৪) 


তথ্যসূত্রঃ বিবিএস 


কিন্তু পরিসংখ্যা ব্যুরো এর তথ্য থেকেই কি বাজারের প্রকৃত অবস্থা বোঝা সম্ভব? উত্তরটি হচ্ছে একদমই না। এ সকল তথ্য উপাত্ত মূলত কিছু নির্দিষ্ট পণ্য ও সেবার দামের উপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়। কিন্তু বাস্তবে বাজারদর এতটা স্থীতিশীল থাকে না। বরং হটাৎ হটাৎ নানা অজুহাতে বাজার দরে হয়ে যায় আকাশচুম্বী। আর একটি কথা প্রচলিত আছে যে, বাংলাদেশের বাজারে একবার যদি কিছু দাম বাড়ে, তাহলে তার দাম আর কমে না। চলুন দেখা যাক এ দেশের বাজারের বাস্তব চিত্র। 


গত ১০ বছরে দেশের বাজারে মুদ্রাস্ফীতির চিত্র

নিত্যপণ্য 

ছবিঃ ঢাকাপোস্ট 


১০ বছর আগের বাজারমূল্যের তুলনায় বর্তমানের বাজার মূল্যের চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। বিবিএস এর তথ্য অনুসারে তুলনা করতে গেলে ঘুরে দেখতে হবে ২০১৪-১৫ সালের বাজারদরের দিকে। চলুন দেখা যাক নিত্য পণ্যের বাজার তখন কেমন ছিল। আর আজকের বাজার দরের সাথেই তার কতটা পার্থক্য 



পণ্যের 

ধরন 

পণ্য 

পরিমাণ 

বাজারদর  (টাকা) 

বর্তমান দর

(টাকা) 

চাল 

চাল (নাজিরশাইল / মিনিকেট) 

কেজি 

৫৫

৯২

চাল (ইরি / বোরো) 

কেজি 

৩৬

৬৬

আটা (সাদা) 

কেজি 

৪০

৬১

ডাল 

মুগ ডাল 

কেজি 

১২১

২১০  

মুসুর ডাল 

কেজি 

১৩৩

১৭০

চিনি 

চিনি 

কেজি 

৪৯

১৩৫

আমিষ জাতীয় খাবার 

রুই (কাট পিস) 

কেজি 

৩৯৫

৫০০

ইলিশ (মধ্যম) 

কেজি 

১৪৩০

১৬০০

চিংড়ী (৩ ইঞ্চি) 

কেজি 

৭১০

১১০০

শিং (প্রতিটি ৫০ গ্রাম) 

কেজি 

৭৫০

৯০০

গরুর মাংস 

কেজি 

৪০০

৭৫০

খাসির মাংস 

কেজি 

৫২০

১১০০

ডিম (ফার্মের মুরগি) 

৪ পিস 

৩২

৬০

ডিম (হাস) 

৪ পিস

৪৪

৭০

তেল 

মাস্টার্ড তেল 

লিটার 

১৭৮

৩৪০ 

সয়াবিন তেল 

লিটার 

৮৮

১৬৫

মশলা 

মরিচ (শুকনো) 

কেজি 

২০৬

৬০০  

পেঁয়াজ (দেশী) 

কেজি 

৫২

১২০

রসুন 

কেজি 

১২৮

২৪০

হলুদ 

কেজি 

১৫৭

৫৮০

আদা 

কেজি 

১০৯

২৫০

লবণ 

কেজি 

২০

৪০

সবজি 

আলু 

কেজি 

২৬

৬০

বেগুন 

কেজি 

৫০

১০০

ঢ্যাঁড়শ

কেজি 

৪৬

৮০

পেপে (কাচা) 

কেজি 

২৭

৮০

দুধ 

দুধ (পাস্তুরিত) 

কেজি 

৬৭

৯০

বাচ্চাদের খাবার 

কেজি 

৫৭৩

১৫৯০


তথ্যসূত্রঃ বিবিএস-কনজ্যুমার প্রাইস ইন্ডেক্স (২০১৬) এবং বর্তমান বাজার দর 

অন্যান্য পরিষেবা 

তবে জন জীবনের এ সকল নিত্য পণ্যেরই যে শুধু প্রয়োজন আছে তেমন কিন্তু নয়। বরং এর বাইরেও যে সকল পণ্য রয়েছে, সেগুলোরও দাম বেড়েছে অনেকটাই। ২০১৪-১৫ সালে চুল কাঁটা, জুতা পালিশ করানো ইত্যাদি সাধারণ জিনিসের খরচও বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এ খরচ গুলো ছোট-খাটো খরচ হলেও এত বিপুল বৃদ্ধি সামলাতে অনেকেই হয়তো এখন মাসে দু’বারের যায়গায় একবার চুল কাটেন। হয়তোবা অফিসে মিটিং থাকা সত্ত্বেও জুতা পালিশ না করেই চলে যান। সব মিলিয়ে বড় থেকে ছোট, প্রতিটি বিষয়েই লেগেছে অভাবের ছোয়া। 


সেবার 

ধরন 

সেবা

ইউনিট 

খরচ 

(টাকা) 

বর্তমান খরচ

(টাকা)

ব্যক্তিগত 

চুল কাঁটা (ভাল স্যালুন) 

১ জন 

৬০

২৫০

চুল কাঁটা (সাধারণ স্যালুন) 

১ জন 

৪৫ 

১৫০

জুতা পালিশ 

১ জোড়া 

২০ 

৪০

জুতার সোল লাগানো 

১ জোড়া 

১২০

১৮০

লন্ড্রি 

শাড়ি (সুতা) 

১ ওয়াশ

৩০

৬০

শাড়ি (সিল্ক / শিফন / জর্জেট) 

১ ওয়াশ

৬৪

১২০

ফুল প্যান্ট 

১ ওয়াশ

১৬

৬০

শার্ট 

১ ওয়াশ

১৩

৬০

কোট 

১ ওয়াশ

১৭৪ 

২০০

দর্জি 

ফুল শার্ট 

১ পিস 

২০০

৬০০

ফুল প্যান্ট 

১ পিস

২৮০

৪৫০

পাজামা 

১ পিস

১১০

৪০০

ব্লাউজ 

১ পিস

৮০

৫০০ 


তথ্যসূত্রঃ বিবিএস-কনজ্যুমার প্রাইস ইন্ডেক্স (২০১৬) এবং বর্তমান বাজার দর 

পরিবহন 

ছবিঃ জাগোনিউজ 


পরিবহন খাতের খরচটা উল্লেখ না করলেই নয়। ২০১২ সালে প্রায় ৫০ ভাগ ভাড়া বাড়ানোর পর ২০১৬ সালে আবার সাড়ে ৭ শতাংশ ভাড়া বাড়ায় রেল কর্তৃপক্ষ। যুক্তি ছিল, যাত্রী সেবার মান উন্নয়ন এবং ক্ষতির লাগাম টেনে ধরা। যাত্রী সেবার মান কতটা উন্নত হয়েছে তা ট্রেনে উঠলেই বোঝা যায়। তবে তারপরেও কিছুদিন আগেই দূরপাল্লার টিকেটের রেয়াতী সুবিধা বাতিল করেছে ট্রেন। আর শহরে চলা লোকাল বাসের দৌরাত্ন্যের কথা না বললেলই নয়। তেলের দাম বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভাড়া বৃদ্ধি ছাড়াও, যাত্রীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অন্যায্য ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও দুর্ব্যবহার নগরবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী।  


সেবার ধরন 

সেবা

ইউনিট 

খরচ 

বর্তমান খরচ 

(টাকা) 

রেল 

শোভন (ঢাকা-চট্টগ্রাম) 

১ টিকিট

৩২০

৪৫০

স্নিগ্ধা  (ঢাকা-চট্টগ্রাম) 

১ টিকিট

৬১০

৮৫৫

বাস 

শহরের ভেতরে  

১ কি.মি.

১.৬৮

২.৮

দূরপাল্লা  (ঢাকা-চট্টগ্রাম) 

১ টিকিট 

৩০০-৬০০

৪৮০-১১০০

তেল 

ডিজেল 

১ লিটার

৮০

১০৯

 

কেরোসিন 

১ লিটার

৮০

১০৯

 

অকটেন 

১ লিটার

৮৯

১৩০

 

পেট্রোল

১ লিটার

৮৬

১২৫

অন্যান্য 

অটো রিকশা 

১ কি.মি.

৬৬

১২০

রিকশা 

১ কি.মি. 

২৫

৫০


তথ্যসূত্রঃ বিবিএস-কনজ্যুমার প্রাইস ইন্ডেক্স (২০১৬) এবং বর্তমান বাজার দর 

চিকিৎসা 

ছবিঃ সমকাল 


কথায় আছে সৃষ্টিকর্তার পরে কেউ যদি মানুষ বাঁচাতে পারে, তবে তা ডাক্তার। কিন্তু ডাক্তারদের জন্য ডাক্তারিটাও তাদের পেশা। আর দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির আঁচ তাদের গায়েও লাগে। ফলে স্বভাবতই বেড়েছে ডাক্তারদের ফি। তবে আসল ব্যবসার যায়গাটা বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার সাথেই বেশি জড়িত। সারা দেশে অবস্থিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার গুলোর জন্য খুব কমই নীতিমালা রয়েছে।  


সেবার ধরন 

সেবা

ইউনিট 

খরচ 

বর্তমান খরচ 

(টাকা) 

ডাক্তার

এমএমবিএস ডাক্তার 

হোম 

৩৬০

১০০০

এমএমবিএস ডাক্তার 

চেম্বার 

২৫০

৫০০

এফআরসিএস 

চেম্বার 

৩৩০

১০০০

 

ব্লাড টেস্ট 

১ বার 

২৬০

৫৫০ 

ইউরিন টেস্ট 

১ বার 

১০০

৩৫০

স্টুল টেস্ট 

১ বার 

১২০

৩৫০

বুকের এক্স-রে 

১ বার 

২০০

৩৫০

 

ইসিজি 

১ বার 

৩৫০

৮০০


তথ্যসূত্রঃ বিবিএস-কনজ্যুমার প্রাইস ইন্ডেক্স (২০১৬) এবং বর্তমান বাজার দর 


২০১৮-১৫ অর্থবছরে প্রতিটি পণ্য ও সেবার খরচ আর বর্তমানের খরচের পার্থক্যটা খুব সহজেই বোঝা যায়।  নিত্য পণ্য থেকে শুরু করে দৈনন্দিন পরিষেবা, পরিবহন খরচ এমনকি চিকিৎসা খরচও বেড়েছে বহুগুণ। খরচের সাথে সাথে যদি আয়ও বাড়তো, তাহলে হয়তো এতটা দুর্বিষহ অবস্থা হতো না। কিন্তু অথচ মানুষের আয় তেমনটা বাড়ে নি। চলুন দেখা যাক পূর্বের ও বর্তমানের আয়ের পার্থক্য। 


গত ১০ বছরে বাংলাদেশে আয়ের তুলনামূলক চিত্র

গত ১০ বছরে বাংলাদেশের মানুষের আয়ের হিসাব করতে গেলে প্রথমেই চলে আসে জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ এর কথা। ২০১৫ সালে সরকারি চাকরির বেতন প্রায় দ্বিগুণ করা হয়। আর সাথে সাথেই বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। কিন্তু বেসরকারি চাকরিজীবীদের ভাগ্যে বেতন বৃদ্ধি সুবাতাস একদমই বয় নি। ফলে অনেক বেসরকারি চাকরিজীবীকে তখন হিমসিম খেতে হয়েছে।


তথ্যসূত্রঃ ন্যাশনাল বোর্ড অফ রেভিনিউ


জাতীয় বেতন স্কেল বেতন ঘোষণা করা হয় তা আসল মূল বেতন। এর সাথে এলাকা ভেদে মূল বেতনের ৫০% অবধি বাড়ি ভাড়া ভাতা পাওয়া যায়। তার সাথে থাকে আরও নানা প্রকারের ভাতা। যেমন, গাড়ি ভাতা, টেলিফোন, ভ্রমণ, আপ্যায়ন, শ্রান্তি ও বিনোদন, শিক্ষা, ধোলাই, ঝুঁকি, প্রেষণ, মহার্ঘ, অধিকাল ইত্যাদি নানা ধরনের ভাতা। সব মিলিয়ে যা মূল বেতনের প্রায় দুই গুনের কাছাকাছি। 


কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও একই বেতন রয়েছে সরকারি চাকরিজীবিদের। অর্থাৎ এই বেতনে ২০১৫ সালে একজন সরকারি চাকরিজীবি যতটা ক্রয়ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, এখন অনেকাংশেই তার অর্ধেক ক্রয় ক্ষমতাও নেই। 


বেসরকারি আয়ের চিত্র

সরকারি বেতনের মতো কোনো সুনির্দিষ্ট বেতন স্কেল নেই বিধায় বেসরকারি আয়ের চিত্র তুলে আনা কিছুটা কঠিন। এছাড়াও, বেসরকারি চাকরির ধরন অনেক এবং এক কোম্পানির সাথে আরেক কোম্পানির মিল থাকে না। এমনকি একই কোম্পানির ভেতরে একই পদে চাকরিরত চাকরিজীবীরা কেউ কম কেউ বা বেশি বেতন পান। তবে এই মুদ্রাস্ফীতিতে বেসরকারি চাকরিজীবীদের ক্রয়ক্ষমতা সরকারি চাকরিজীবি থেকেও বেশি কমেছে। বছর দশেক আগে বেসরকারি চাকরিতে ঢোকার সময় বেতন এবং বর্তমানের বেতন দেখলেই তা বোঝা যায়। 


পদের নাম

পূর্বে সদ্য স্নাতকপাশদের বেতন

(মাসিক/টাকা)  

বর্তমানে সদ্য স্নাতকপাশদের বেতন (মাসিক/টাকা) 

ম্যানেজমেট ট্রেইনি অফিসার 

১৮,০০০-২৫,০০০

২৫,০০০-৩০,০০০

এক্সিকিউটিভ (লজিস্টিকস) 

২০,০০০-২৫,০০০

২২,০০০-২৬,০০০

জুনিয়র এক্সিকিউটিভ (ইঞ্জিনিয়ারিং) 

২০,০০০-২৫,০০০

২০,০০০-২৫,০০০

জুনিয়র আর্কিটেক্ট 

১২,০০০-১৫,০০০

২০,০০০-২২,০০০ 

জুনিয়র সফটওয়্যার ডেভেলপার

২০,০০০-৩০,০০০

১৫,০০০-২৫,০০০

জুনিয়র টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার 

২০,০০০-২৫,০০০

১৫,০০০-২০,০০০


তথ্যসূত্রঃ ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ ও বর্তমান বেতনস্কেল 


উপরের ছকটি দেখে অবাক হলেও, এটিই সত্যি। মুদ্রাস্ফীতিতে সব কিছুর দাম বাড়লেও, বাড়ে নি সদ্য স্নাতকপাশ চাকরিজীবীদের বেতনের পরিমাণ। বেসরকারি চাকরীতে অতি উচ্চ পর্যায়ে লাখ দশেক বেতনও অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষত শিপিং, লজিস্টিকস, ব্যাংকিং, বিদ্যুৎ ইত্যাদি খাতের বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানির পরিচালক পর্যায়ের চাকরিজীবীরা লক্ষ লক্ষ টাকা বেতন নেন। কিন্তু এমন লোকের সংখ্যা ১% ও হবে না। 


অপরদিকে সারা দেশ জুড়ে বেসরকারি চাকরিজীবিদের হাহাকারই বেশি। প্রথমত সরকারি চাকরির ন্যায় চাকরির নিশ্চয়তার ছিটে ফোটাও নেই। দ্বিতীয়ত মাস শেষ হলেই বেতন আসবে, এমনটা নিশ্চয়তাও সকলে পান না। অনেক চাকরিজীবীই কোম্পানির লসের কারণে হটাৎ ছাটাই হন। নির্দিষ্ট প্রমোশনের কোনো পদসোপান না থাকায় অনেকই বছরের পর বছর একই পদে চাকরি করেন। বেসরকারি চাকরীতে বেতন বৃদ্ধির হারটাও নির্দিষ্ট নয়। অল্প কিছু সংখ্যক চাকরিজীবী হয়তো চাকরিতে যোগদানের ৩-৪ বছরের মধ্যেই লক্ষ টাকা কামান। কিন্তু বেশিরভাগ চাকরিজীবীর জন্য বেতনের কোঠাটা ১০ বছর পরেও ৫০ এর আশে পাশেই থাকে। 


আরও বড় একটি বিষয় হলো সদ্য স্নাতকপাশের সংখ্যা। ২০১৪-১৫ সালেও দেশে স্নাতকপাশের সংখ্যা এতটা বেশি ছিল না। যোগানের সাথে চাহিদার মেলবন্ধন থাকায় বেতনটাও সে সময়ের হিসাবে তেমন খারাপ ছিল না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বেড়েছে স্নাতকপাশদের সংখ্যাও। বিশেষ করে বিবিএ, টেক্সটাইল, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি বিষয়ে প্রচুর পরিমাণ স্নাতক চাকরির বাজারের ঢুকেছে। আর চাহিদার তুলনায় যোগান বেড়ে যাওয়ায় স্বভাবতই আর বেতন বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন মনে করে নি প্রতিষ্ঠান গুলো। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ১০ বছর আগের বেতনের তুলনায় বর্তমান বেতন কমেছে। অথচ বাজারে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। 


আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশী টাকার অবস্থান

ছবিঃ সিইআইসি 


মুদ্রাস্ফীতি শুধু যে দেশের অভ্যন্তরে হয় তা নয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারেও ক্রমাগত মুদ্রার দামের ওঠা নামা ঘটে। আর সে বাজারে বাংলাদেশী টাকার দাম এখন একদমই নেই। ঠিক দুই বছর আগে ২০২২ সালের মে মাসেও ৮৫-৮৬ টাকার বিনিময়ে পাওয়া যেত এক মার্কিন ডলার। কিন্তু দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে এখন সেই ১ ডলার পেতেই গুণতে হবে ১১৭ টাকা। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরে টাকার মূল্য কমেছে প্রায় ৩৭.৬৪%। অর্থাৎ যদি আপনি দুই বছর আগে ১০ লক্ষ টাকার মালিক হয়ে থাকেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তার মূল্য মাত্র ৬ লক্ষ ২৫ হাজার টাকার মাত্র। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, কতটা ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির কবলে বর্তমানে রয়েছে বাংলাদেশ। 


শেষকথা

 

সরকারি ভাবে মুদ্রাস্ফীতির নানা ধরনের পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হলেও তা দেখে বাস্তব পরিস্থিতি বোঝাটা দুষ্কর। ৯% মুদ্রাস্ফীতি ঘোষণা করা হলেও তার প্রভাব যে কতটা গভীর তা হয়তো এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন। সাধারণত একটি দেশের ২-৩% মুদ্রাস্ফীতি স্বাভাবিক। কিন্তু তা যখন ৫-৬% পার হয়ে ৯-১০% এ উঠে যায়, তখন যেকোনো দেশের জনগণের নাভিঃশ্বাস উঠতেই বাধ্য। এ মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য নাগরিক পর্যায়ে খুব বেশি কিছু করার থাকে না। তবে বৈদিশিক পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে দেশীয় পণ্যের ব্যবহার বাড়ালে ডলার রিজার্ভের উপর চাপ কিছুটা লাঘব হবে। এছাড়াও নিয়মিত ট্যাক্স পরিশোধ ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে স্বাভাবিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়া ব্যাতীত খুব বেশি কিছু একজন সাধারণ নাগরিকের এ মূহুর্তে করার নেই।


তথ্যসূত্র 

১।  মুদ্রাস্ফীতি কী? অর্থনীতিতে এর প্রভাব কেমন পড়ে - BBC News বাংলা

২। পত্রিকা(১১ই সেপ্টেম্বর): খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ - BBC News বাংলা

৩। রিজার্ভ কমছেই | undefined (thedailystar.net)

৪। চার কারণে বাড়ছে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি : বিশ্বব্যাংক (dhakapost.com)

৫। নয় বছরে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি (newsbangla24.com)

৬। আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ: জুনে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭.৫৬ শতাংশ (voabangla.com)

৭। ৮ বছরে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি (dailynayadiganta.com)

৮। - - বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (bbs.gov.bd) 

৯।  বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (bbs.gov.bd)

১০। ১১ বছর পর সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি | প্রথম আলো (prothomalo.com) 

১২। রেল: চলছে চুরি, বাড়ছে ভাড়া (banglatribune.com) 

১৩। এবার লোকসান থামাতে রেলের ভাড়া বাড়ছে | প্রথম আলো (prothomalo.com)

১৪।  Bangladesh Bureau of Statistics (bbs.gov.bd)

১৫। Monthly Household Nominal Income and Consumption Expenditure...

১৬। Department of Agricultural Marketing: Manage Event (dam.gov.bd)

১৭। https://www.banglajol.info/index.php/ABA/article/view/51939 

১৮। Comparison Between Public & Private


Previous Post

Next Post

Related Posts

যেভাবে আপনার প্রতিষ্ঠান কে বিদেশী বিনিয়োগের উপযোগী করে...

16-10-2024

Economy

যেভাবে আপনার প্রতিষ্ঠান কে বিদেশী বিনিয়োগের উপযোগী করে...

ব্যবসা ও বিনিয়োগ, একটি ছাড়া অপরটির অস্তিত্ব কল্পনা করা...

Read More
বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট নিরসন হবে কিভাবে?

28-08-2024

Economy

বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট নিরসন হবে কিভাবে?

গত বেশ কয়েক বছরে বাংলাদেশের ফরেইন রিজার্ভ নিয়ে...

Read More
ঈদের অর্থনীতিঃ বাংলাদেশের যত ব্যবসা ঈদে

09-04-2024

Economy

ঈদের অর্থনীতিঃ বাংলাদেশের যত ব্যবসা ঈদে

পবিত্র রমজান মাস জুড়ে রোজা পালনের মাধ্যমে দেহের...

Read More

Trending

About MAWblog

MAWblog strives to provide a platform for authors, reporters, business owners, academics, people who do writing as a hobby and concerned citizens to let their voices be heard by a wider community. Our goal is to publish contents that are in line with our core goals of promoting sustainable business practices, improving community harmony and facilitating knowledge sharing and ethical labour market practices.

We invite you to write and publish under any of our nine chosen categories and make an impact towards building a better and more sustainable future.

Sign Up for Our Weekly Fresh Newsletter